ইট দিয়ে ডোমিনো খেলার খেসারত

স্মৃতিময় শৈশব-১৬

ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :

সম্ভবত: তখন ১৯৪৭ কিংবা ১৯৪৮ সন। আমাদের বাড়ির দক্ষিণে খনন করা হলো একটা পুকুর। পুকুরটির প্রধান প্রবেশ পথে উত্তর দিকে শানবাঁধানো ঘাট তৈরি করার মনস্থ করলেন বাবা। এ উদ্দেশ্যে কয়েক হাজার নতুন ইট কেনা হয়। আর সেগুলোকে স্তূপীকৃত করা হলো পার্শ্ববর্তী তছলুদের পুকুর পাড়ে। কারণ, এ পুকুরের পশ্চিম পাড়টি আমাদের পুকুরের পূর্ব পাড়ের সাথে প্রায় লাগোয়া। দুটি পুকুরের পাড়ের মাঝখানে কেবলমাত্র একটি ছয় ফুট চওড়া হালট (রাস্তা) বিদ্যমান।

সকালের সূর্য পূর্ব দিকে উঁকি মারলেই এর প্রভাব ও রশ্মি এসে পড়ে তছলুদের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে। আর শীতকালে সকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এসে জমা হয় এই পুকুর পাড়ে। সেদিন একইভাবে আমার খেলার সাথীরা উপস্থিত ছিল পাড়টিতে। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল শেখ ফতেহ আলী ওরফে ফতেহ মিঞা। ফতেহ মিঞা অন্যান্য আরও দু’চারজন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকখানা ইটকে খাড়া করে পরপর রেখে পরে একদিক থেকে পা দিয়ে ধাক্কা মারছিল। আর এতে ডোমিনোর মত পরপর কাত হয়ে ইটগুলো ঢলে পড়ছিল দেখে সবাই উল্লাসে মতোয়ারা হচ্ছিল। আমিও বাড়ি থেকে ওদের ইটের স্তুপের পাঁজা কাছে জমায়েত দেখতে পেয়ে কৌতুহল বশত: খেলার বন্ধুদের সাথে গিয়ে যোগ দেই। ডোমিনো খেলার ফলে মাঝে মধ্যে দু একটা ইট যে ভেঙে যাচ্ছিল না, তা নয়! কিন্তু আমরা এ খেলা চালিয়েই যাচ্ছিলাম।

কিন্তু বাবা সকালের ঘুম থেকে উঠে তাঁর চেয়ারে বসেই বারান্দা থেকে দেখতে পেলেন আমাদের সদ্য কেনা ইটের পাঁজার কাছে অনেক ছেলে-মেয়ের জটলা। দেখেই উনি সেজ ভাইকে পাঠালেন ব্যাপারটা দেখতে এবং কোনোরূপ খেলা চললে তা এখনই বন্ধ করতে।
“বুদো! যা তো দেখি আয়, শয়তানগুলো ইটের কাছে কী করছে? ইট দিয়ে কোনোরকম বদমায়েশি কাজকর্ম চলছে কি না। আর ওখান থেকে ছোটকাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। বলবি আমি ডাকছি!”
সেজ ভাই সোজা এসে সবাইকে ইট দিয়ে খেলা করা বন্ধ করতে বললেন বাবার নিষেধ মোতাবেক। এনছান উদ্দিন দারোগার নির্দেশ না শোনার মতো কারও বুকের পাটা ছিল না। ফলে ডোমিনো খেলা থামিয়ে যে যার বাড়ির দিকে দিল ছুট। আর আমি সেজো ভাইয়ের সঙ্গে বাড়িতে ফিরে এসে বাাবার প্রশ্নের মুখে পড়লাম।
ছোটকা! তুই ওসব বাঁদর ছেলেপেলেদের সঙ্গে ইট দিয়ে কেন খেলা করছিলি? ইটের যা দাম, তাতে একটা-দুটা ইট ভেঙে গেলেও আবার কিনে আনতে কত কাঠ-খড় পোড়াতে হবে, তা জানিস?
না বাবা! আমি ইট দিয়ে কোনো খেলা করি নাই।
আমি তো ওদের খেলতে দেখেই ইটের পাঁজার কাছে গিয়েছিলাম।

আমাদের কথোকথন মা নীরবে শুনছিলেন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। মা শান্ত ও নিচু গলায় বললেন-
হ্যাঁ, আমি দেখেছি ছোটকা সকালে উঠে তার স্কুলের পড়া শিখছিল। এর পরেই সে হয়তো ওদেরকে ইটের পাঁজার কাছে দেখতে পেয়ে ওখানে গেছে!
বাবা কিছুটা বিরক্তি ও হতাশা প্রকাশ করেই একটা মন্তব্য করলেন। এটি আমার ছোট মনে সূচের মত বিঁধে রইল।
সে বুঝলাম কুদুর মা। কিন্তু ছোটকা ওখানে গিয়ে ঐসব বাঁদর ছেলেপেলেগুলোকে ইটের খেলা খেলতে নিষেধ করলো না কেন? ও কি নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে পারে না?
ছেলেটা বড় হয়ে বোকা হবে না কি?

মা তাঁর স্বাভাবসূলভ মৌনতা রক্ষা করে কোনো উচ্চ-বাচ্য করলেন না। আমি মনমরা হয়ে নিজের পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
যথাসময়েই আমাদের পুকুরের শান-বাঁধানো ঘাট (সিঁড়িসহ), চাতাল এবং পূর্ব ও পশ্চিম উভয়দিকে হেলান দিয়ে বসার জন্য ইট সিমেন্টের বেঞ্চ তৈরি হলো। পুকুরের চারপাশের সীমানা ঘিরে কাঁটা তারের বেড়া স্থান পেল। খুঁটি হিসেবে জিকা গাছের মোটা মোটা ডাল পোতা হলো। উদ্দেশ্য যে ওগুলো অচিরেই শিকর ছেড়ে বেঁচে উঠবে। এতে করে এক সময় একটা জীবন্ত বেড়া পাওয়া যাবে। পুকুর পাড়গুলোর নতুন মাটিতে বাবা প্রথমে নানা প্রকার কলাগাছের চারা রোপন করলেন। এসব চারা আমাদের বাড়ির পেছন দিকের কলার ঝাড়গুলো থেকেই উপড়ানো হলো। প্রধানত: চাপা, রম্ভা (স্থানীয় নাম রুম্বি), শবরি ও আনাজ (কাচ) কলার চারা। কয়েকটা নারিকেলের চারাও বনবিভাগের নার্সারি থেকে আনিয়ে লাগানো হয়। বাবা আমাকে বললেন বেশ কিছুসংখ্যক খেজুর বীজ এনে উত্তর ও পূর্বদিকের পুকুর পাড় এবং ঢালে ছিটিয়ে দিতে। আশা এতে ভবিষ্যতে খেজুর গাছ জন্মাবে।

এবার বাবার শখ হল পুকুরে মাছ ছাড়বেন। কোথা থেকে জানি না, একদিন দেখি দুজন লোক এসে তাদের অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল থেকে কিছুসংখ্যক রুই, কাতলা ও মৃগেল মাছের পোনা পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে অবমুক্ত করছে। চারা পোনা মাছগুলো কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ বড়সড় হয়ে উঠলো। তবে রুই, কাতলা ও মৃগেল মাছের পোনাগুলোর ঠিক কী অনুপাতে ছাড়া হয়েছিল, তা জানতে পারিনি।

আমরা প্রতিদিন বেড়ে উঠা পোনা মাছগুলোকে চাক্ষুস দেখতে এদের জন্য কুঁড়া, ভাত, মুড়ি কিংবা খই ছিটাতাম। মাছগুলো মহানন্দে এসব খাদ্য খেতে সিঁড়ির কাছে এসে প্রতিযোগিতা করতো। ছয় থেকে আট মাস যেতে না যেতেই পোনামাছগুলো এক একটা ওজনে প্রায় আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত হয়ে উঠলো। এসব মাছের খেলা দেখতে এবং এমন কি মুঠোয় খাবার রেখে হাতটাকে পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখলেই কোনো কোনো মাছ নির্ভয়ে এসে হাতের মুঠো থেকে খাবার খেত।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: এ দৃশ্য ছিল খুবই সাময়িক! কারণ, চৈত্র-বৈশাখ মাসে যখন পুকুরের পানি প্রাকৃতিকভাবেই কমে যায়, তখন এক রাতে আমাদের পুকুরে গ্রামের কারা যেন ক্ষেপজাল বা টানা জাল দিয়ে মাছগুলো ধরে নিয়ে যায়। আমি সকালে উঠে পুকুরে মাছের খাবার দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম যে, পুকুরের পানি ঘোলা। খাবার ছিটিয়ে দিলেও কোনো মাছ এলো না খেতে! তখনই আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধলো যে পুকুরের মাছ চুরি হয়ে গেছে। বাড়ি এসে বাবাকে জানালাম-
বাবা! আমাদের পুকুরের মাছগুলো কে বা কারা যেন রাতের বেলায় সব ধরে নিয়ে গেছে!

তাই নাকি? বলিস কী রে! এ কম্মটা নিশ্চয়ই পশ্চিম দিকের ‘কাউয়া’ বাড়ির কারসাজি! ঠিক আছে, এর শালিস বসবে আজই। তুই একটু মজলিশ সরদারকে ডেকে নিয়ে আয়। আর তুই যদি না পারিস, তাহলে তোর সেজ ভাইকে বল্।

আমি বাবার কথামতো সেজ ভাইকে ডেকে বললাম বাবার আদেশ পালন করতে। যথাসময়ে মজলিশ সরদার এসে বাবার সঙ্গে দেখা করলো। বাবা তাকে মাছ চুরির ঘটনাটা বলে এ ব্যাপারে একটা নীরব তদন্ত করতে পরামর্শ দিলেন। কাউয়া পাড়া নামটা আমাদের পুকুরের লাগোয়া পশ্চিম দিকে কয়েকটি ঘরে শেখ পরিবারের বসবাস। এরা পরস্পর প্রায় প্রতিদিন এত ঝগড়া-ঝাঁটি করে যে, সারাক্ষণ তাদের এবং বিশেষ করে মহিলাদের উচ্চস্বরে কথা-কাটাকাটি ও গালিগালাজ শুনতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ কাকের মতোই কা-কা করতে থাকে। এজন্যই এ পরিবারগুলোর উপাধি হয়েছে কাইয়ে বা কাউয়া পাড়া। সেই পাড়ায় গিয়ে প্রধানত হেরণ পিরে, গোল্লা পিরে ও কানা ওয়াহাবের বাড়িতে অনুসন্ধান চালিয়ে সন্ধ্যার পর শালিশ বসানো হলো আমাদের বাড়িতে। বাবার বাম পাশের চেয়ারে উপবিষ্ট লাল মিঞা মামুজান, ডানদিকে চৌকিতে বসা বড় চাচাজান জনাব আব্দুল হক সরদার। অন্যান্য অনেকেই ছিল উপস্থিত।
সন্দেহভাজনদের মধ্যে হেরণ পিরে ও গোল্লা পিরেসহ তাদের মুরব্বি, তথা মোকাদ্দেছ শেখ (হেরণ পিরের পিতা) ও মতু শেখকেও (হেরণ পিরে ও গোল্লা পিরের চাচা) ডাকা হলো শালিশ সভায়।

হেরণ পিওে ও গোল্লা পিরেকে অভিযুক্ত করে শালিশ সভায় বাবা আমাদের পুকুরের মাছ চুরি যাওয়ার বিষয়টা বর্ণনা করে সবার কাছে এর বিচার চাইলেন। তখন বড় চাচা ও লাল মিঞা মামুজান জানতে চাইলেন-
এরাই যে প্রকৃত দোষী, তা প্রমাণ করার জন্য কোনো স্বাক্ষ্য-প্রমাণ আছে কী?

এ প্রশ্নের উত্তরে মজলিশ সরদার দাঁড়িয়ে একটা থলে থেকে কয়েকটা বড় বড় মাছের কাঁটা, বিশেষ করে কানকো, লেজ ও শিরদাড়ার কাঁটা দেখিয়ে বললেন-

  • এই যে, এগুলোই চাক্ষুস প্রমাণ। এগুলো কুড়ায়ে আনিছি পিরেগে বাড়ির কানাচ থেকে। দ্যাহেন আপনেরা, কাঁটাগুলান পুরনো না একদম তাজা! রাত্রি বেলা খাইয়ে ফেলাইছে। মাতবরদের কেউ কেউ কাঁটাগুলো একটু কাছে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। হেরণ পিরেরা প্রথম প্রথম একটু আমতা আমতা করে চুরির বিষয়টা অস্বীকার করার চেষ্টা করছিল অবশ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শালিশ মোতাবেক মাতব্বরা একমত হলেন যে, দারোগা সাহেবের পুকুরের মাছ চুরির সাথে অভিযুক্তরাই জড়িত। কারণ, সবাই জানতো যে হেরণ পিরেদের বাড়িতে ক্ষেপ জাল আছে। অতএব, পুকুরের লাগোয়া পাশের বাড়ি হওয়ায় এসময় ক্ষেপজাল/টানা জাল ফেলে মাছ ধরাটা খুবই সহজ ব্যাপার!

যাহোক, অনেক রকম কথাবার্তার পর শালিশ সভার সিদ্ধান্ত হলো, হেরণ পিরে ও গোল্লা পিরে জরিমানা স্বরূপ প্রত্যেকে ২৫.০০ টাকা করে জমা দেবে দু’মাসের মধ্যে। আর সবার সামনে এখন তারা একে একে নাকে খৎ দেবে এবং শপথ করবে যে, তারা ভবিষ্যতে আর এমন মাছ চুরির মত জঘন্য কাজ করবে না। কানা ওয়াহাবের বাড়ি থেকে মাছের কোনো কাঁটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া সে শালিস সভায় শপথ করে বলেছে যে, সে এ মাছ চুরির সাথে জড়িত ছিল না। সুতরাং শালিস সভা কানা ওয়াহাবকে মাছ চুরির অভিযোগ থেকে বেকসুর মাফ করলো।