মুহম্মদ শামসুল হক :
১১ এপ্রিল মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই যুগপৎ পবিত্র মাগফিরাত অধ্যায়ের বিদায় এবং জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে। আবার সারা দুনিয়ায় অগণিত রোজাদার মুসলমান মঙ্গলবার বাদ আসর থেকে পবিত্র শাওয়ালের চাঁদ দেখার পূর্ব পর্যন্ত একাধারে ৯-১০ দিনের জন্য বিভিন্ন মসজিদ, ইবাদতখানা কিংবা নিজ ঘরের নির্জন কোণে ইতিকাফ শুরু করেছেন। ইতিকাফকারীরা পায়খানা-প্রস্রাব, অজু-গোসল এবং খাওয়াদাওয়া ও অপরিহার্য নিদ্রা ছাড়া ঈদুল ফিতরের নামাজের আগ পর্যন্ত বাদবাকি সময় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাসবিহ তাহলিল, নামাজ-কালাম ও অন্যান্য ধরনের ইবাদতে মশগুল থাকবেন। ইতিকাফ বিশ্বনবীর (সা.) উম্মতদের জন্য ইসলামি শরিয়তে সুন্নাতে দায়েমি কেফায়া হিসেবে স্বীকৃত। এটি গ্রামবাসী বা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এক বা একাধিক ব্যক্তি পালন করলে বাদবাকিরা দায়মুক্ত হবেন। তবে কোনো বিশেষ এলাকার একজন মুসলমানও ইতিকাফ না করলে গোটা এলাকার সকল মুসলিম উম্মাহ গোনাহগার হবেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতি রমজান মাসেই শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং মহাপ্রয়াণের বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন।
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পবিত্র রমজানের ‘জাহান্নামের অগ্নি থেকে পরিত্রাণের’ অধ্যায়েই লুকিয়ে আছে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ আশীর্বাদপূর্ণ পবিত্র লাইলাতুল কদর বা অতীব মহিমান্বিত রজনী। ওই মর্যাদাসম্পন্ন বিশেষ রাতের ইবাদতকে সহস্র মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে পবিত্র কোরআনের সুরা আল কদরে মহান আল্লাহ স্বয়ং উচ্চারণ করেছেন। নিজ উম্মতগণকে রমজানের তৃতীয় ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে এই বিশেষ মহিমান্বিত রাতকে খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের দয়াল নবী মুহাম্মদ (সা.)।
সুরা আল কদর অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট : প্রকৃত প্রস্তাবে বিশ্বমানবের জীবনবিধান আল কোরআনের মাহাত্ম্য, গুরুত্ব এবং মর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা প্রদানই এই সুরা নাজিলের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই সুরার শানে নজুল প্রসঙ্গে ইবনে আবি হাতিমের রিওয়ায়াতে বর্ণিত আছে : একদা মহানবী (সা.) বনি ইসরাইলের হজরত আইয়ুব (আ.), জাকারিয়া (আ.), হিজকিল (আ.) এবং ইসা ইবনে নুহ (আ.) প্রসঙ্গে বললেন, তাঁরা একনাগাড়ে ৮০ বছর ধরে মহান আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। এক মুহূর্তের জন্যও তাঁরা বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর নাফরমানি করেননি। মহান আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন এই চারজন পুণ্যাত্মার কথা শুনে সাহাবিগণ বিস্মিত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী নবী-রাসুল এবং তাঁদের উম্মতগণ তুলনামূলকভাবে আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীগণের তুলনায় দীর্ঘ জীবন লাভ করতেন। তাই বহু বছর তারা একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ পেতেন। পক্ষান্তরে মহানবী (সা.) এবং তাঁর উম্মতগণের জাগতিক আয়ু অনেক কম। তাই মহানবী (সা.) এর উম্মতদের পক্ষে ইবাদত-বন্দেগি করে পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মাদের সমকক্ষতা অর্জন করা ছিল নিছক কল্পনাবিলাস। সাহাবিগণের এই আক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে তৎক্ষণাৎ ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাইল (আ.) মহানবীর (সা.) নিকট আগমন করলেন এবং সুসংবাদ দিলেন : আপনার উম্মত বনি ইসরাইলের উপরিল্লিখিত চার ব্যক্তির কথা শুনে অবাক হয়েছেন। মহান আল্লাহ এর চেয়েও উত্তম বস্তু আপনাদের দান করেছেন। এরপর তিনি সুরা কদর তেলাওয়াত করে শোনান। সুরাটির বঙ্গানুবাদ : পরম দয়ালু দাতা ও অপরিসীম করুণাময় আল্লাহর নামে। ১. নিশ্চয় আমি একে (কোরআনকে) নাজিল করেছি কদরের রাতে। ২. এবং আপনি কি জানেন, এই কদরের রাতটি কী? ৩. কদরের রাত সহস্র মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। ৪. এই রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ তাঁদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে সকল নির্দেশ নিয়ে নাজিল হন (ধরাধামে)। ৫. শান্তিই শান্তি, সে রাতের প্রভাত উদয় হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
পবিত্র কোরআন দয়াময় আল্লাহরই চিরন্তন ও শাশ্বত বাণী। পবিত্র শবে কদরে মহান আল্লাহ এটি নাজিল করেছেন। শবে কদরে পবিত্র কোরআন নাজিল করার অর্থ হচ্ছে, এই রাতে সম্পূর্ণ কোরআন একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, শবে কদরে সম্পূর্ণ কোরআন লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানের বাইতুল ইজজাহ নামক স্থানে নাজিল করা হয়েছিল। এরপর বিশ্বপ্রতিপালক মহান আল্লাহর নির্দেশে পরবর্তী ২৩ বছরে প্রয়োজন অনুসারে এবং বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যায়ক্রমে তা হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর নিকট অবতীর্ণ হয়। অতএব, কোরআন অবতীর্ণের রাত হিসেবে ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিমের জন্য পবিত্র লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কদরের রজনীতে জাগতিক প্রতিটি বিষয়, অর্থাৎ আগামী এক বছরের জন্য হায়াত-মওত-রিজিক বা জীবিকা-দৌলত ইত্যাদির বাস্তবসম্মত ও যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। শবে কদরের নির্দিষ্ট কোনো রাতের কথা বর্ণিত না হলেও পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের কোনো একটি বিজোড় রাতে তা অনুসন্ধানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে হাদিস শরিফে। আবার অনেক ইসলামি চিন্তাবিদের মতানুসারে রমজান মাসের ২৭তম রজনী বা ২৬ রোজার দিবাগত রাতই পবিত্র কদর রজনী। অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞের বর্ণনা অনুসারে সুরাটিতে লাইলাতুল কাদর শব্দটি তিনবার উচ্চারিত হয়েছে। আর লাইলাতুল কাদর লিখতে আরবি বর্ণমালার নয়টি হরফ লাগে। তাই তারা (৯ গুণ ৩ বা) ২৭তম রাতকেই পবিত্র লাইলাতুল কদর হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
স্মর্তব্য, লাইলাতুল কদরের ইবাদত এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি কদরের রাতে অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও ইমানসহকারে আল্লাহর নিকট থেকে সুফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন, তার পেছনের যাবতীয় গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পবিত্র কোরআন নাজিলের পটভূমিতেই লাইলাতুল কদর এত অপরিসীম মর্যাদা এবং মাহাত্ম্যের অধিকারী। তাই সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, মূল মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বিশ্বমানবের জন্য শাশ্বত জীবনবিধান পবিত্র কোরআনেরই। তাই যে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতি ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পবিত্র কোরআনকে ধারণ করবে, কোরআনের অনুশাসন মেনে জীবন চালনা করবে, সেই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতি অশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হবে।
আমরা অনেকেই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পবিত্র রমজানের গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো হেলায়-ফেলায় কাটিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া চাকরিজীবী হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই চাকরির মাসোহারার সঙ্গে বোনাসের প্রত্যাশা করি। এই বোনাসপ্রত্যাশী প্রত্যেক রোজাদারের উচিত হবে সামনের দিনগুলোর সঠিক ব্যবহার করা। ইতিকাফ করা যাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, তাদের পক্ষে উচিত হবে নিদেনপক্ষে শেষ ১০ দিনের এশা ও তারাবি জামাতের সঙ্গে আদায় করা। এ ছাড়া অন্য রাতে সম্ভব না হলেও নিদেনপক্ষে ২৭ রমজান রাতভর জেগে থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা। আর নিজেদের অতীত পাপের জন্য তওবা করে ভক্তিসহকারে মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও তাঁর অনুকম্পা ভিক্ষা করা। স্মর্তব্য, এক রমজান বা লাইলাতুল কদর থেকে আরেক রমজান ও লাইলাতুল কদরের ব্যবধান এক বছর। আমরা কেউই নিশ্চিত নই যে আগামী রমজান ও লাইলাতুল কদর পর্যন্ত বেঁচে থাকব। তাই একবারের কদর রাতকে নিজ নিজ জীবনের শেষ কদর রাত ধরে নিয়ে রাতভর যথাসাধ্য ইবাদত করা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উচিত।
জুমাতুল বিদা : ২৯ এপ্রিল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের জুমাতুল বিদা। এদিন জুমা শেষে এটি বিদায় নেবে কমপক্ষে এক বছরের জন্য। আর এক বছর পর জুমাতুল বিদার সালাত আদায় করা কার ভাগ্যে আছে, তা একমাত্র বিশ্বপ্রতিপালকই জানেন। কারণ নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই। যেকোনো মুহূর্তেই আমাদের পরপারের ডাক আসতে পারে। তাই কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করে হলেও এবারের জুমাতুল বিদার সালাত আদায় করার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। লাইলাতুল কদর ও জুমাতুল বিদা উপলক্ষে আমরা মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমত ভিক্ষা করছি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : স্বদেশে এবং প্রবাসে অনেক মুসলমান ভাইবোন প্রাত্যহিক ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল ইত্যাদির প্রতি গুরুত্বারোপ না করে শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ দিবসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করে থাকেন। তাদের উদ্দেশে বলতে হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ফরজ পরিত্যাগ করলে সারা জীবন নফল ইবাদত করলেও ফরজের দায়মুক্তি ঘটবে না। তাই বিশেষ বিশেষ দিবস থেকে বিশেষ পুণ্য হাসিল এবং আল্লাহর রহমত লাভ করতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রাত্যহিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সময়মতো আদায় করতে হবে। ধর্মীয় যাবতীয় বিধিবিধান যথাসম্ভব পালন এবং নিষেধাজ্ঞা বর্জন করতে হবে। হে বিশ্ব প্রতিপালক, দয়া করে তুমি আমাদের মাফ করে দাও। তোমার অতলস্পর্শী রহমতের সাগর থেকে আমাদের প্রতি যৎকিঞ্চিৎ রহমত বর্ষণ করো। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
১১ এপ্রিল ২০২৩