ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :
শীতের এক সকাল। সবে ইতনা উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। হঠাৎ দেখি আমাদের বড় ঘরের দক্ষিণ বারান্দায় বেশ কিছু লোকের আনাগোনা। ভাবলাম কোনো শালিশ-নালিশ হবে হয়তো। কিন্তু একটু উঁকি মেরে দেখি, ব্যাপারটা তা নয়! কারণ, স্কুলের সব জাঁদরেল মাস্টার মশাইরা বাবার বাম পাশের চেয়ারগুলোতে বসে রয়েছেন। সঙ্গে প্রধান শিক্ষক শ্রীযোগীন্দ্র চন্দ্র গাঙ্গুলী। অন্যান্যদের মদ্যে বাবু সতিশ চন্দ্র ঘোষ, বাবু অমূল্য কুমার বসু ও আরো কে কে যেনো সঙ্গে ছিলেন। মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তাঁরা সবাই বাচ্চা (এজেডএম আনোয়ারুল ইসলাম) ভাইয়ের ক্লাশ প্রমোশনের ব্যাপারে বাবার সাথে আলাপ-আলোচনা করতে এসেছেন।
বাবা বারবার একই কথা বলছেন
-আপনারা যে যাই বলুন, কিংবা যা মনে করুন, করতে পারেন। তবে আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড়! ওকে আরো এক বছর ঐ ক্লাশ এইটেই (অষ্টম শ্রেণিতে) পড়তে হবে।
প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য সব শিক্ষকই এক সুরে বলতে লাগলেন
-আনোয়ার আসলে একজন ভালো ছাত্র। একটু মনোযোগী হলেই দেখবেন দারোগা সাহেব ও অঙ্ক আর ইংরেজি কভার করে নিতে পারবে। সামান্য নম্বরের জন্য ও এ দু’বিষয়ে ফেল করেছে।
বাবা উত্তরে বললেন
-সবে ও শহরের স্কুল থেকে গ্রামের স্কুলে এসেছে। আর এই অষ্টম শ্রেণিতেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ভীত গড়তে হয়। ইংরেজি ও অঙ্কে কাঁচা থাকলে উপরে উঠে কিছুই ভালো করে শিখতে পারবে না।
বারান্দায় মাস্টার মশাইদের এসব কথা-বার্তার রেশ এদিক থেকে মা শুনছেন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপ চাপ। দেখি, বাচ্চা ভাইও এসে মাকে অনুনয়-বিনয় করছে বাবাকে একটু বোঝানোর জন্য। কান্নাকাটিও করেছিলেন বেশ কিছুটা। মা তাঁর শ্বাশত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে খুবই অনুচ্চ গলায় বাবাকে ঘরের ভিতরে ডেকে একটু অনুরোধও করেছিলেন বলে মনে পড়ে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মাস্টার মশাইদেরকে চা-নাস্তা খাইয়ে বাবা বিদায় দিলেন।
যাবার প্রাক্কালে হেডমাস্টার যোগীন্দ্র বাবু বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন
-আচ্ছা লোকতো আপনি দারোগা সাহেব! সব গার্জেন, সব বাপ-মাকেই দেখেছি ছেলেমেয়েদের প্রমোশনের জন্য আমাদেও কাছে এসে তদবির করতে, আর আপনি নিজে বাবা হয়ে ছেলেকে ডিমোশন করতে চাইছেন!
কিন্তু বাবার সেই একই উত্তর
-হ্যাঁ তাই! আমি ওর ডিমোশনই চাইছি। এবং আমি সবকিছু জেনেশুনে, ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি আনোয়ারের প্রমোশনের জন্য আর আপনারা আমার কাছে তদবির করতে আসবেন না।
সবাই যেনো অনেকটা আশাহত হয়েই বাড়ি থেকে চলে গেলেন। স্কুল, মাঠ-ঘাট এবং এমনকি ইতনা বাজারে পর্যন্ত এ নিয়ে অনেকেই নানা রকম সমালোচনা করতে লাগলো। কিন্তু বাবার এই যে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, এর সুফল ফলতেও বেশি দেরি হলো না। বাচ্চা ভাই পরের বছরই ক্লাশ ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন।
বাবা মাকে ডেকে বললেন
-দেখলে তো কুদুর মা? আমার সিদ্ধান্তের ফল কী হয়।
মা শুধু স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন। তবে এ আনন্দের রেশ খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কারণ, বাচ্চা ভাই দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে গ্রামের একজন হিন্দু ভদ্রলোক বাবার কাছে নালিশ ও বিচার চাইলেন। তার সোমত্ত মেয়েকে নানাভাবে জ্বালাতন করছে কতিপয় বখাটে ছেলে। আর এর মধ্যে নাকি আনোয়ার ভাইও সামিল রয়েছে! এ কথা শুনে বাবার মাথায় রাগ চড়ে গেলো। মুরিদ ভাই না অন্য কাকে যেনো পাঠালেন বাচ্চা ভাইকে ডেকে আনতে। নালিশের কথা জানতে পেরেই বাচ্চা ভাই মাঠের দিকে দৌঁড়ালেন। কিন্তু বাবার রাগ তখন চরমে। তিনি নিজে ছুটলেন বাচ্চা ভাইয়ের পিছু পিছু। সঙ্গের অন্যদেরকে নির্দেশ দিলেন
-যেখান থেকে যেভাবে পারিস তোরা ওকে ধরে নিয়ে আয়। আজ আমি ওই হারমাদাজাকে একটা উচিৎ শিক্ষা দেবো।
বাবা নির্দেশ অগ্রাহ্য করার সাহস তখন কারোই ছিলো না। অবশেষে বাচ্চা ভাইকে ধরে দু’হাত পিঠমোরা অবস্থায় আমাদের বাইরের উঠানের মেইয়ো খুঁটির সাথে পিঠমোড়া অবস্থায় দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। বাবা রাগে গরগর করতে করতে ঘরে ঢুকে কাঠের বাক্সের মধ্যে রাখা দো-নলা বন্দুকটি বের করলেন। তাতে গুলিও ভরলেন। এ সময় মা শুধু নীরবে কাঁদছেন, আর তাঁর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। ভাবছেন, না জানি আজ কি লঙ্কাকাণ্ডই না বাবা ঘটিয়ে বসেন!
ভাগ্যবশতঃ এ সময় বাবারই সমসাময়িক একজন পড়শি মোকাদ্দেছ শেখ (ওরফে মুকো) আমাদের আঙ্গিনাতে এসে পৌঁছান। বাবাকে চাচাজান বলে সম্বোধন করে ঘটনার আকস্মিকতা এবং অচিরেই কী হতে চলেছেÑ তা চিন্তা করে মুকো শেখ (আমরা মুকো ভাই বলে ডাকতাম) বাচ্চা ভাইয়ের হাতের বাঁধন দিলেন খুলে। বললেন
-চাচাজান বেরোনোর আগেই দৌড়ায়ে পালাও ভাই।
বাচ্চা ভাই ছাড়া পেয়ে বাড়ির উত্তর দিকে খেলার মাঠের উদ্দেশে ভোঁ দৌঁড় দিলেন। কিন্তু ততোক্ষণে বাবা তাঁর বন্দুকে গুলি ভরে বড় ঘরের দরজায় পৌঁছেছেন!
বাচ্চা ভাইকে উত্তর দিকে দৌড়ে পালাতে দেখতে পেয়ে বাবা তার দো-নলা বন্দুকটা হাতে নিয়েই বাচ্চা ভাইয়ের পিছে পিছে দৌড়াতে লাগলেন! কিন্তু বয়সের ব্যবধান দু’জনের দূরত্বকে বাড়িয়ে দিলো অনেকটা। শেষে এক পর্যায়ে এসে বাবা হাঁফিয়ে উঠলেন এবং দৌড়ানোটা থামালেন।
মুকো ভাই ও অন্য কিছু গ্রাম্য মাঝবয়সী লোক কাছে এসে বাবাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো নানা কথা বলে। বাবার রাগ কিছুটা প্রশমিত হতে বন্দুক হাতে বাড়ি ফিরলেন।
মা অধীর অপেক্ষায় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চিত্তে বড়ঘরের দক্ষিণ দিকের দরজায় অপেক্ষা করছিলেন। সবাইকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখে কিছুটা আশ্বস্তি বোধ করলেন।
মুকো ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন
-নেন চাচীজান। চাচাজানকে একটু ঠান্ডা পানি খাওয়ান।
মা আস্তে করে বাবার কাঁসার গ্লাসটিতে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলেন। আর একটা তালপাখা নিয়ে বাবাকে বাতাস করতে থাকলেন।
মুকো ভাই একটু মুচকি হেসে মাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন যে, কোনোরূপ অঘটন ঘটেনি!