ইমিগ্রেশনের কঠোরতায় লণ্ডভণ্ড অনেক সংসার

ঠিকানা রিপোর্ট: ইমিগ্রেশন ইস্যুতে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত কঠোর। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ইমিগ্র্যান্টবিরোধী আইন করছেন। ব্যাপাকভাবে ধরপকড় করা হচ্ছে অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের। এই অভিযান চলছে নিউইয়র্কসহ পুরো আমেরিকায়। প্রতিদিনই অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের ধরতে হানা দিচ্ছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোকজন। বাংলাদেশীসহ হাজার হাজার অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট আমেরিকার বিভিন্ন জেলখানায় রয়েছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির হামলায় অনেক বাংলাদেশীর সোনার সংসার তচনছ হয়ে গেছে। ৩০/৩৫ বছর ধরে আমেরিকায় থাকার পরও নির্দয়ভাবে তাদের আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। মায়ের কাছ থেকে কলিজার টুকরো সন্তানকে আলাদা করে দেয়া হচ্ছে, বাবার বুকফাটা আর্তনাদ এবং সন্তানদের আকুতিও হৃদয় স্পর্শ করছে না হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোকজনের। মায়ের আহাজারি এবং সন্তানের কান্নায় আকাশ ভারি হলেও বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে সাজানো সোনার সংসার। সন্তানের কাছ থেকে বাবাকে, বাবার কাছ থেকে সন্তানকে, স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে এবং স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে আলাদা করে দেয়া হচ্ছে। এখন একজন থাকেন আমেরিকায়, আরেকজন থাকেন বাংলাদেশে। আবার সন্তানরা থাকছেন আমেরিকায় আর বাবা- মা থাকছেন বাংলাদেশে।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশী কম্যুনিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ এবং নাট্যকর্মী শামীম মামুন লিটন। থাকতেন জ্যামাইকায়। ইমিগ্রেশনে তার সমস্যা ছিলো। কয়েক বছর আগে একদিন সকালে তাকে ধরে নিয়ে যায় হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোকজন। কয়েক মাস ডিটেনশন সেন্টারে ছিলেন। বিভিন্ন চেষ্টা ও তদবিরের পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ছেড়ে দেয়ার সময় তাকে ওয়ার্ক পারমিটও দেয়া হয়। কিন্তু শর্ত দেয়া হয় কয়েক মাস পর পর তাকে ফেডারেল প্লাজায় গিয়ে কোর্টে দেখা করতে হবে। ফিরে এসে আবার কাজে মনোযোগী হলেন এবং নিয়মিত হাজিরাও দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে আমেরিকায় থাকার স্বপ্নে বিয়ে করলেন বাংলাদেশী এক আমেরিকান সিটিজেনকে। সবার প্রত্যাশা ছিলো শামীম মামুন লিটনের সমস্যার সমাধান হয়েছে। কিন্তু না। সমস্যার সমাধান হয়নি। তাকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো। বিয়ের পর শামীম মামুন লিটনের স্ত্রী তার জন্য আবেদন করেন। গত কয়েক মাস আগে শামীম মামুন লিটন হাজিরা দিতে গেলে তাকে আটক করা হয় এবং বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে রয়েছেন। তার স্ত্রী বাংলাদেশ এবং আমেরিকায় আসা যাওয়া করছেন। ভাগ্য ভাল যে শামীম মামুন লিটনের কোন সন্তান ছিলো না। সন্তানকে বাবা- মা’র কাছ থেকেআলাদা করা হয়েছে এমন অনেকেই আছেন। আমেরিকায় কাঁদছে অসহায় সন্তানরা আর বাংলাদেশে কাঁদছেন অসহায় মা এবং বাবা।
এমনিই নির্দয় আচরণ করা হয়েছে নিউজার্সির সেলিনা সিকান্দারের সাথে। বাংলাদেশী সেলিনা সিকান্দার আমেরিকায় ২০ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন। সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। কিন্তু সুখ তার কপালে সইলো না। ২০ বছরের সংসার ফেলে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোকজন। গত ২৯ মার্চ রাতে তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়া হয়। এ রাতটি ছিল তার তার সস্তানদের জন্য এক বিষাদময় এবং অন্ধকারাছন্ন রাত। নিউজার্সি জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিউজার্সির রানেমেডে বসবাস করতেন সেলিনা সিকান্দার। তিন সন্তানকে ফেলে তাকে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে। বিদায়ের কয়েকটি ঘন্টা তার কাছে, তার সন্তানদের কাছে ছিল বিভিষীকার মত। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবটুকু কষ্ট তাদেরকে গ্রাস করেছে, সাজানো সংসার তচনছ হয়ে গেছে, পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার, মা এবং সন্তানদের বুকফাটা কান্নায় প্রকৃতিও যেন কাঁদছিলো। কিন্তু আমেরিকার ইমিগ্রেশন আইন মানবতাকে স্পর্শ করে নি, হৃদয় গলেনি হোমল্যান্ড সিকিউরিটির লোকজনের। এ দিন রাতেই আদরের সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেলিনা সিকান্দারকে উঠিয়ে দেয়া হয় বিমানে। তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে সাজেদা সিকান্দারের আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিলো, কান্নায় বিদায় জানালেন মাকে। যিনি ছিলেন তাদের ছায়া, আশা ভরসার একমাত্র আশ্রয়। সাজেদা জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্রী। এ কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছেন না। বাংলাদেশী এ পরিবারটি যেন তছনছ হয়ে গেছে এমন যন্ত্রণায়। সেলিনা সিকান্দারের অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা। ওই মুখপাত্র বলেছেন, সেলিনাকে অভিবাসন বিষয়ক বিচারক যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাকে বাংলাদেশে ফেরত যেতে হবে। ২০১০ সালের আদালতের সেই নির্দেশ নিয়ে আইনি লড়াই চলছিল বহুদিন। সেলিনা আশ্রয় চেয়ে বার বার আবেদন করেছেন। সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন আদালত।
উল্লেখ্য, সেলিনা সিকান্দারের পিতার নাম শামসুদ্দিন সিকান্দার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ১৯৯৩ সালে। এসে অন্য ১০ জনের মত তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন মাননীয় আদালত। আবার আবেদন করা হলেও ২০১০ সালে একই রায় আসে। ফলে সন্তানদের রেখে দেশে চলে যেতে বাধ্য হয় সেলিনা। সেলিনা এখন বাংলাদেশে আর সন্তানরা আমেরিকায়।
একইভাবে আরো এক বাংলাদেশী পরিবারের সুখ-শান্তি ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। তিনি থাকতেন নিউজার্সিতে। গত কয়েক সপ্তাহ আগে তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি এখন বাংলাদেশে আর দুই সন্তান এবং স্ত্রী নিউজার্সিতে রয়েছে। এই দুটো পরিবারের মধ্যে শঙ্কা অভিভাবকহীনভাবে তারা কীভাবে থাকবেন এবং সংসার চালাবেন? কারণ এক পরিবারের বাবা এবং অন্য পরিবারের মা ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী।
হিলসাইডে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত মুশরাত হক জীবনের সাথে যুদ্ধ করছেন। তাকে জ্যামাইকা হাসপাতাল থেকে ম্যানহাটানের একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি এখনও কোমায় রয়েছেন। গত ২৬ মার্চ এ ঘটনা ঘটে। এদিকে যে দিন মুশরাত হক দুর্ঘটনায় কবলিত হন সেইদিন তার বাবা মোজাম্মেল হক মোক্কারমের হাজিরা দেয়ার কথা ছিলো। হয়ত এই দুর্ঘটনা না ঘটলে মোজাম্মেল হক মোক্কারমকে তার পরিবার ছেড়ে বাংলাদেশে চলে যেতে হতো। কিন্তু মেয়ের দুর্ঘটনার কারণে তিনি এ যাত্রা রক্ষা পেলেন ৪ মাসের জন্য।
এদিকে ক্যান্সাসে গ্রেফতারকৃত বাংলাদেশী প্রফেসর সাঈদ আহমেদ জামিল ২ মাস জেলে থাকার পর গত ২৫ মার্চ ডিটেনশন সেন্টার থেকে আপাতত মুক্তি পেয়েছেন। প্রফেসর সাঈদ ১৯৮৭ সালে স্টুডেন্ট ভিসায় এই দেশে এসেছিলেন। ঐ ভিসার মেয়াদ বাড়িয়েই তিনি থাকছিলেন। সমস্যা শুরু হয় ২০০৬ সালে। তিনি তার ভিসার স্ট্যাটাস পরিবর্তন করতে গিয়েই সমস্যায় পড়েন। ভিসার স্ট্র্যাটাস পরিবর্তন করতে গিয়ে গ্যাপ তৈরি হয়। অবশেষে তাকে ২ মাস আগে গ্রেফতার করা হয়।