ইমিগ্রেশন নীতিতে জিরো টলারেন্স, হাজার হাজার শিশু বন্দী

ঠিকানা রিপোর্ট : বাবাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তারা তার বিন্দুবিসর্গও জানে না। জানে না মা- বাবার সঙ্গে তাদের আর কোনও দিন দেখা হবে কি না। সব আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে তারা কার্যত একা একাই বসে রয়েছে বন্দী শিবিরে। চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজার হাজার শিশু- কিশোর। যাদের কেউই একে অন্যকে চেনে না। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য আগে কেউ অবলোকন করেননি। আমেরিকায় ইমিগ্রেশন নিয়ে সমস্যা নতুন নয়। কিন্তু এত অমানবিক ঘটনা আগে ঘটেনি। ট্রাম্প প্রশাসন ইমিগ্রেশন নিয়ে জিরো টরারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। আমেরিকা থেকে এর আগেও অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এমন বহিষ্কারের ঘটনা এর আগে ঘটেনি। পিজা ডেলিভারি দিতে গিয়েও হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ফাঁদে পড়েছেন অনেকে। বাসা- বাড়ি এবং কর্মস্থল থেকেতো প্রতিনিয়তই ধরা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই জিরো টরারেন্স নীতির সমালোচনা করেছেন বর্তমান ফার্স্ট লেডি মেলেনিয়া, সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশ এবং মিশেল ওবামা। শিশুদের বন্দী ইস্যুতে আমেরিকার রাজনীতি এখন উত্তেজিত। প্রতিদিন আমেরিকাব্যাপী বিক্ষোভ হচ্ছে, হাউজ এবং সিনেটে বিতর্ক চলছে।
শিশুরা মেক্সিকোসহ মধ্য আমেরিকার দেশগুলি থেকে সীমান্ত পেরিয়ে তাদের মা- বাবার হাত ধরে আসতে গিয়েছিল আমেরিকায়। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির ফাঁদে আটকে যায় এই শিশুদের পরিবার। পরিবার- পরিজন থেকে শিশুদের আলাদা করে নিয়ে তাদের মা, বাবাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাস্টমস দফতর। শিশুদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে বাবা- মার কাছ থেকে। সেই থেকেই শিবিরে কার্যত অনাথ অবস্থায় দিন-রাত কাটাচ্ছে ওই শিশুরা।
এই শিশুদের জীবন-যন্ত্রণার কথা এত দিন বাইরে আসেনি, ট্রাম্প প্রশাসন এত দিন প্রচার মাধ্যমের নজর থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল বলে।
শিবিরে ঢুকে গোপনে বন্দী শিশুদের কথা রেকর্ড করে সাংবাদিক সংস্থা ‘প্রোপাবলিকা’। সেই গোপন রেকর্ডিং গত ১৮ জুন সোমবার প্রকাশ পেতেই মার্কিন সীমান্তে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। যাতে শরিক হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতাও। ওই রেকর্ডে (অডিও) শোনা যাচ্ছে, বন্দী শিশুদের আর্ত চিৎকার। কান্নাকাটি। স্প্যানিশ ভাষায় ‘মাম্মি, মাম্মি’, ‘ড্যাডি, ড্যাডি’ বলে কাঁদতে শোনা যাচ্ছে শিশুদের। ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে প্রায় আড়াই হাজার শিশু আটক রয়েছে আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলির সীমান্ত এলাকাগুলোতে। ‘প্রোপাবলিকা’র প্রকাশ করা রেকর্ডে ৪ থেকে ১০ বছর বয়সী ১০টি শিশুর কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছে। গত সপ্তাহেই সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকায় ঢোকার সময় যাদের মা, বাবাদের গ্রেফতার করা হয়। আর মা, বাবার থেকে ওই শিশুদের আলাদা করে নিয়ে অন্য একটি জায়গায় আটকে রাখা হয়।
শিবিরে শিশুদের কান্নাকাটি শুনে এক সীমান্ত রক্ষী বলেছেন, ‘‘যেন অর্কেস্ট্রা হচ্ছে। শুধু সেই অর্কেস্ট্রার কোনও পরিচালক নেই।’’
এল সালভাদরের একটি ৬ বছরের মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘যাওয়ার সময় মা বলে গিয়েছিল, খালা এসে আমাকে নিয়ে যাবে। খালা আসবে কবে?’’
খবরটি যিনি প্রথম করেছিলেন তিনি পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী সাংবাদিক। দৈনিক ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর মেক্সিকো সিটির পূর্বতন চিফ অফ ব্যুরো জিঙ্গার থম্পসন জানিয়েছেন, মানবাধিকার রক্ষা সংক্রান্ত বিশিষ্ট আইনজীবী জেনিফার হারবারি তাঁকে ওই অডিও দিয়েছেন।
অনুপ্রবেশকারীদের কাছ থেকে সন্তান ছিনিয়ে নেয়া বন্ধের দাবি
সীমান্ত পথে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতিমালা কার্যকরের পর থেকে হাজার হাজার অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান-সন্ততিকে বাবা-মা ও অভিভাবকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই আমনবিক ও বর্বরোচিত কর্মকা- বন্ধের জন্য রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলীয় রিপ্রেজেনটেটিভগণ জোর দাবি তুলেছেন।
কংগ্রেস সদস্যবর্গের কারাগার পরিদর্শন
ফাদার’স শাশ্বত আবেদনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সীমান্তে অপ্রাপ্তবয়স্ক স্বজনদের ছিনিয়ে নেয়া অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বাস্তব অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের জন্য নিউইয়র্ক এবং নিউজার্সির ডেমোক্রেটিক দলীয় ৭ জন কংগ্রেসম্যান নিউজার্সির এলিজাবেথস্থ এলিজাবেথ কন্ট্রাক্ট ডিটেনশন ফ্যাসিলিটি পরিদর্শন করেছেন। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ব্রুকলিনের ডেমোক্রেটিক দলীয় রিপ্রেজেনটেটিভ হাকীম জেফরিজের নেতৃত্বে ফাদার’স ডের উক্ত পরিদর্শনকালে রিপ্রেজেনটেটিভগণ কারাগারে অন্তরীণ অনুপ্রবেশকারীদের হৃদয়বিদারী হাহাকার-বার্তা গভীর মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেন।
পিতার কাছ থেকে কন্যাকে ছিনিয়ে নেয়ার করুণ কাহিনীর উদ্ধৃতি দিয়ে রিপ্রেজেনটেটিভ জেফরি উক্ত ঘটনাকে প্রশাসনের অশোভনীয় আচরণ হিসেবে অভিহিত করেন। জেফরি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এ ধরনের কর্মকা- চাইল্ড অ্যাবিউজই বটে! প্রতিনিধিগণ বলেন, স্বদেশের সহিংসতার হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার উদ্দেশ্যে সাউদার্ন সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় গ্রেপ্তার হওয়া ৫ জন অনুপ্রবেশকারীর সাথে তারা কথা বলেছেন। এদের ২ জনের কাছ থেকে তাদের কমবয়সী ছেলে-মেয়েদের এবং একজনের কাছ থেকে তার ৭ বছর বয়সী ভাইকে বলপূর্বক ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
নিউজার্সির ডেমোক্রেটিক দলীয় রিপ্রেজেনটেটিভ ফ্রাঙ্ক পালোনি বলেন, কংগ্রেস সদস্যগণকে কর্তৃপক্ষ সেলফোন, ক্যামেরা, কাগজ-কলম ইত্যাদি সাথে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়নি। এতদসত্ত্বেও একজন কোনোক্রমে একটি কলম সংগ্রহ করে আটকদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের করুণ কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন। অন্তরীণ এক বাবা বলেন, কোথায় তার সন্তানদের রাখা হয়েছে কর্তৃপক্ষ তা বলেনি। তবে তার বিশ্বাস সন্তানদের মিশিগানে রাখা হয়েছে। পালোনি বলেন, অপর এক পিতার বিশ্বাস যে তার দ্বাদশ বছর বয়সের কন্যাকে নিউইয়র্কের ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে। পালোনি বলেন, স্বদেশের নির্যাতন, নিগ্রহ ও সহিংসতার কবল থেকে নিজেদের নিষ্পাপ সন্তান-সন্ততির প্রাণ বাঁচাতে তারা সপরিজনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিল। এখন তাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে।
গত কয়েক মাস ধরে ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স (বিন্দুমাত্র ছাড় না দেয়ার শপথ) নীতিমালা গ্রহণ করেছে এবং বেআইনিভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় গ্রেপ্তার হওয়া প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা রুজুর ঘোষণা দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে গ্রেপ্তার হওয়াদের কাছে থেকে সন্তান-সন্ততিদের ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। অভিভাবকদের কাছ থেকে সন্তান-সন্ততিদের ছিনিয়ে নেয়াকে অমানবিক ও বর্বরোচিত ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে নিউইয়র্কের ডেমোক্রেটিক রিপ্রেজেনটেটিভ জেরল্ড নেডলার বলেন, ফাদার’স ডে উপলক্ষে আমরা নিজ নিজ সন্তানদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি। অথচ কারাবন্দীদের কাছ থেকে সন্তানদের ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে।
রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা, সাবেক ফার্স্টলেডি লরা বুশ, রক্ষণশীল সংবাদপত্র ও ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টাগণ ডেমোক্রেটদের সঙ্গে একজোট হয়ে সীমান্তে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার নিন্দা জানিয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ছয় সপ্তাহে প্রায় দু’হাজার শিশুকে তাদের মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তি দেখিয়েছে যে, এটি শুধু আইন প্রয়োগের স্বার্থে করা হয়েছে।
ট্রাম্প পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও তিনি শুধু বলেছেন যে, ডেমোক্রেটদের উচিত রিপাবলিকানদের সঙ্গে সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে একযোগে কাজ করা। টুইটারে তিনি লেখেন, পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত নয়। কেননা আপনি হেরে যেতে পারেন।
সাবেক মার্কিন ফার্স্টলেডি লরা বুশ ওয়াশিংটন পোস্টের এক অতিথি কলামে ট্রাম্পের জিরো টলারেন্স নীতিমালাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি-আমেরিকান শিবিরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি একটি সীমান্ত রাষ্ট্রে বাস করি। আমি আমাদের আন্তর্জাতিক সীমানা জোরদার ও সুরক্ষার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখি। কিন্তু জিরো টলারেন্স নীতি খুবই নিষ্ঠুর। এটা অনৈতিক। এটি আমার হৃদয়কে ভেঙে দিয়েছে। তিনি এজন্য প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে দায়ী করেছেন। তিনি লেখেন, যারা অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে তাদের ওপর এই জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর করা হচ্ছে। যেজন্য এই ধরনের পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার ঘটনা ঘটছে। শিশুরা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।
মাইনের রিপাবলিকান সিনেটর সুসান কলিন্স বিচ্ছিন্নকরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি সিবিএস চ্যানেলের ‘ফেইস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে বলেন, সেখানে কোনো প্রমাণ ছাড়াই আইনটির অপব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশাসন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শিশুদের তাদের মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা করে একটি বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করছে যদি আপনি শিশুদের সঙ্গে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেন তাহলে আপনার সন্তানরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। এতে করে শিশুরা ট্রমায় আক্রান্ত হচ্ছে। যারাই এর শিকার হচ্ছে তারা নিরাপরাধ। আমাদের এই দেশে বিষয়টি মূল্যবোধের বিপরীতমুখী অবস্থান।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন টুইটারে বলেন, এই শিশুরা সমঝোতা করার কোনো টুল নয়। তাদের পরিবারের সঙ্গে রাখা উচিত। সব মা-বাবাই তাদের সন্তানদের ভালোবাসেন। হিলারি ক্লিনটন বার্তাটি রিটুইট করেন ও পরে ইয়েস লেখেন। অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্স জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করার পর সরকার বিষয়টিকে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে শুরু করে। তাদের অপরাধী শামিল করে ফৌজদারি মামলার সম্মুখীন করা হয়। একইসঙ্গে মা-বাবাদের ফেডারেল হেফাজতে নেয়ার সময় তাদের সঙ্গে থাকা শিশুদের আলাদা করে ফেলা হয়।
এদিকে ট্রাম্পের কট্টর অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে টুইটারে সোচ্চার হয়েছেন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। এ টুইটার বার্তায় মেলানিয়া লিখেছেন, শিশুদের আলাদা করে দেয়া আমি ঘৃণা করি। গত ৬ সপ্তাহে আমেরিকার ‘জিরো টলারেন্স অভিবাসন নীতির কারণে দু’হাজারেরও বেশি নাবালক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাদের পিতা-মাতার কাছ থেকে। তাতে উদ্বিগ্ন মেলানিয়া ট্রাম্প।
১৭ জুন রোববার মেলানিয়ার মুখপাত্র স্টিফানি গ্রিজহ্যাম একটি বিবৃতিতে বলেন, নাবালকরা তাদের পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এটি মেলানিয়ার একেবারে পছন্দ নয়। তিনি বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি অভিবাসন প্রক্রিয়ার সফল সংস্কার চান।
মেলানিয়ার মুখপাত্র আরো বলছেন, ট্রাম্প-পতœী পরিবার-বিচ্ছিন্ন শিশুদের বেশ কয়েকটি ছবি দেখেছেন। সীমান্তে আশ্রয় প্রার্থী অভিবাসীদের থেকে সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করার ঘটনাটি ওর কাছে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। তবে অভিবাসন নীতি নিয়ে দু’পক্ষই যাতে আলোচনায় বসেন, এই নীতি সংস্কার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন এমনটাও চান মেলানিয়া।
শুধু ডেমোক্রেটরাই নয়, কতিপয় সংস্কারপন্থী রিপাবলিকানও ট্রাম্পের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’র বিরোধী। অভিবাসন প্রত্যাশীদের সন্তানদের তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন না করতে ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। ১৬ জুন শনিবার এ নীতি নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য চেয়ে হোয়াইট হাউসকে চিঠি লিখেছেন সিনেটর সুসান কলিনস ও জেফ ফ্লেক।
১৭ জুন রোববার সিবিএস-এর ফেস দ্য নেশন অনুষ্ঠানে কলিন্স বলেন, ‘এসব শিশুকে তাদের মা-বাবা থেকে আলাদা করাটা আমাদের আমেরিকান মূল্যবোধের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
সিনেটর টেড ক্রুজের কম্প্রিহেন্সিভ ইমার্জেন্সি লেজিসলেশন
আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কাছ থেকে বলপ্রয়োগে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান-সন্ততিদের অহেতুক ছিনিয়ে নেয়ার অমানবিক নীতিমালার ইতি ঘটানোর লক্ষ্যে টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর কম্প্রিহেন্সিভ ইমার্জেন্সি লেজিসলেশনের (ব্যাপক জরুরি আইনের) পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।
সমস্যাটির ট্রাম্প আহূত কংগ্রেশনাল সমাধানের পটভূমিতে সিনেটর ক্রুজ পরিকল্পিত বিলটিতে ইমিগ্রেশন জাজের সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৭৫০ এ উন্নীত করা এবং ভয়াবহ ক্রিমিনাল (ফৌজদারি) আচরণ কিংবা বাচ্চা-কাচ্চার ক্ষতির ঝুঁকি না থাকলে বাধ্যতামূলকভাবে বেআইনি পরিবারের সদস্যদের একত্রে বসবাসের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও নতুন আইনে ইমিগ্র্যান্ট পরিবারগুলোর জন্য নতুন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা এবং ১৪ দিনের মধ্যে অ্যাসাইলাম দাবির সমাধান দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ক্রুজ বলেন, মাতা-পিতার কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেয়া শিশু-কিশোরদের ক্রন্দন ও আহাজারির ছবি পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় থেকে ও খবর পড়ে আমেরিকানরা অতিমাত্রায় শঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত। তবে ক্রুজ উল্লেখ করেন যে, তার ডেমোক্রেটিক শরিকদারগণ ইস্যুটিকে ভুলপথে পরিচালিত করছে। তিনি বলেন, কংগ্রেশনাল ডেমক্রেটদের দাবি অনুযায়ী বেআইনি অভিবাসীদের গ্রেপ্তার করা ও ছেড়ে দেয়ার ভ্রান্ত নীতিমালার মধ্য দিয়ে সমস্যার আদৌ সমাধান হবে না। তিনি বলেন, আমাদের স্তূপাকারে জমে থাকা ইমিগ্রেশন মামলার সুরাহা করতে হবে, দ্রুত প্রসেসিং সম্পন্নের জন্য আইনগত জটিলতা দূর করতে হবে এবং জরিরু ভিত্তিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী মামলার সমাধান করতে হবে। তিনি আরও বলেন, মামলা-মোকদ্দমার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সন্তান-সন্ততিদের পিতা-মাতার সাথেই বসবাসের সুযোগ দিতে হবে।
এদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক দলীয় সিনেটর ডায়ানে ফিনস্টিন উত্থাপিত- দ্য কিপ ফ্যামিলিজ টুগেদার অ্যাক্টের (পরিবারের সদস্যদের একত্রে রাখুন) আইনের প্রতি ৪৯ জন ডেমোক্রেটিক সিনেটর সমর্থন জানিয়েছেন বলে ২০ জুন জানা গেছে।
এটর্নী জেনারেল সেসনসের বিরুদ্ধে গীর্জার যাজকদের অভিযোগ
এটর্নী জেনারেল জেফ সেসনসের ইমিগ্রেশন বিষয়ক জিরো টলারেন্স (শূন্যতম সহিষ্ণুতা) নীতিমালার ফলে আমেরিকান-মেক্সিকান সীমান্তে ২ সহ¯্রাধিক কিশোর-কিশোরীকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী পিতা-মাতা ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে বলপ্রয়োগে ছিনিয়ে নেয়ায় ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চের ৬ শতাধিক যাজক এবং লেই মেম্বারের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি অভিযোগপত্র সমগোত্রীয় মেম্বার সেসনসের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে।
২০ জুন চার্চের পক্ষ থেকে রুজুকৃত অভিযোগপত্রে সেসনসের বিরুদ্ধে চাইল্ড অ্যাবিউজ, অনৈতিকতা, বর্ণবৈষম্য এবং সেসনস প্রণিত নীতিমালার সপক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে রোমান থার্টীনের উদ্ধৃতি প্রদানসহ বুক অব ডিসিপ্লিন আখ্যার অসংখ্য লঙ্ঘনের দায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনা হয়েছে। ৭০ লক্ষাধিক সদস্যবিশিষ্ট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় ডিনোমিনেশন দ্য ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চের যাজক এবং লেই সদস্যগণ আরও অভিযোগ করেন যে পরিবারের সদস্যবর্গকে বিচ্ছিন্নকরণ নীতিমালা ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চের স্ট্যান্ডার্ডের ঘোর পরিপন্থী। অভিযোগপত্রে স্বাক্ষরকারীগণ আরও বলেন, সেসনসের ভয়ানক সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা, সানডে স্কুল শিক্ষক হিসেবে তার ভূমিকা এবং তার কর্মকান্ডের মারাত্মক ও অব্যাহত ফলাফলের কারণেই তারা সেসনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি তুলেছেন।
ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চের সদস্য হিসেবে স্বাক্ষরকারীগণ গভীরভাবে প্রত্যাশা করেন যে চার্চের দীর্ঘকালীন সদস্য হিসেবে সেসনস পরিবারের সদস্যবর্গের পুনর্মিলনেপ উদ্যোগ নিবেন, তার ক্ষতিকারক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবেন এবং বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসী বিশেষত শিশু এবং পরিবারগুলোর ক্ষতি পূরণে ভূমিকা রাখবেন। বিচার বিভাগের মহিলা মুখপাত্র সারাহ ইসগুর ফ্লোরস সেসনসের বিরুদ্ধে চার্চের অভিযোগপত্রের ব্যাপারে সরাসরি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
১৫ জুন পেনসিলভেনিয়ার স্ক্রানটস্থ ল্যাকওয়ানা কলেজ পুলিশ একাডেমীতে ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দান করেন। ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চের শত শত সহগামী সদস্য এ সময় তার বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন পরিবারের সদস্যদের বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ তোলেন। উল্লেখ্য, মে মাসে সেসনস বলেছিলেন, নির্যাতনের ভয়ে দেশত্যাগী হয়ে কিংবা ছেলেমেয়েসহ অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখলে তাদের ১০০% কেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য জাস্টিস এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এপ্রিল এবং মে মাসে সীমান্ত অতিক্রমকারী ২ সহ¯্রাধিক ছেলেমেয়েকে স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে বলপ্রয়োগে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার নিজের কঠোর অভিবাসন নীতিমালার সপক্ষে সেসনস বাইবেলের একটি অধ্যায়ের উদ্ধৃতি দেয়ায় তা ব্যাপক নিন্দা কুড়িয়েছে। আরও জানা যায়, ১৮ জুন টেক্সাসের টরনিলো সীমান্তে অভিভাবকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কিশোর-কিশোরীদের তাঁবুতে রাখা হয়েছে। এদিকে ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে লেইপার্সনের বিরুদ্ধে চার্চের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলার ঘটনা একান্তই বিরল।
ড্রিমারদের সুরক্ষায় দু’টি বিল
যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ ‘ড্রিমারদের’ সুরক্ষার জন্য আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে দুটি বিল আনতে যাচ্ছেন স্পিকার পল রায়ান। শৈশবে ও কৈশোরে কিংবা পঞ্চদশ জন্মবার্ষিকীর পূর্বে বাবা-মায়ের সঙ্গে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারাদেশ স্থগিত (ডেফারড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভাল) এবং কাজের অনুমতি দিতে ‘ড্রিমার’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল ওবামা প্রশাসন। এর আওতায় কয়েক লাখ অবৈধ অভিবাসীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো থেকে বিরত ছিল হোয়াইট হাউস। তাদের যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এ কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস, পড়াশোনা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পান প্রায় ৭ লাখ তরুণ। গত সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটি সমাপ্তির ঘোষণা দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। এরপর আদালতের নির্দেশে সরকারের ঘোষণা স্থগিত হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে মামলা লড়ে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। পল রায়ানের মুখপাত্র আসলি স্ট্রং বলেন, এই উদ্যোগ সীমান্ত নিরাপত্তা ও অভিবাসন সমস্যার সমাধান করবে। বিষয়গুলো নিয়ে মধ্যপন্থী ও রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের মধ্যে বিরোধ চলছে। স্ট্রং বিল দুটির বিস্তারিত কিছু জানাননি। আর রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত হাউসে বিলগুলো পর্যাপ্ত সমর্থন পাবে কিনা সে ব্যাপারেও তিনি কিছু বলেননি। রিপাবলিকানদের চরম ডানপন্থী গ্রুপের নেতা মার্ক মিয়াদোস ১৯ জুন মঙ্গলবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, এই বিলগুলোর একটি ড্রিমারদের সাময়িক সুরক্ষা দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন যে উদ্যোগটিকে কিছু রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা সমর্থন করেছিল তাকেই আরও উন্নত করার চেষ্টা করেছেন হাউস জুডিসিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান বব গুডলেট। ওই বিলে বৈধ অভিবাসনের ওপর নতুন করে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের পাশাপাশি সহায়ক সীমান্ত নিরপত্তাও জোরদার করার কথা বলা হয়েছে।