
এস এম মোজাম্মেল হক :
আহলান সাহলান মাহে রামাদান। পবিত্র রমজান অনাহার ত্যাগ ও সংযম সাধনার মাস। এ মাসের সাধনা বাকি ১১ মাস সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। এ শিক্ষার অনুশীলন মুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক সবার জন্য অবশ্যপালনীয় হলেও স্বাস্থ্যগত, মুসাফির ও অন্যান্য নানা বাস্তব ও দুরূহ সমস্যার কারণে সবার পক্ষে পালন করা সম্ভব হয় না। তবে বিনা কারণেও অনেক মুসলিম রমজান পালন থেকে বিরত থাকেন। যারা বিনা কারণে রমজান পরিত্যাগ করেন, তারা অবশ্য নিজেদের সুবিধামতো অনেক অজুহাত দাঁড় করাতে কসুর করেন না। সবচেয়ে বড় কথা হলো তারা মনে করেন, এটি আল্লাহর তরফ থেকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি বিধান। এটি পালনে তাদের কোনো ফায়দা নেই বরং আল্লাহ তাঁর প্রতি আনুগত্যের প্রমাণস্বরূপ এর বিধান করেছেন। অথচ পৃথিবীতে বান্দার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে এমন কোনো বিধান প্রবর্তন করা হয়নি, যার মধ্যে বান্দার কল্যাণ নিহিত নেই। যার প্রমাণ আধুনিক বিজ্ঞানের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করতে পারছে।
কোরআনের মাধ্যমে আল্লাহ মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ বিধান প্রবর্তন করেছেন, যা বিজ্ঞানেরও উৎস। দিন যত যাচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে তার প্রমাণ মিলছে। তাই বিজ্ঞানের যত অগ্রগতি হচ্ছে, কোরআনের শাশ্বত মর্মবাণীর স্পষ্টতা তত বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
রমজান যে শুধু ধর্মপালনের জন্যই প্রবর্তিত হয়েছে এমন নয়। রমজানে অনাহারে থেকে সংযম পালনের যে স্বাস্থ্যগত উপকারিতা, সেটিও প্রবিধানযোগ্য। না খেয়ে থাকার বিষয়টি বিভিন্ন ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও ধর্মে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিপ্লবীরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় অনশন। হিন্দু বা বৌদ্ধধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বা পূজা-পার্বণে না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় উপবাস। খ্রিষ্টানরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় ফাস্টিং। মুসলিমরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় সিয়াম। আর মেডিকেল সায়েন্সে উপবাস করলে তাকে বলা হয় ‘অটোফেজি’। নোবেল বিজয়ী জাপানি গবেষকের একটি গবেষণার সারসংক্ষেপে তা উঠে এসেছে। নিচে তা তুলে ধরা হলো :
‘মেডিকেল সায়েন্স অটোফেজি’র সঙ্গে পরিচিতি খুব বেশি দিনের নয়। ২০১৬ সালে নোবেল কমিটি কর্তৃক জাপানের ডাক্তার ‘ওশিনরি ওসুমি’ অটোফেজি আবিষ্কারের জন্য পুরস্কৃত হন। Autophagy শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ। Auto অর্থ নিজে নিজে এবং Phagy অর্থ খাওয়া বা এক অর্থে ধ্বংসও বলা চলে। সুতরাং অটোফেজি মানে নিজেই নিজেকে খাওয়া বা আত্মধ্বংস। মেডিকেল সায়েন্স নিজের মাংস নিজে খেতে বলছে না। যেটা বলতে চাইছে, সেটা হলো শরীরের কোষগুলো বাইরে থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন মেডিকেল সায়েন্সর ভাষায় তাকেই অটোফেজি বলা হয়। সোজা কথায়, মানুষের ঘরে বা বাইরে যেমন ডাস্টবিন থাকে অথবা কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে। সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায়। শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগ উৎপন্ন করে। ক্যানসার বা ডায়াবেটিসের মতো অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় এখান থেকেই। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর অলস হয়ে বসে থাকে না। তাই প্রতিটি কোষ তার ভেতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে দেয়, কোষগুলোর আমাদের মতো আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে। মেডিকেল সায়েন্সে এই পদ্ধতিকেই বলা হয় অটোফেজি। এই জিনিসটা আবিষ্কার করেই জাপানের ওশিনরি ওসুমি (Yoshinori Ohsumi) ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান। তাই মাঝে মাঝে উপবাস করলে পুণ্য অর্জনের বিষয়টি বিভিন্ন ধর্মমতে ভিন্নতর হলেও এতে শরীর যে ঠিক থাকে, সেটা প্রমাণিত।
বছরের পবিত্রতম এবং শ্রেষ্ঠতম মাস ‘মাহে রমজান’ আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। অল্প কদিন পরই বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এই মহান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করবেন। মুসলমানদের আত্মশুদ্ধিলাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে মাহে রমজান। মহান আল্লাহ এই মাসে তার পবিত্র কালাম ‘কোরআনুল কারিম’ অবতীর্ণ করার মাধ্যমে এ মাসকে মহিমান্বিত এবং বরকতময় করেছেন। এ মাসে তিনি অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে দেন। এ মাসেই তিনি শয়তানকে বন্দী করে রাখেন। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং জান্নাত ও আকাশের দরজাগুলো খুলে দেন। প্রতিদিন অগণিত জাহান্নামিকে মুক্তি দেন। সুতরাং মুসলিমদের কাছে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম মাত্রই এ মাসের বরকত এবং পুণ্য লাভের জন্য সচেষ্ট থাকেন। এ বরকতময় মাসটি যেহেতু আমাদের একেবারেই কাছে, তাই এ মাস আসার আগেই নিজেদের এ মাসের ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করে নেওয়া প্রয়োজন। ভালো কিছু লাভের জন্য যেমন ভালো প্রস্তুতি এবং পূর্ব পরিকল্পনার প্রয়োজন, রমজানের উপকারিতা বা ফজিলত লাভের জন্যও তেমনি পূর্বপ্রস্তুতি আবশ্যক। কিন্তু এ প্রস্তুতি কেমন হওয়া দরকার, সে সম্বন্ধে আমাদের জানা উচিত।
রমজান আসার আগে অনেকেই ভালো ভালো খাবার খেয়ে নিতে চান এই ভেবে যে, রমজানে তো মুখে তালা লাগাতে হবে, তাই এখন ভালোভাবে খেয়ে নেওয়া দরকার! এ ধরনের চিন্তা প্রকৃত মুমিনদের হতে পারে না। তারা রমজানকে কষ্টের মাস মনে করেন না, বরং এ মাস তাদের আনন্দের কারণ। তাই তাদের প্রস্তুতিও বেশি করে খেয়ে নেওয়া নয়, বরং এ মাস আসার আগেই বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করার মাধ্যমেই তারা এ মাসের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। রমজানের প্রস্তুতিস্বরূপ আমরা যে কাজগুলো করতে পারি, তার কিছু নিম্নরূপ :
১. দোয়া বা প্রার্থনা : রমজান আসার আগে রমজান পর্যন্ত হায়াত বৃদ্ধি ও রমজানের রোজাগুলো সুস্থতার সঙ্গে পালনে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করে বেশি বেশি প্রার্থনা করা উচিত।
২. নফল সিয়াম পালন : হঠাৎ কোনো কাজ করতে গেলে কষ্টকর মনে হয়। তাই রমজানের ফরজ সিয়াম পালনে নিজের দেহ ও মনকে প্রস্তুত করার জন্য শাবান মাসে বেশি বেশি নফল সিয়াম পালন করা উচিত। রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর শাবান মাসেই বেশি সিয়াম পালন করতেন। কোনো কোনো হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি এ মাস পুরোই সিয়াম পালনে অতিবাহিত করতেন।
৩. কোরআন শিক্ষা : রমজান কোরআন নাজিলের মাস। রাসুল (সা.) এ মাসে অধিক পরিমাণ কোরআন তিলাওয়াত করতেন। হাদিসে এসেছে, এ মাসে প্রতিদিন জিবরাইল (আ.) রাসুলের কাছে আগমন করতেন এবং রাসুল তাঁকে কোরআন শোনাতেন। তাই এই মাসে পবিত্র কোরআন অন্ততপক্ষে একবার খতম করার নিয়ত রাখা উচিত।
৪. রোজার মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা করা : এটা অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, রমজানের আগমনের আগেই রোজার মাসয়ালাগুলো জেনে নিতে হবে, পরিবারের লোকদেরও তা শিক্ষা দিতে হবে।
৫. হালাল জীবিকা : ইবাদত কবুল হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে হালাল জীবিকা অন্বেষণ। রমজানের সাহ্্রি ও ইফতারি এ দুটি কাজও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আমাদের সাহ্্রি ও ইফতারি যেন কিছুতেই হারাম উপার্জন থেকে না হয়। রমজানের আগেই হালাল রিজিক অন্বেষণে সচেষ্ট হতে হবে।
৬. পাপ কাজ পরিত্যাগ : রমজান আসার আগেই রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষার্থে যাবতীয় পাপ কাজ তথা গিবত, পরনিন্দা, হিংসা, বিদ্বেষ, চোগলখুরি, অহংকার ও কৃপণতার মতো গর্হিত কাজগুলো অবশ্যই পরিত্যাগ করে সঠিকভাবে সিয়াম সাধনার জন্য নিজেদের শারীরিক ও মানসিকভাবে তৈরি করে নিতে হবে। পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী, সহকর্মী সবার নিকট রমজানের আগমনবার্তা পৌঁছে দিয়ে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের রমজান পর্যন্ত হায়াত বাড়িয়ে দিন এবং রমজানের রোজাগুলো যথাযথভাবে পালন করার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক।