খায়রুল আনাম
ঈদুল -ফিতর উদযাপিত হয় আরবী রমজান মাসের পরের মাস, শওয়ালের প্রথম দিনে। ঈদুল ফিতর বিশ্বের তাবৎ মুসলমানদের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষ খুশির দিন। আনন্দ পালনকে মর্যাদিা এত বেশ দেয়া হয়েছে যে ঐদিন রোজা রাখা হারাম। আসলে রোজাটা ঠিক “উপবাস” বা “লেন্ট” পালন করা নয়। রোজাকে প্রকৃত কৃচ্ছ্র সাধনা বলা হয় এই কারণে যে, এ সময় মুসলমানরা সংযমের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়। তারা জাগতিক সব সুখকর ও আরামদায়ক অভ্যাসের সংযম, অত্যাচার, অনাচার, কুআচার, ব্যভিচার ও মিথ্যাচার থেকে নিবৃত্ত থাকার অঙ্গীকার নেয়। লোভ, লালসা, হিংসা, দ্বন্দ্ব, কাম প্রবৃত্তি থেকে নিবৃত থাকার মহড়া দেয়। ব্যাড হ্যাবিট থেকে এই গুড হ্যাবিটে উত্তরণের মহড়ায় কে কতটা ফল পায় সেটা নির্ভর করে কে কতটা এতে দিতে পেরেছে। অনেকটা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার মতো, যেমন প্রস্তুতি, তেমন ফল, লেটার পাওয়া থেকে ফেল মারা পর্যন্ত। আমার চেনা একজন ক্যাফিন অ্যাডিক্ট ছিল। দিনে চার পাঁচবার কড়া কফি ও ২ লিটারের বড় এক বোতল ডায়েট কোক খেত। একমাস রোজা করার ফলে ঐ বদভ্যাস থেকে সে মুক্তি পেয়েছে। একজন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় ডিনারের পর পরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এক মাস ধরে তারাবী পড়ার পর তার সে অবস্থাটা গেছে। পরিচিতের অনেকেই এখন সব কিছু কেবল নিজের জন্য আগলে না রেখে ধর্মীয় ও সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দান ধ্যান করা শুরু করেছে।
রোজা রাখাকে বাহ্যিক দিক থেকে অনেকে দেখতে পায় মুসলমানরা ভোর রাত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিরম্বু উপবাস করে। অর্থাৎ দিবাভাগে কোন ধরনের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেনা, তা সে মরুভূমিতে রাস্তা বানানো শ্রমিক হোক এবং সেটা জুন-জুলাই মাসের দীর্ঘ ও দুঃসহ গরমের দিন হোক। আমরা দেখেছি একসময়ের বাস্কেটবলের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় (মোস্ট ভ্যাল্যুয়েবল প্লেয়ার বা এম, ভি, পি), হিউস্টন রকেটের হাকিম ওলাজুয়ান (নাইজেরিয়ান) রোজা রাখা অবস্থায় বাস্কেট বল গেম খেলত। ঠিক ইফতারের সময় মিনিট পাঁচ সাতেকের ব্রেক নিয়ে রোজা ভেঙ্গে আবার মাঠে নেমে পড়ত। আর ঐ শরীর নিয়ে দলকে জিতিয়ে নিয়ে চলত। “ওয়ার্ল্ড কাপ” গেমেও দেখা গেল মুসলমান খেলোয়াড়রা রোজা রেখেই এত চ্যালেঞ্জিং ম্যাচ খেলছে। “লেন্ট” বা “উপবাস” জাতীয় ব্যাপার প্রকারন্তরে প্রায় সব ধর্মেই আছে এবং কৃচ্ছ্রের পরিমাপের স্তরেরও ভিন্নতা আছে। কিন্তু পানিও চলবে না, এমন উপবাস বিরল। আর টানা একমাস ধরে লাগাতার সীয়াম, উপবাস বা ফাস্টিং আর কোন ধর্মেই নেই। আরো বিশেষত্ব হলো, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ধরে রোজা করতে হয়। যেমন এ বছর, ২০১৮ সালে নরওয়ে বা আইসল্যান্ডে রোজা প্রায় ২২ ঘণ্টার মতো। আর একটা বিশেষ তফাত হল, কামজাতীয় প্রলুব্ধির দৃষ্টিতে অন্য মহিলার দিকে তাকানো তো দূরের কথা, রোজা থাকা কালীন সেটা স্বামী স্ত্রীর জন্যও মানা। সঙ্গম তো হনুজ দূর অস্ত। রোজা আছে বলে দিনের বেলা নিজের স্ত্রীকে চুমুও চলবে না- এটা চিন্তা করাও পশ্চিমাদের চোখে আশ্চর্য ব্যাপার। তাই ইসলামী “ফাস্টিং” প্রসঙ্গে তাদের সকল বর্ণনায় ও লেখনীতে “নো সেক্স” কথাটা উল্লেখ করতে ভুল করে না।
ঈদুল ফিতর: বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঈদুল ফিতর নিয়ে দু’ধরনের মতামত আছে। এক দল মনে করেন ঈদুল ফিতরই মুসলমান ধর্মের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান। কারণ এটা অনেক কষ্ট করে পাওয়া দিন। সেজন্য সব কিছুতেই বিশেষ আয়োজন। হরেক কিসিমের খাওয়া দাওয়া, চাঁদ দেখার উত্তেজনা, ক্রিসমাস, দুর্গাপূজা বা দেওয়ালী উৎসব পালনের মতো নতুন নতুন ডিজাইনের সাজ পোষাক, পত্র পত্রিকায় বিশেষ ঈদ সংখ্যা, টিভি, নাটক, সিনেমা, গানের নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি ও পরিবেশনা। ঈদের আগে, রোজার মাসে অনেক মুসলিম প্রধান দেশে অফিস আদালতের সময় পুনর্নিধারিত করা হয় বা ঢিমে তেতালায় চলে। সারা বছর ধরে দান ধ্যান করলেও ঈদের দিন বাধ্যতামূলক দান, “ফিৎরা” দিতে হয়। ঈদের নামাজের পর পরস্পর কোলাকুলি, বাড়িতে বাড়িতে কুশল বিনিময় করতে যাওয়া, ভুরি ভোজন, নানা ধরনের মিষ্টান্ন বিতরণ ও বাচ্ছাদেরকে “ইদী” বা ইদের খুশিতে অল্প টাকা পয়সা উপহার দেওয়া। সরকার ও বেসরকারি এত আয়োজন দেখে মনে হয় যে, এটাই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অথচ, মুসলমানদের এক অংশের কাছে ঈদুল ফিতর ছোট (লেসার) ঈদ আর ঈদুল আজহা বড় (গ্রেটার) ঈদ।
ঈদুল ফিতর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আঞ্চলিক নামে পরিচিত। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে একে হারি লেবারান, হারি রায়া বুকা পুয়াসা; ফিলিপাইনে পাগতাতাপস নং পাগ-আইউনো; সুদানে বোরোবান সিয়াম, তুরস্কে রামাজান বায়রামী, আযারবাইজানে উরুকলুক বায়রামী, কিরগীস্তানে অরোযো মেরাম, পশতুতে কোচনে আখতার, পার্শী ভাষায় ঈদ-এ-সায়ীদ-এ-ফিতর, উর্দুতে ছোটী ঈদ ও মিঠী ঈদ, বাংলায় রোজার ঈদ, বসনিয়ায় ও ক্রোয়েশিয়ায় রামাযানাস্কী বায়রাম, আলবেনিয়ায় বায়রাম, কুর্দিশ ভাষায় ছেয়না রেমেযানে, স্পেনে ফিয়েস্তা দে লা রুপ্তুরা দেল আইউনো, সোমালীতে সিইদ ইয়ারে, ইথিওপিয়ায় ঈদ-আল-ফাতের, ডাচ ভাষায় সুইকারফিস্ট ও পর্তুগীজে সেলেব্রেসেও দু ফিম দ জেজুম ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মতই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঈদুল ফিতর কিছুটা বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়। কিছুটা তাই তফাৎ থাকলেও মুল ইদ উদযাপনের ধারাটি পৃথিবীর প্রায় সব দেশে অনেকটা একই রকম।
মুসলমান ধর্মীয় নেতাদের ধারণা, ঈদুল ফিতর এমন একটি বিশেষ তাৎপর্যময় দিন যার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের দিনের তুলনা হয়না। দিনটি উপমাহীন কেন বোঝাতে তাঁরা নিচের যুক্তিগুলো পেশ করেনঃ
১) এই দিনটি জাস্ট এসে পড়ে না, আসে ইন্ডিভিজুয়াল অ্যাচিভমেন্টের পর। একমাস ধরে নিরম্বু উপবাস, যড়ঋতু থেকে শত যোজন দূরে থাকা, কুচিন্তা ছেড়ে কেবলমাত্র সুস্থচিন্তা, হাজার রকমের দানধ্যান, দুঃস্থের সেবা, সারাদিন রোজা রাখার পরেও গভীর রাত পর্যন্ত কঠিন তারাবী নামাজ পড়া, অনেকের রমজানের শেষ দশদিন ইহ জগতের সবকিছু ছেড়ে মসজিদে “এত্তেকাফ” এ বসা – এতকিছুর পরেই তা আসে। একমাস ধরে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে এটাই তার এই ভিকট্রী।
২) আমেরিকার প্রেক্ষিতে, কেবল “ভিকট্রী ডে” ছাড়া এটি একটি “থ্যান্কসগিভিং ডে”ও বটে। এদিন এতটা কৃচ্ছ্র সাধনের সুযোগ ও শক্তি দেওয়ার জন্য তারা সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায়। এই জমায়েত, ও নামাজ অনেকটা সারা বছর ধরে শুক্রবারের জুম্মার নামাজের মত। কিন্তু তার চেয়ে অনেক গুণ বড়, আনন্দঘন ও বৈচিত্রময়।
৩) এদিন তারা ধর্মীয় বিধানে অবশ্য ধার্য দাতব্য “ফিতরা” তো দেয়ই। তার উপরেও সামর্থ অনুযায়ী নানা ধরণের দান ধ্যান করে থাকে। খাবার টাকাপয়সা, কাপড় চোপড়, পড়ার বা চিকিৎসার খরচ, ভাঙ্গা ঘর মেরামত, কাফনের কাপড়- কোনরকম কিছুই বাদ যায় না।
৪) এই দিনটিকে তারা একটা “স্মরণের দিন” হিসেবেও গণ্য করে। তাদের সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ তো করেই, তাছাড়া তারা জীবিত ও মৃত আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর কথা স্মরণ করে। অসুস্থ ও পঙ্গুদের সঙ্গে দেখা করে। কাছে বসে কথাবার্তা বলে সহানুভূতি জানায়। মুমূর্ষু বা বিষণœদের চিয়ার আপ করায়। অনেকে ছেড়ে যাওয়া আত্মীয়স্বজনের কবরখানায় যায় ও তাদের আত্মার শান্তির জন্য আল্লার কাছে দোওয়া ভিক্ষা করে।
মোটকথা, এটা কেবল বছরের দিনপঞ্জি অনুযায়ী চলে আসা একটা দিনমাত্র নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই দিনটি অর্জন করতে হয় এবং এটা কেবল একমাত্র পয়সাওয়ালাদের অঢেল খুশির দিনও নয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত-পথহারা, পুঁজিপতি-সর্বহারা, সুখী- দুঃখী, জীবিত- মৃত সবারই সমান অংশ, অধিকার বা হক্ক থাকে।
শিকাগো।