এমাজউদ্দীন আহমদ
মুসলিম বিশ্বের সর্বজনীন উৎসব- ঈদুল ফিতরের দিন একটু ভিন্ন। এই ভিন্নতা যেমন ব্যক্তিপর্যায়ে পরিস্ফুট, তেমনি পরিশ্রুত সামষ্টিক পর্যায়ে। মুসলিম বিশ্বের জনসমষ্টির কাছে ঈদুল ফিতর এক আনন্দঘন অনুষ্ঠান। সব শিশু-যুবক-বৃদ্ধ-বনিতার অনুষ্ঠান এটি। ধনী-দরিদ্র সবার জন্য আনন্দমুখর দিনটি। পল্লী-শহরাঞ্চল উভয় এলাকাই উদ্বেল হয়ে ওঠে এই দিনে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ আসে। আসে আত্মশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে। সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীরঘেঁষে ঈদ আসে। সামষ্টিক কল্যাণ-সচেতনতার মোহনা অতিক্রম করে আসে। এক কথায়, ব্যক্তির ঊর্ধ্বে যে সমাজ, এমনকি সমাজের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে যে বিশ্বসমাজ, তার সুখ-দুঃখের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে ঈদ আসে। তাই ঈদের আনন্দে নেই ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস। নেই বাঁধনছাড়া গতি। নেই অসংলগ্ন কোনো ছন্দ। তাই ঈদ একদিকে যেমন আনন্দঘন উৎসব, অন্যদিকে তেমনি সবাইকে নিয়ে আনন্দমুখর অনুষ্ঠানও। উৎসবে দুঃখ থাকে না। থাকে না কর্তব্যের মৃদুভারও, অনুষ্ঠানে দুই-ই থাকে। ঈদের খুশিকে এ আলোকেই দেখা হয়। দেখা হয় ব্যক্তির সন্তুষ্টিরূপে। এ কারণে ঈদের খুশির আবেদন এতো গভীর। ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ঈদুল ফিতরের নামাজ জামাতে পড়ার আগে প্রত্যেক মুসলমানকে পূর্বনির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দরিদ্র অথবা বিত্তহীনদের অবশ্যই দিতে হবে। তা না হলে নামাজ শুদ্ধ হবে না। ফিতরা দিতে হয় এ জন্য যে, দরিদ্র ও বিত্তবানদের অর্থের ওপর কিঞ্চিৎ হলেও দরিদ্রদের অংশ রয়েছে। এভাবে ধনী-নির্ধন, নর-নারী সবাই ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারে।
বাংলাদেশের বৃহত্তর জনসমষ্টির কাছে ঈদুল ফিতর তেমনি এক আনন্দঘন অনুষ্ঠান। এই দিনে সবাই আপনজনের সান্নিধ্য পেতে চায়। দু’দ- কাটাতে চায় প্রিয়জনের পাশে। মা পেতে চায় সন্তানকে পাশে, কার্যোপলক্ষে দূরে অবস্থানকারী সন্তান-সন্তুতি তাই ছুটে আসে মায়ের কাছে। ভাই বোনের কাছে, বোন ভাইয়ের কাছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা জয় করে ছুটে আসে। ঈদের দিনে ভাগাভাগি করে এই দিনের খুশিকে। ঈদের জামায়াতে ছোট-বড় হাত ধরাধরি করে শরিক হয়। ঈদের নামাজ শেষ করে উষ্ণ কোলাকুলিতে প্রাণের আবেগ বিলিয়ে দেন সবাই। মুরব্বিদের সালাম জানিয়ে আনত দৃষ্টিতে তাদের স্নেহে ভাগ বসায়। মুরব্বিরাও আপনজনদের বুকে জড়িয়ে অনুভব করে এক বেহেশতি সুখ। সমাজব্যাপী ঈদের দিনের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে স্নেহ-প্রেমপ্রীতি অঝোরধারায়। প্লাবিত করে সমাজজীবনের দশ দিক।
বাংলাদেশের সমাজে কেউ অনাত্মীয় নন। সবাই সবার আত্মীয়। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও মুসলমানরা বসবাস করছেন একধরনের Close family ties নিয়ে। কাকা-বাবা-দাদা সম্পর্ক তৈরি করে পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতায়ই বসবাস করছেন হাজার বছর ধরে। বাংলাদেশ এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো এলাকায় এ সম্পর্ক ছিন্ন করে কিছু স্বার্থপর ব্যত্যয় ঘটানোর চেষ্টা করে থাকে; কিন্তু তা হলো ব্যতিক্রম। স্বাভাবিকভাবে ঈদের দিনে সবাই সবার সাথে প্রীতির ডালা সাজিয়ে মিলিত হয়। আমি দেখেছি আমার পরিবারে, আমার গ্রামে, আমার মহল্লায়। আমার আম্মাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে প্রণাম করতে। শারদীয় পূজার সময় আমরাও ওদের বাসায় গেছি তাদের আপনজন হিসেবে, পুণ্য দিনে মুরব্বিদের সালাম জানাতে। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি এখনো অত্যন্ত প্রাণবন্ত। বাংলাদেশেও কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যারা দারিদ্র্যক্লিষ্ট, জীবনযুদ্ধে পরাস্ত, হতাশাগ্রস্ত। তাদের লক্ষ্য করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ঈদ-মোবারক কবিতায় লিখেছেন :
ঈদ-অল-ফিতর অনিয়াছে তাই নব বিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিস্সা আছে ও পেয়ালাতে,
দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার,
বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত,
কআে না হিসাবী, আজি হিসাবে অঙ্কপাত!
কবি বললে হবে কী? এ দেশেও রয়েছেন কেউ কেউ। কোটি মানুষের মধ্যে কিছু ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন সীমাহীন বিলাসী জীবনের উপযোগী ঐশ্বর্যের চোখধাঁধানো সৌধ। তারা বসবাস করছেন গ্রিক দার্শনিকের ‘স্বপ্নরাজ্যে’। সেই স্বপ্নরাজ্যে ‘মাছেরা নিজেরাই ছুটে আসে, নিজেরাই নিজেদের সেঁকে-ভেজে সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে ভোজনবিলাসীদের টেবিলে নিজেরে পরিবেশন করে থাকে’ (The fishes come perfectly willing and do their own grilling and serve themselves on the dishes.)। এসব মহামানবের জন্য প্রতিদিনই ঈদের দিন। তারা কিন্তু এ সমাজে ব্যতিক্রম মাত্র। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা ভিন্ন এবং তারাই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের জন্য বছরে একবারই ঈদ আসে। তাদেরই প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয় আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের। তারাই ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দার শিকার। তাদেরই সহ্য করতে হয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হ্রাসের বিভীষিকা। তারাই বেকারত্ব ও আধা-বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত। কর্মসংস্থানের অপর্যাপ্ততা তাদের জীবনে টেনে আনে অন্ধকার রাত্রির অনিশ্চয়তা।
তারপরও ঈদের দিনটিতে তারা আশায় বুক বাঁধে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজের ছোট্ট ঘরটিতে তারা নামিয়ে আনতে চায় বেহেশতি এক পরিবেশ। নিজের নিজের সামর্থ্যানুযায়ী সবাই দেখতে চায় প্রিডজনের মুখে একদিনের জন্য হলেও একটু হাসি। ভুলতে চায় প্রতিদিনের জীবনযন্ত্রণা। নিজেদের সাধ্যমতো সাজাতে চায় নিজের সংসারটিকে। মা-বাবার জন্য ছোট্ট উপহার, সন্তান-সন্ততির জন্য নতুন কাপড়, প্রিয়জনের জন্য সামান্য কিছু এ দিন সংগ্রহ করতে চায়। প্রত্যেকে এ দিন ভালো কিছু খেতে চায়, চায় পরিবার-পরিজনদের ভালো কিছু খাওয়াতে। বন্ধু-বান্ধবদের হাতে কিছু তুলে দিতে চায়।
এতো অসুবিধার মধ্যেও ঈদ এলো। ঈদ এলো সেই নির্মম সমাজে অবিন্যস্ত ব্যবস্থাপনার ভাঙা ঘরে। সমাজব্যাপী ছিনতাই-রাহাজানি-ডাকাতি-জবরদখল-সন্ত্রাস ও হত্যাকা–ধর্ষণের নারকীয়তার প্রচণ্ড দাপটের মধ্যে ঈদ এলো। রাজনীতিবিদের দুর্নীতি, আত্মম্ভরিতা, বাচালতা আর নিষ্ফল আস্ফালনÑ দোজখের মধ্যেও ঈদ এলো।
সম্ভাষণ এবং উষ্ণ কোলাকুলির ডালা সাজিয়ে। বাবার হাতে কোমল ছোট্ট আঙুলগুলো গলিয়ে ছোট্ট শিশুটিকে ঈদের জামায়াতে যোগদানের দাওয়াত নিয়ে এলো ঈদ। মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রবাসী সন্তানের সালাম করার উদগ্র আকাক্সক্ষা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এলো ঈদ। প্রিয়জনের কল-কোলাহলে ছোট্ট ঘরটি মুখরিত করার অঙ্গীকার নিয়ে ঈদ এলো।
আমরা আশা করবো, সবার মুখে অন্তত এ দিনটিতে হাসি ফুটুক। এ দিনটিতে সবাই যেনো ব্যথা-বেদনার যন্ত্রণা ভুলে প্রিয়জনের বুকে বুক মিলাক। আনন্দের বন্যায় ভেসে যাক সব দৈন্য-দুঃখের আবর্জনা। স্বজন-প্রিয়জনের কল-কাকলিতে ভরে উঠুক সব ঘর-সংসার। অন্তত এই দিনে, আমাদের কামনা সবার ঘরে ঈদ আসুক। আসুক বিনম্র পদভারে। আসুক অনাবিল খুশির ডালা সাজিয়ে, সবার ঘরে ঘরে।