লাবলু কাজী
হে পরাণ মাঝি তুই আমাকে নিয়ে চলো সেথায়, যেথায় আমি জীবন মরণের সুর শুনি। হৃদয় স্পন্দনে বাজে সুর বাতাসের কড় কড় শব্দ, দোয়েল কোয়েল ডাকে গাছের ডালে। কৃষাণের গোধূলি লগ্নে ঘরে ফেরার পালায় সায়াহ্নে দাঁড়ানো রক্তিমা আকাশ, ঢেকে রেখেছে দিগন্তজুড়ে। মোয়াজ্জিনের আজান, মায়ের ঘরে ফেরার ডাক, পড়ার তাগিদ বুকে বাজে, শূন্যতায় ভরে দেয়। দিনের শেষে আলো আঁধারের ক্ষণচ্ছটায় প্রিয়ার কালো হরিণী আঁখির ক্লিউপেট্রা সদৃশ মুখখানি দেখার প্রয়াসে মাঠে পায়চারি, তন্ময়াচ্ছন্ন হয়ে ভাবা হয়তো মিলছে প্রেমিকার দর্শন। ইছামতির কুলকুল ধ্বনি এবং অতীত স্মৃতিবিজড়িত ছোট গাঁ আজও আমাকে আকৃষ্ট করে। সেখানে গরীবের স্বর্গে থাকতেন আমার মা, বাবা, ভাই আর বোন। হাঁসির ফোঁয়ারা বয়ে যেত আমাদের পরিবারে । হালটে টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলা, গোল্লাছুট, ড্যাং গুটি খেলায় মত্ত থাকা , ভাবুকের ভাবনায় আমায় পুরানোতে নিয়ে যায় । পেছনের জীবন উল্টো স্রোতে সামনে এসে জড়িয়ে ধরে ! সেই সব জীবন হারিয়ে গেছে প্রাচুর্যের গলাবন্ধীতে পৃথিবীর সব চেয়ে ধনী দেশের নিরস জীবনে। জীবনের সাথে ঝগড়া করে ,আত্মাকে কষ্ট দিয়ে , জীবনের বৈরী হাওয়ায় বাঁচা যায়না , থাকার নিমিত্তে থাকা যায় । আত্মা যখন কষ্ট পায় জীবন তখন সুখের কিংবা অভিপ্রেত হয়না । হ্রদয়ের রক্তক্ষরণে বর্তমানে আমি আবেগপ্রবণ, দুর্বল ভবের নাট্যশালার অভিনেতা । যে শুধু বিয়োগান্তক দৃশ্যে অভিনয় করে শেষ দৃশ্যে প্রস্থান নিবে দর্শকদের হ্রদয় ভরাক্রান্তে কাঁদিয়ে……!
রমাদানের পর ঈদ আসে , ঈদের খুশি আমরা বিলিয়ে দেই অন্যের জন্য , খোশ আমদেদ , ঈদ মোবারক ! ঈদ আসে, ঈদ চলে যায়, স্মৃতি সাথে সাথে চলে । জীবনের কিছু কিছু কথা, কিছু কিছু দুঃখ ব্যথা অনেক বছর পরও চৈত্রের খড়ার মতো জীবনকে দগ্ধ করে। দোষ যারই হোক ভুক্তভোগীর কষ্ট তার সাথেই চলে। এক্ষেত্রে নিয়মের বালাই নেই। এমনিই চলছে অনাদি কাল হতে, চলবে অনন্ত কাল পর্যন্ত অবলীলায়। একটা কথা আছে , যদি থাকে নসীবে আপনা আপনা আসিবে । আবার কখনও কখনও নিজে নিজেই যাই সেখানে, কিন্তু মন চলেনা তবুও যেতে হয়। জীবনের ছোট কালটা যেমন নিশ্চিন্ত জীবন, তেমনি মুরুব্বিদের অন্যায় আব্দার মেটাতে মেটাতে জীবন তেজপাতার ন্যায় জ্বলে হলুদাভ হয়ে যায়। এমনি এক কাহিনী জীবন পুরানোয় সামনে এসে চলতি গাড়ির মতো হঠাৎ ধাক্কায় মনের বীণায় বৈরভী রাগের মূর্ছনায় করুণ সুর বেজে উঠে।
কৈশোরে আমাদের পরিবারের কর্তা ছিলেন বড় ভাই। বাবা -মা তার কথাই মেনে নিতো , চলতোও তার আদেশে। বাবা মা , ভাল যেমন বাসতেন সমীহও করতেন। জীবন চলায় , ছোটদের তার অত্যাচারে জীবন বিষিয়ে উঠতো । ঈদের দু দিন আগে বড় ভাই কাপড় পাঠালেন ঢাকা থেকে আমার সেজো বোনের দুই বাচ্চার জন্য। সে কাপড় আমাকে দিয়ে আসতে হবে বোনের বাড়িতে ছয় মাইল হেঁটে গিয়ে ঈদের আগের দিন চাঁন রাতে। আমি অস্বীকার করলাম । বড় ভাই অনেক রাতে গ্রামে এলেন। মাকে জিজ্ঞেস করলেন আছমার বাচ্চাদের কাপড় দিয়ে আসা হয়েছে কিনা ? মা সব খুলে বললেন । ভাই কোন কিছু শুনলেন না । মাকে বললেন কাল সকালে ঈদের নামাজের আগে কঠুরী গ্রামে গিয়ে ঈদের কাপড় ভাগ্নে ও ভাগ্নীদের দিয়ে আসবে । অগত্যা আর কি করা। ঈদের দিন ভোর সকালে ফসলী জমি পেরিয়ে , মাট- ঘাট মাড়িয়ে সেখানে আমাকে যেতে হচ্ছে!
বসন্তের সকাল , ফসলি জমিতে সরিষা ফুল ফুটে আছে , চারিদিক হলুদাভ রঙে ঘেরা । হলুদ নাকি বিপদের অশনি সংকেতের পূর্ব বাহক। আমার জীবনেও আজ তাই হতে চলেছে কি? রাস্তা-ঘাট ফাঁকা মানবজন বিহীন । সবাই জামাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমিই আলাদা জীবনের এই আনন্দঘন দিনটিতে । বুকের ভিতর কষ্ট জমে আছে, কান্নায় বেরিয়ে আসছে না। এ ধরনের কষ্ট অন্যকে বুঝানো যায় না । আমি যখন আপার বাসায় পৌঁছলাম , দুলাভাই তখন নামাজে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে। তার অনেক অনুরোধে , তারই পুরানো পাঞ্জাবী-পায়জামা পরে নামাজ পড়ে এলাম। সেই দুলাভাই অনেকদিন আগে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আপার অনেক অনুনয়- বিনয় উপেক্ষা করে না খেয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম ।
যখন আমাদের গ্রাম আউলিয়াদ এসে পৌঁছলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। ঈদের আনন্দ শেষ। দু একজন বন্ধু-বান্ধব এলো। কারো সাথে বিছানা থেকে উঠে দেখা করলাম না , ঈদের মজার খাবারও খেলাম না । অভিমান জেদ যেটাই বলিনা কেন আমায় পেয়ে বসলো। মন বার বার প্রশ্ন করছিলো একজনের সুখ কেড়ে নিয়ে অন্যে সুখ বিলোনোর মধ্যে সত্যই কি কোন মহত্ব আছে । আমার সেই দিনের ছোট্ট মনের বড় কষ্টটা আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় । এখন বয়স হয়েছে, বুঝতে শিখেছি কষ্ট কি! জীবন অভিজ্ঞতায় আমি আমার বাচ্চাদের প্রতি বড় সহনশীল । নিজের জীবন অভিজ্ঞতার ফসল ঘরে এনে ওরা এর পুরো উপভোগ করছে । একজনের কষ্ট অন্যের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে । ঈদ আসে যায় , ঈদের খুশীর রঙ লাগে , রঙ বদলায়ও ! জীবনধারার এ পালাবদলের খেলায় আমরা খেলোড়ার , ঝানু খেলোড়ারের কদর আছে । ঈদে আনন্দ করি ও আনন্দ পাই। কিন্তু মন কালো মেঘের ঘনঘটায় ছেয়ে যায় । প্রশ্ন করতে মন চায় বড় ভাইকে, তিনি সেদিন এমনটি কেন করেছিলেন; আমার অবুঝ মনে কেন ব্যথা দিয়ে ছিলেন ? আজও তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি , আমার কষ্টগুলোও সরে দাঁড়ায়নি , কালো মেঘ, বরিষণে এখনও আকাশ স্বচ্ছ একটি সকাল উপহার দিতে পারেনি ……!
নিউইয়র্ক।