ঈষাণ কোণে কালো মেঘ, টের পাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প?

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টের পাচ্ছেন, কি পাচ্ছেন না-কে জানে! তবে তার বিরুদ্ধে একটি প্রবল ঝড় আসছে বলে মনে হচ্ছে। ঈষাণ কোণে কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ করা যাচ্ছে। ৭ নভেম্বর বিভিন্ন রাজ্যে গভর্নর-মেয়রসহ বিভিন্ন পাবলিক পোস্টের নির্বাচনে সেই ঝড়ের ঝাপ্টা দেখা গেছে মাত্র! জনগণের মনে এই আশঙ্কা জমতে শুরু করেছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই ঝড় সামাল দিতে আরও বড় কোনো ঝড়ের জন্ম তিনি নিজেই দেবেন, নাকি প্রাকৃতিক ঝড় সামাল দিতে তিনি আমেরিকার মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য তা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হবেন। প্রশ্নটি খুবই জরুরি। কেননা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ট্রাম্পের কথাবার্তা, কাজেকর্মে আমেরিকার মৌলিক চেতনা এবং আদর্শ ভূলুষ্ঠিত হতে থাকে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার যে ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তি, তাতে ধুলো লাগতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে শুরু করেছেন, তাতে আমেরিকার জনগণ ইতিমধ্যে দেশের গন্তব্য নিয়ে প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন। ৭ নভেম্বর যে নির্বাচন হয়ে গেল, তা নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় নানা মন্তব্য শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, স্টেট গভর্নর নির্বাচনে রিপাবলিকানদের ভরাডুবি ঘটেছে। গত ১০ মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান শাসিত কংগ্রেসের বিভিন্ন পদক্ষেপে অতিষ্ঠ ভোটাররা ভার্জিনিয়া ও নিউজার্সি স্টেটের দুই রিপাবলিকান গভর্নরকেই ভোটের মাধ্যমে ধরাশায়ী করেছেন। ট্রাম্পের দুঃশাসন আর অপশাসনের বিরুদ্ধে এটা মার্কিনি জনগণের জবাব বলে মনে করা হচ্ছে। অনেক আগে থেকেই ৭ নভেম্বরের নির্বাচনকে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য একটি টেস্ট কেস হিসেবে দেখছিল। ট্রাম্পের শাসনের পক্ষে আমেরিকার জনগণ কতটা বিরক্ত, তারই স্পষ্ট প্রকাশ ঘটতে দেখা গেল গোপন ব্যালটে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যালটে হেরেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার আর রক্ষা হলো না। সেই ব্যালটেই এবার তার দল রিপাবলিকানদের ভরাডুবি ঘটল। ভার্জিনিয়া ও নিউজার্সি-দুই স্টেটেই ছিলেন রিপাবলিকান গভর্নর। এবার দুটোই হারিয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। ভার্জিনিয়ায় ৫৩.৫% শতাংশ ভোট পেয়ে ডেমক্র্যাট দলীয় প্রার্থী লে. গভর্নর রালফ এস নর্দাম গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন। তার রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ এওয়ার্ড জিলেস পাই পেয়েছেন ৪৫% শতাংশ ভোট। অন্যদিকে নিউইয়র্কের পার্শ্ববর্তী স্টেট নিউজার্সিতেও গভর্নর হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন ডেমক্র্যাট দলীয় প্রার্থী। ডেমক্র্যাট ফিলিপ মার্ফি ৫৫% শতাংশ ভোট পেয়ে তার রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ কিম গুয়াডেঙ্গোকে পরাজিত করেছেন। কিম পেয়েছেন ৪৩% ভোট। ৭ নভেম্বরের ভোটের ফলাফল দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ডেমক্র্যাটরা যদি ভোটারদের মধ্যকার এই আবেগ ধরে রাখতে পারেন, তবে ভবিষ্যতেও তাদের বিজয়ের এই ধারা অটুট থাকবে। এবং আগামী নভেম্বরে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানেও বিজয়ের এই চিত্রই প্রতিফলিত হবে। নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, রিপাবলিকানদের এই ভূমিধস পরাজয়ের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই দায়ী। তার ইমিগ্র্যান্ট বিদ্বেষ, উগ্র জাতীয়তাবাদী আচরণ, বর্ণ বিদ্বেষ, লিঙ্গ বিদ্বেষ এবং চরম হঠকারী কিছু পদক্ষেপে ভোটাররা ক্ষুব্ধ হয়ে রিপাবলিকানদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেন। বলা যায়-ভোটাররা রিপাবলিকান, তথা প্রেসিডেন্টকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অন্যদিকে নিউইয়র্ক সিটি ডেমক্র্যাট গরিষ্ঠ হলেও বিল ডি ব্লাসিও প্রথম টার্মের নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি টার্মেই সিটি মেয়র হিসেবে বিজয় অর্জন করেন রিপাবলিকান প্রার্থীরা। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এবং ডেমক্র্যাটিক স্টেট ছাড়াও ব্লাজিও ব্যতিক্রমী আচরণের জন্য টানা দুই টার্মে নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। বিল ডি ব্লাজিও ব্যাপকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গরিব ও মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম সুহৃদ হিসেবে জনপ্রিয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকটি মুসলিম দেশের মানুষের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তোলপাড় সৃষ্টি করে। তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেয়র বিল ডি ব্লাজিও নিজেও রুখে দাঁড়ান। এমনকি তিনি এমন সাহসী কথাও উচ্চারণ করেন যে ইমিগ্র্যান্টদের মুসলমান হিসেবে বিতাড়ন করা হলে তিনি সেখানে দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হয়ে যাবেন। এসবেরই প্রতিফলন ঘটে তার ৬৫% ভোট পেয়ে মেয়র হিসেবে পুনর্নির্বাচনের ফলাফলে। এই নির্বাচনী ফলাফলে আবারও প্রমাণিত হলো সত্য কখনো সব সময়ের জন্য চাপা দিয়ে রাখা যায় না। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। আমেরিকার যে মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং যে আদর্শের ওপর ভর করে আমেরিকার জন্ম, তাকে অস্বীকার-অবহেলা করে কিংবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যেই করবেন, তার পক্ষে খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। তাহলে আমেরিকার মূল কাঠামোই ধসে পড়বে। এ লক্ষ্যে যিনি আমেরিকার মৌল কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন, তারই ভরাডুবি ঘটবে। একটি বাংলা প্রবাদে বলা হয় : ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’ অধর্ম কেউই সহ্য করে না। না স্রষ্টা, না প্রকৃতি, না কোনো রাষ্ট্র এবং না কোনো মানুষ। অসত্য, অধর্মকে আড়াল করে কেউ একবার সফল হতে পারে, বারবার সফল হওয়া সম্ভব নয়। ট্রাম্প নির্বাচনে একবার সফল হয়েছেন মানুষকে বোকা বানিয়ে। বারবার সেই সাফল্য আশা করলে তিনি নিজেই বোকা হবেন! আমেরিকার জন্ম হয়েছে কিছু আদর্শ এবং অঙ্গীকারকে সঙ্গী করে। স্বাধীন আমেরিকার জন্ম দিয়েছে যারা নিজেদের জীবন-যৌবন মেধা-প্রজ্ঞা দিয়ে, লড়াই-সংগ্রাম করে এবং তাদের দূরদৃষ্টি ও ত্যাগের মহিমা দিয়ে, তার মূল চেতনা ছিল মানুষকে ভালোবাসা, আমেরিকাকে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করা। তারা যে সংবিধান রচনা করেন, তার মূল কথা ছিল-স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী। এ স্বাধীনতা ব্যক্তির চলাফেরা, চিন্তা, কথা বলা, লেখার স্বাধীনতা। ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে, চাকরি লাভের সাম্য ও মৈত্রী। সব রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে থাকবে এই বিশ্বাস ও চেতনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকেই মানুষকে ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও মৈত্রীর পরিবর্তে অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা, অবহেলা এবং বৈষম্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ৯/১১-এর ওই রকম বিধ্বংসী ঘটনার পরও যেমন দেখা যায়নি, তার চেয়ে অধিক ঘৃণা, অবিশ্বাস, সন্দেহ দেখা যাচ্ছে ট্রাম্পের আমলে এবং অনেকেই বিশ্বাস করছেন, তারই পরিণতি ৭ নভেম্বরের নির্বাচনী ফলাফল। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুধরাবেন, নাকি তিনি একগুঁয়েমি করে দেশকে আরও পেছনে নিয়ে যাবেন-সে ভাবনাই এখন ভাবছেন সংশ্লিষ্ট মহল। তিনি এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফর করলেন অতিসম্প্রতি। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, ট্রাম্পের এই সফর আমেরিকার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠার সফর, নাকি যুদ্ধাভিযান-তা অচিরেই বুঝতে পারা যাবে। সবাই রিপাবলিকানদের আরও ধস ঠেকাতে ট্রাম্পের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে আশা করছেন। নইলে মি. ট্রাম্প, তার দল এবং সর্বোপরি আমেরিকা ও আমেরিকার জনগণের কী পরিণতি হবে, তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। সবশেষে নিউইয়র্ক সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাজিও এবং ভার্জিনিয়া ও নিউজার্সির নবনির্বাচিত ডেমক্র্যাট গভর্নর যথাক্রমে রালফ এস নর্দাম এবং ফিলিপ মার্ফিকে ঠিকানা পরিবার এবং ঠিকানার অগণিত পাঠকদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন। তাদের সুস্বাস্থ্য ও সাফল্যও কামনা করছে ঠিকানা।