উন্নয়নের পথে বিষফোড়া

শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা

বিশেষ প্রতিনিধি : হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ক্যাটাগরি ‘এ’ তে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের বরাতে জানা যায়, এই সাফল্য ছুঁই-ছুঁই করার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ক্যাটাগরি ‘এ’ তে উন্নীত হলে আইকাও সন্তুষ্ট হতো এবং মিলত এ ক্যাটাগরির সনদও। সেই সঙ্গে চালু হতো বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইট।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট নয়। এ কারণে বাংলাদেশ বারবার নিউইয়র্কে ফ্লাইট চালু করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কয়েক বছর থেকেই প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন শিগগিরই নিউইয়র্ক রুটের ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হবে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তাসহ অন্য বিষয়গুলো যাতে উন্নীত করা হয়, সে জন্য শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। আইকাও বিমানবন্দরের ক্যাটাগরি এ-তে উন্নীত হওয়ার জন্য বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়েছিল এবং কী কী করতে হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট করে জানিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ সেসব শর্ত পূরণ করার পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার বিষয়ে কাজ করে আসছিল। নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গত দুই মেয়াদের সরকার নিয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও নিরাপত্তা বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বিএনপি সরকারের আমলে লোকসানের কারণে ঢাকা-নিউইয়র্ক-ঢাকা রুটটি প্রেস্টিজ ফ্লাইট হওয়া সত্ত্বেও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রেস্টিজ রুটে আজও নানা জটিলতার কারণে ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। এখনো সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশেষ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ যখন বিমানবন্দরের এ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঠিক সেই সময়ে বিমাবন্দরের সকল নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সকল ক্যামেরা, সকল স্ক্যানিংয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নারায়ণগঞ্জের পলাশ আহমেদ অস্ত্রসহ বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছে। সেখানেই ঘটনার শেষ নয়। বিমানের ভেতরে পর্যন্ত প্রবেশ করেছে তার কাছে অস্ত্র রেখেই। এরপর আবার বিমানের যাত্রীদের অস্ত্রের ভয় দেখানো হয়েছে। পাইলটদের জিম্মি করা হয়েছে। এত কিছুর পরও ছিনতাইকারী কারও চোখে পড়েনি। যেখানে বিমানবন্দরের ভেতরে স্ক্যানার মেশিনে লাইটার, নেলকাটার, সুচ, আলপিনসহ সব ধরনের জিনিসের শব্দ হয় ও দেখাও যায়। সেখানে পলাশ আহমেদ স্ক্যানার মেশিনের নিরাপত্তা ভেদ করে সেখান দিয়ে অস্ত্র (সেটি আসল কিংবা খেলনা পিস্তল যেটি হোক না) বহন করে দিব্বি প্রবেশ করেছে। বিমানবন্দরে স্ক্যানার ছাড়াও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে শরীরও স্ক্যানিং করা হয়। সেখানেও ধরা পড়ার কথা। ঢাকায় বিমানবন্দরে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক করার পরও শরীরের কোথাও কোনো কিছু আছে কি না অস্বাভাবিক মনে হলে দেহ তল্লাশিরা শরীরে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে, সেই সঙ্গে তারা জানতেও চায় কী আছে? আর সেখানে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে পলাশের বিমান ছিনতাই করার চেষ্টা এখন নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের বিষফোড়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। ঘটনার এক সপ্তাহ পার হয়নি। খুব শিগগিরই আইকাওয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে নির্দেশনাও যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেখানে নতুন শর্তও জুড়ে দেওয়া হতে পারে। সেটা হলে ওই সব শর্ত পালন করা কঠিন হয়ে যাবে এবং আবারও পিছিয়ে যাবে নিউইয়র্ক-ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটের ফ্লাইট চালুর বিষয়টি।
বিমানবন্দর ও নিরাপত্তা বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার কিংবা ঢিলেমি করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সেখানে হাজার হাজার যাত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে। এই জানমালের নিরাপত্তার পাশাপাশি একটি এয়ারক্রাফটেরও নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে। একটিও নয়, একাধিক। সব মিলিয়ে বিমানবন্দরের অতিসাম্প্রতিক ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেই সঙ্গে বিমানের ইমেজও ক্ষুণœ হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বড় বড় ড্রিম লাইনার যুক্ত হচ্ছে একের পর এক। এতে করে বিমান লাভজনক হওয়ার কথা। যাত্রী বাড়ার কথা। কিন্তু এসব ঘটনার কারণে বেশির ভাগ যাত্রী বিমানের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। ভরসা রাখতে পারছেন না বিমানের যাত্রী হওয়ার। এ কারণে অনেকেই বিমানে যাত্রী হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে নিরাপত্তা, সিডিউল না মানা ও সেবা বিভিন্ন কারণে বিমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ কারণে বিমান দিনের পর দিন লোকসান গুনে যাচ্ছে।
পলাশের ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও যাত্রীদের, এয়ারক্রাফটের নিরাপত্তা যেমন প্রশ্নের মুখে পড়েছে, ইমেজও ক্ষুণœ হয়েছে। তেমনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ইমেজের ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনার পর বিমানের যাত্রী আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদেশি এয়ারলাইনস যেগুলো ঢাকায় চলাচল করে, তারাও নতুন করে কোনো শর্ত দেয় কি না, সেটাও দেখতে হবে।
সূত্র জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ে লাভের মুখ দেখেছিল। এরপর আর সেভাবে লাভের মুখ দেখেনি। যখনই বিমান ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, তখনই এমন ঘটনা ঘটেছে। তাতে বিমানের ইমেজের ক্ষতি হওয়াতে বিমান লোকসানের মুখ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার প্রশ্ন ছাড়াও এখন সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন, বিমানবন্দরের তল্লাশি ঠিকমতো হয় না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আন্তর্জাতিক টার্মিনালে চেকিং ব্যবস্থা ঠিক আছে। এ কারণে সেখান দিয়ে কোনো যাত্রী অবৈধ ও অনুমোদিত কোনো জিনিস নিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। স্ক্যানিং ও দেহ তল্লাশিও করা হয় যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে। এ ছাড়া এপিবিএনকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়োজিত করার পর অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছিল। সিভিল এভিয়েশন অথরিটিও আগের চেয়ে অনেক বেশি চেষ্টা করে আসছিল, যাতে করে বিমানবন্দরের ক্যাটাগরি এ-তে উন্নীত হওয়ার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে নিরাপত্তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। যেহেতু ঢাকা থেকে দেশের অন্য দুটি আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে চলাচল করে। ঢাকা থেকে ওই সব ফ্লাইটে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীও পরিবহন করা হয়। এ কারণে অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের নিরাপত্তাও আন্তর্জাতিক মানের মতোই হতে হবে।
সূত্র জানায়, নিউইয়র্কে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক টিম বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অন্য বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা পরিদর্শন করে বিভিন্ন সময়ে দিকনির্দেশনাও দিয়েছে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি তাদের পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঢাকা-চট্টগ্রাম-দুবাইগামী ফ্লাইটটি পলাশ আহমেদ ছিনতাই করার চেষ্টার ঘটনায় সব ম্লান করে দিয়েছে। ভেস্তে যেতে বসেছে এত আয়োজন, এত পরিশ্রম।