ইশতিয়াক রুপু :
ঋষি সম্প্রদায়। দেশে যুগ যুগ ধরে যাদের ‘মুচি’, ‘চাঁড়াল’ বা ‘চামার’ বলে ডাকা হয়। পাশ্চাত্যে এদেরই বলে ‘স্যু ডক্টর’। যুগ যুগ ধরে পাদুকা তৈরি ও সারাই কাজে দক্ষ এক সম্প্রদায়। দেশের প্রতিটি শহর, গঞ্জ আর বাজার-লাগোয়া খোলা স্থানে ১০-১৫ ঘর মিলে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে লাইন ধরে বসত তারা। হিন্দি ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ হিন্দুধর্মীয় আচার পালনে অভ্যস্ত। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই পেশায় আছে। সুনামগঞ্জে কয়েকটি ঋষি পরিবার কয়েক যুগ ধরে শহরের উপকণ্ঠে বাস করত। বর্তমান সদর হাসপাতাল-সংলগ্ন ছিল ওদের বসবাস। কয়েকজনের বাড়ি ছিল পূর্ব হাছননগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রত্না নদীর পাড়ে। ঋষিরা সুনামগঞ্জ শহরের প্রধান চৌরাস্তার পুরাতন কলেজের সামনে সারিবদ্ধভাবে বসে কাজ করত নীরবে। চামড়ার তৈরি জুতা, স্যান্ডেল সেলাই ও সারাইয়ের কাজ নিপুণভাবে করে যেত বছরের পর বছর। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষাÑসব ঋতুতে সমান ও বিরতিহীন।
মফস্বল শহরে সামান্য বিলাসিতায় অভ্যস্ত মধ্যবিত্তের সব জুতা-স্যান্ডেল সারাইয়ের দায়িত্ব ছিল এই সম্প্রদায়ের ওপর। জুতা-স্যান্ডেলের পাশাপাশি চামড়ার তৈরি স্যুটকেস, সাইড ব্যাগ সারাই ও রংÑদুটি কাজই তারা করত বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে। হিন্দিভাষী ঋষিরা ছাড়াও আরো কয়েকজন বাংলাভাষী ঋষি শহরের চৌরাস্তায় বসে কাজ করত। কাঁধে ঝোলানো থাকত কাঠের বাক্স। হাতে লোহার তৈরি জুতা মেরামতের উপযোগী যন্ত্র।
বেঁটে-খাটো আকারের একজন ধনী ঋষি ছিল। নাম মুনিয়া। বাড়ি ছিল বর্তমান সদর হাসপাতালের পাশে। গায়ের রং কালো। অবস্থাসম্পন্ন ধনী ছিল সে। ঈদুল আজহার দিন আমাদের বাসায় আসত কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে। অগ্রিম টাকা দিয়ে যেতে চাপাচাপি করত। হিন্দিভাষী ঋষিরা দেশীয় মদ্যপানে দারুণভাবে অভ্যস্ত ছিল, যা তাদের সামাজিক রীতি-নীতির অংশ।
ঋষিপল্লিতে প্রস্তুত দেশি মদ্যপানের জন্য শহরের অনেক বাঙালি তাদের বসতবাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করত সন্ধ্যা নামার পর থেকেই।
ঋষিরা পূজা-পার্বণ আয়োজন করত বেশ ঘটা করে। নিয়ম-নীতি মেনে। সবচেয়ে বেশি আনন্দ করত দোল উৎসবে। বালতি-ভর্তি রং তৈরি করে ছেলে-বুড়ো, বিবাহিত-অবিবাহিত যুবক-যুবতীরা রং খেলায় মেতে উঠত। সব উৎসবেই মদ্যপান হতো প্রচুর। সঙ্গে বিশাল খাবারের মজুদ। গ্রামগঞ্জে বড় বড় বাজার এলাকায় থাকত ঋষিরা। নিজেদের মাঝে যোগাযোগ ছিল সব সময়।
কোনো উৎসব বা পার্বণে দল বেঁধে গ্রাম বা শহরের উপকণ্ঠ থেকে অন্যত্র বেড়াতে যেত। মেয়েরা শাড়ি পরত ব্যতিক্রমী স্টাইলে, ভারতের মধ্যপ্রদেশের স্টাইলে। ওখানে মহিলাদের ওভাবে শাড়ি পরতে দেখেছি। শাড়ি হতো বাহারি উজ্জ্বল রঙের। পুরুষেরা খাটো ধুতি ও মাথায় সাদা কাপড়ের পাগড়ি বেঁধে রাখত বেশ জুত করে। মুখের দু’পাশে সুচালো গোঁফ।
পুরুষশাসিত ঋষিসমাজে প্রতিটি মহল্লায় একজন মুরব্বির নেতৃত্বে দু-তিনজনকে নিয়ে পঞ্চায়েত থাকত। মহল্লার নানা অভিযোগ-সালিস সব পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সমাধা হতো। এমনকি বাইরে থেকে মেহমান আসার দিনক্ষণ পঞ্চায়েতের অনুমতির জন্য জানানোর রেওয়াজ।
দুটি বিষয়ে ঋষিদের সামাজিক নিয়মকানুন খুবই কঠোর। দুই বিষয়ের একটি হলো বিয়েশাদি, অন্যটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বাদ-বিবাদ। ছেলে বা মেয়েপক্ষ কোনো অবস্থায় পঞ্চায়েতের চূড়ান্ত অনুমতি ছাড়া বিয়ে ঠিক করা অথবা দিন-তারিখ সাব্যস্ত কিছুই করতে পারবে না। স্বামী-স্ত্রীর বিরোধে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে দুজনকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে দুজনকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বলা হতো। বিরোধ নিয়ে কোনো কথা বলা নিষেধ ছিল। এই নিয়ম ভঙ্গ করলে অপরাধী স্বামী অথবা স্ত্রীকে সমাজচ্যুত করা হতো। নিয়ম মানতে গিয়ে দেখা যেত একসময় সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে গেছে! বাড়তি কোনো দেন-দরবারের প্রয়োজন পড়ত না। বিয়ের আচার পালনে পঞ্চায়েতের শক্ত ভূমিকা ছিল। তবে বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল বেশি। মেয়েদের বয়স ১০-১২ বছর পেরোতে না পেরোতে বিয়ে হয়ে যেত। বরের বয়স তখন মাত্র কৈশোর-উত্তীর্ণ। বিয়ের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা গতানুগতিক হলেও যৌতুক পর্বটি ছিল চমকপ্রদ। সময়ের সঙ্গে যৌতুকের রকম বদল হয়ে গেছে। ১৫-৩০ বছর আগে যৌতুকের তালিকায় থাকত ১২/১৪ ইঞ্চি ন্যাশনাল বা জাপানের তৈরি তোশিবা ব্র্যান্ডের সাদা-কালো টেলিভিশন। পরে রঙের পরিবর্তনের সঙ্গে সাইজেরও পরিবর্তন হয়েছে।
বিয়ের সব আচার পালনের পর আসত নবদম্পতিকে মূল যৌতুক প্রদান বা সীমানা নির্ধারণের পালা। প্রসঙ্গত বলে রাখি, সুনামগঞ্জ জেলা ছোট-বড় অনেক বিল-হাওর, নদী-নালা দিয়ে বেষ্টিত। জেলার অধিবাসীদের প্রধান আয়ের উৎস কৃষিকাজ, নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি।
শহরের পাশে ছিল বেশ বড় কয়েকটি হাওরের উপস্থিতি। ঋষি সম্প্রদায়ের আয়ের বিকল্প উৎস কৃষিকাজে ব্যবহৃত মৃত গবাদিপশুর চামড়া সংগ্রহ। মৃত গবাদিপশু অধিকাংশ সময় হাওর, নদ-নদী কিংবা খালে ফেলা হতো। মৃত পশুর চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রি করার অধিকার ছিল নির্দিষ্ট এলাকার গ্রামবাসী ঋষিদের।
এলাকার মালিকানাপ্রাপ্ত ঋষিরা মৃত পশুর চামড়া ছিলানো ও মালিকানা ছিল পূর্বনির্ধারিত। বহিরাগত কেউ এই মালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে পারত না। এই আইন সব অঞ্চলের ঋষিদের জন্য সমান প্রযোজ্য। আধুনিক কালের মাস্তান অথবা চাঁদাবাজ রাজনীতিবিদের পুরোনো সংস্করণ। তারা গরু-ছাগলের হাট, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাত আপস করে মালিক হয়ে যায়। তেমনি ঋষিদের জন্য মরা গরু-ছাগলের চামড়া সংগ্রহের জন্য ছিল সর্বজনস্বীকৃত নিয়ম ও নীতি।
সেই সূত্র ধরে নববিবাহিত দম্পতিদের আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বয়স্ক পঞ্চায়েত-প্রধান নববিবাহিত বরকে নিয়ে যেত হাওরের পাড়ে। সঙ্গে থাকত পরিবারের বাকি সব পুরুষ সদস্য। পঞ্চায়েত-প্রধান হাত তুলে আঙুল উঁচিয়ে সামনে থাকা বিরাট হাওরের চারপাশের গ্রামের নাম ধরে ধরে হাওরের সীমানা নির্ধারণ করে চিহ্নিত এলাকা নবদম্পতিকে উপহার হিসেবে দিয়ে দিত। জানিয়ে দেওয়া হতোÑএখন থেকে পঞ্চায়েত নির্ধারিত সীমানায় সব মৃত গবাদিপশু সংরক্ষণ করে বিক্রি করার অধিকার একমাত্র সদ্য বিবাহিত দম্পতির জন্য বরাদ্দ করা হলো। বিশেষ নিয়মটি যথাযথভাবে ঋষিসমাজে আজও পালিত হয়ে আসছে।