এই ঈদ, সেই ঈদ

কামাল হোসেন মিঠু

ঈদের দিন ছেলের ছুটি। আমারও ছুটি। সকালে বাপ ব্যাটা এক রকমের পানজাবী পরে ঈদের নামাজ পড়তে যাবো। সেদিন কোন কাজ থাকবে না। নামাজ পড়ে এসে হামলে পরবো খাবার টেবিলে। এক মাসের রোজার না খেয়ে থাকা, ঈদের দিনে উশুল করে নেয়ায় কোন ত্রুটি রাখবো না। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ঈদের সারাটা দিন সে কী করতে চায়। উত্তরে জানালো সে সারাদিন ভিডিও গেমস খেলতে চায়। আমাকে প্রশ্ন করলো আমি কী করতে চাই। জানালাম, খেতে চাই আর ঘুমোতে চাই। ছেলে হেসে বললো, ইউ আর সো লেজি, বাবা। হ্যাঁ, এই একটি দিন আমি চরম আলসেমী করে কাটাতে চাই। একটু পর পর বিরানি, চিকেন রোস্ট। একটু পর পর মেজবানী গরুর মাংস, খিচুড়ি। ঘুরে ফিরে একটু পর পর বোরহানি, ক্ষীর, আর সেমাই। ঘুমাবো আর খাবো, খাবো আর ঘুমাবো। আহা, ভাবতেই এখনি ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ঈদের দিন কোত্থাও ঘুরতে যাবো না। ওসব আমার পোষায় না। মেহমানদারীও তেমন একটা পারি না। কেউ আসলে পানজাবিটা গায়ে দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে সামনে যেয়ে বসি। ঐ কাজটি দক্ষতার সাথে পালন করে বাসার অন্য সদস্যেরা। সুতরাং ঈদের দিন মানে আমার কাছে চরম আলস্যে ভরা গা ম্যাজম্যাজ করা একটা পারফেক্ট ছুটির দিন। প্রবাসের ঈদগুলো আমার এভাবেই কেটে যাচ্ছে।
ঘুম আর খাওয়ার ফাঁকে দেশে আব্বা আম্মাকে ফোন করে কথা বলবো। কান্নায় বন্ধ হয়ে আসা আম্মার ক্ষীন কন্ঠ শুনেও না শোনার অভিনয় করবো। ঈদের সকালে নামাজ পরে এসে ওদের পা ছুঁয়ে সালাম করতে না পারার বিষাদ কাটিয়ে উঠতে কিছুক্ষণ ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে রাখবো। স্মৃতিকাতরতা কাটিয়ে উঠতে কাবাবের ইশারায় সাড়া দেবো। তবু সারাটা দিন থেকে থেকেই মনে পরবে আমার নিজ শহরে, নিজের মানুষগুলোকে ঘিরে কাটানো ঈদ আনন্দের কথা। সকাল না হতেই শুরু হতো আব্বার ধমকাধমকি। ঈদের একটা দিন, এখনও সব পরে পরে ঘুমাচ্ছে। কখন গোসল করবে, কখন নামাজে যাবে। সেই মধুর হুংকার শোনার জন্য কান পেতে থাকবো। আম্মার চুড়ির শব্দ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা খিচুড়ি আর গরুর মাংসের গন্ধ পাওয়ার জন্য প্রাণ মেলে রাখবো।
আরো কত কথা যে মনে পরে যাবে! ঈদের দিন কী এক অনির্বার আকর্ষণে ছুটে যেতাম সিনেমা হলে। মনে পরে যাবে। ঈদে নতুন সিনেমা আসবে, আর বন্ধুরা মিলে দেখবো না, হতেই পারে না। নামাজ পরে মসজিদ থেকে বের হয়ে আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশির সাথে কোলাকুলি আর মুরুব্বীদের দেখলেই ঢপাঢপ পা ছুঁয়ে সালাম। আয় রোজগার করতে হবে তো! বাসায় ফিরে আব্বা আম্মাকে কদমবুচি, আব্বা কে আলাদা সেলামী দিতে হবে, আম্মাকে আলাদা। কত দিলা, এত কম ক্যান, আরেকটু বাড়ায় দাও, এইসব ঘ্যান ঘ্যানে দুইজনের মাথা নষ্ট করে এইতো একটু আসছি বলে বেরিয়ে দোস্তদের সাথে সোজা সিনেমা হল। বড় বড় পোস্টারে শাবানা, আলমগীর। শাবানার চোখে পানি, গালে আর ঠোঁটে লাল। আলমগীরের ঠোঁটও টকটকে লাল। সদ্য সিগারেট খেতে শিখেছি। সিগারেট একটা, ভোক্তার সংখ্যা মোটামুটি সাত আটজন। সবাই সিগারেট ফুঁকছি আর মনে মনে বলছি, আজকেই শেষ। কালকে থেকে সিগারেট খাবো না। তাহলে নায়কের মতো ঠোঁট লাল হবে। সেই উত্তেজনা বলে বোঝানো যাবে না। ভিলেন নায়ককে মারছে, ঢিসুম ঢিসুম, আমাদের উত্তেজনা বাড়ছে। নায়কের মাইর যে শেষ রাতে মনে থাকছে না। শেষ দৃশ্যে ভিলেন নায়কের হাতে মার খেয়ে ত্রাহি ত্রাহি করছে, আর আমরা শিষ বাজাচ্ছি, সিটের উপরে উঠে লাফাচ্ছি। হাতে তালি দিচ্ছি। আহা, বন্ধুদের সাথে ঈদের দিনের সেই সিনেমা দেখার দিনগুলো!! কি আনন্দ!!
এই ঈদে আম্মার সাথে কথা বলার সময় মনে করিয়ে দেবো, এক ঈদে আম্মার হাতে মার খাওয়ার কথা টা। আমরা সারা বছর নতুন জামা পেতাম না। দুই ঈদে দুই জামা, ব্যস। অতি সাধনায় পাওয়া নতুন জামা পরে সিনেমা দেখতে গেছি। টিকেট কাউন্টারে খুব ঠ্যালাঠেলি আর সেই রকম বীভৎস গরম। শার্ট ভিজে শপ শপ। কোনরকমে টিকেট কেটে সিনেমা হলে ঢুকেছি। ভেজা শার্ট খুলে সিটের পেছনে মেলে দিয়েছি শুকানোর জন্য। ভিলেনের সাথে নায়কের মারামারি, হসপিটালের বেডে চোখ মেলে নায়িকার ‘আমি কোথায়’ বলার ভঙ্গি, আর নায়ক নায়িকার রোমান্টিক গানের উত্তেজনায় নতুন শার্টের কথা আর মনে নাই। সিনেমা দেখে বের হওয়ার পরে দোস্তরা হাসতে হাসতে শেষ। বলে, কি রে তোর শার্ট কই। দৌড় দিয়ে যেয়ে দেখি শার্ট হাপিস। কেউ নিয়ে গেছে। কী আর করা। স্যান্ডো গেঞ্জী পরে বাসার ফিরে পরবি পর মালির ঘাড়ে। আম্মার প্রশ্ন শার্ট কই শেষ -হওয়ার আগেই পিঠে ধুমাধুম উত্তম মধ্যম। এবারের ঈদেও মনে পরে যাবে আম্মার হাতের সেই মার খাওয়ার স্মৃতি।
স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতেই ঈদগুলো কেটে যাচ্ছে। আগামীর ঈদগুলোও এভাবেই কেটে যাবে। ফিরনী, সেমাই, পায়েসের গন্ধে খুঁজতে থাকবো অনেক আগের ফেলে আসা সেই চিরচেনা আম্মা আম্মা সুবাস। ছেলেটাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠাতে পেরেশান হবো, খুব ইচ্ছা হবে আমাকেও ডাকুক আমার একদা সুঠামদেহী, রাগী আব্বা টা। আব্বা এখন অসুখের ভারে অনেকটা দুর্বল। কন্ঠের সেই গম গম আর নেই। তবু ঈদের দিনটাতে খুব ইচ্ছে হবে, আব্বা বলুক, কি রে এখনো উঠলি না। কখন গোসল করবি, কখন নামাজ পড়তে যাবি। হোক না দুর্বল কন্ঠ, তবু খুব ইচ্ছা হবে সেই দুর্বল কন্ঠটি একবার শুনতে। প্রবাস জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, তবে হারিয়েছি যা তা অমুল্য। সময়, দূরত্ব, আর নিয়তির নির্মমতায় হারিয়ে ফেলেছি গোটা আমিকেই। এই আমিটা খুব দামী, খুব আদরের। এই আমি নামের প্রাণ ভ্রোমরা প্রবাস নামের সিন্দুকে বন্দী। যে সিন্দুকের চাবি অনেকদিন হলো খুঁজেই পাচ্ছি না।
– নিউইয়র্ক ।