এই ‘ঠিকানা’ ভাষার, এই ‘ঠিকানা’ ভালোবাসার

প্রণবকান্তি দেব :

‘ঠিকানা’ কি তবে সেই সাম্পান, যা আমাদের সুখ-দুঃখ, বেদনা-বাসনাকে পৌঁছে দেয় বন্দর থেকে বন্দরে? নাকি ‘ঠিকানা’ আমাদের কোনো রুপালি আশ্রয়?
এই ‘ঠিকানা’ আমাদের ভাষার, এই ‘ঠিকানা’ আমাদের ভালোবাসার। এই ‘ঠিকানা’ সালাম, বরকতের হিরণ¥য় চেতনার, এই ‘ঠিকানা’ মুক্তিযুদ্ধের। এই ‘ঠিকানা’ আমাদের ফেরার, এই ‘ঠিকানা’ আমাদের ফেরারি আবেগগুলোর। এই ‘ঠিকানা’ সাত সমুদ্র তেরো নদীর কূলে জেগে থাকা কিছু প্রাণের, এই ‘ঠিকানা’ পৃথিবীর পথে পথে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির বঞ্চনা-ব্যথা, অধিকার-অর্জন, দ্রোহ-দাবির। এই ‘ঠিকানা’ তোমার, এই ‘ঠিকানা’ আমার, এই ‘ঠিকানা’ তোমার-আমার-সবার। এই ‘ঠিকানা’ স্বপ্নজয়ীর, এই ‘ঠিকানা’ পরাজিতের। এই ‘ঠিকানা’ নিত্যদিনের, এই ‘ঠিকানা’ বিশেষ দিনের। এই ‘ঠিকানা’ লেখকের সুবিন্যস্ত ভাবনার, এই ‘ঠিকানা’ পাঠকের জিজ্ঞাসার উত্তরের। এই ‘ঠিকানা’ ক্ষুব্ধ, হতক্লান্ত বাঙালির, এই ‘ঠিকানা’ আনন্দে, উচ্ছ্বসিত বাঙালির। এই ‘ঠিকানা’ নবীন, যুবার, এই ‘ঠিকানা’ প্রবীণ, প্রাজ্ঞের।

এই ‘ঠিকানা’ বড় বিস্ময় জাগায়। প্রায় তিন যুগ ধরে প্রবাসের সঙ্গে স্বদেশের সেতুবন্ধ রচনা করে যাচ্ছে আনন্দ-বেদনার খবর দিয়ে। আমি অবাক হয়ে ভাবি, তেত্রিশ বছর আগের কথা। কল্পনায় ঘুরে আসতে চাই সেই দিনগুলো। পৃথিবীর ব্যস্ততম এক শহর নিউইয়র্ক। ঘড়ির কাঁটায় ঘোরে জীবন। সেই জীবন-জীবিকার দ্বন্দ্বে ছুটে চলা তুমুল ব্যস্ততম মুহূর্তে যারা ভেবেছিলেন একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা, স্যালুট জানাই তাদের। কী উদ্যম, সাহস, বুকভরা আশা নিয়ে সেদিন তারা এগিয়েছিলেন! বায়ান্নর চেতনাকে সঙ্গী করে শিকড়ের প্রতি কী গভীর টানে তারা নিজেদের মাতৃভাষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদে আগুয়ান হয়েছিলেন!

‘ঠিকানা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এম এম শাহীন ভাইকে একজন স্বপ্নচারী মানুষ হিসেবে জানি আমার কৈশোর থেকেই। ব্যতিক্রমী ভাবনা নিয়ে চলেন। আপাদমস্তক একজন সৃজনমনস্ক মানুষ। কিন্তু এতগুলো বছর ধরে একটি পত্রিকা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। তা-ও আবার নিউইয়র্কের মতো জায়গায়। কত ঝড়-ঝঞ্ঝা আছে প্রবাসজীবনে। কত লড়াই প্রতিদিনকার জীবনে। তবুও বৃত্তের বাইরে ভাবেন কেউ কেউ। নিজের বাইরে কেউ কেউ ভাবেন অন্যকে নিয়ে। ‘ঠিকানা’ পরিবার তেমনি একটি। নিজেদের কমিউনিটির কথা বলতে, বিদেশের মাটিতে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে এগিয়ে আসেন তারা। যতদূর জানি, এ চলার পথ মসৃণ ছিল না কখনো। তবু টিকে আছে ‘ঠিকানা’, এগিয়ে চলছে ‘ঠিকানা’। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটির যেকোনো সংকটে ‘ঠিকানা’ দাঁড়ায় তাদের সাহস হয়ে।

‘ঠিকানা’ তাই হয়ে গেছে নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালির সপ্তাহান্তের ডায়েরি। শুধু সংবাদ প্রকাশ নয়; সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমার চোখে ‘ঠিকানা’ শুধু নিছক একটি পত্রিকা নয়, একটি মুখপত্রও বটেও। এটা বুঝতে আমাদের খুব কষ্ট হয় না যে, প্রবাসে যারা থাকেন, তাদের মনটা সারাক্ষণ দেশের জন্য আঁকুপাঁকু করে। দেশের যেকোনো সুসংবাদ তাদের উৎফুল্ল করে যেমন, তেমনি মন খারাপের সংবাদে বিচলিতও হন। আবার কখনো কখনো একটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের প্রত্যাশা করেন, কখনো-বা আশা থাকে নিত্যদিনের সংবাদের বাইরে কিছু জানার, কিছু পড়ার। ‘ঠিকানা’ তাদের সেই পাঠতৃষ্ণা মেটায় সততার সঙ্গে। ‘ঠিকানা’র এই বিরামহীন পথচলাকে নানাভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। প্রবাসে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘ঠিকানা’ যে একটি ঐশ্বর্যমণ্ডিত নাম, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অধিকার আদায়ে, তাদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির খবরগুলো তুলে ধরে কমিউনিটির বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে ‘ঠিকানা’। বহু ভাষা ও সংস্কৃতির শহরে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চারও এক অনুপম প্ল্যাটফর্ম এই ‘ঠিকানা’। এই ‘ঠিকানা’ পথ দেখায়, এই ‘ঠিকানা’ পথ তৈরি করে।

‘ঠিকানা’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই অমল, উজ্জ্বল ক্ষণে আমি শুভেচ্ছা জানাই ‘ঠিকানা’ পরিবারের সবাইকে। কৃতজ্ঞতা জানাই শুরু থেকে যাদের শ্রমে-ঘামে বেড়ে উঠেছে পত্রিকাটি।
এই ‘ঠিকানা’র ঠিকানা হোক পাঠকের মনোভূমে। এই ‘ঠিকানা’ বেঁচে থাকুক বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরা হয়ে। এই ‘ঠিকানা’ পথ চলুক সাংবাদিকতার উজ্জ্বল পথ মাড়িয়ে।

লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক।