আবু সাঈদ রতন : বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও এখনো বোকাই রয়ে গেলাম। জীবনের পদে পদে বোকামি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাশীল দেশ এই আমেরিকায় এসেও বোকামির শেষ নেই। ১০ বছর হলো এই নিউ ইয়র্কে স্থায়ী হয়েছি। প্রথম দিন জেএফকে নামলাম, সঙ্গে পরিবার-পরিজন, অনেকগুলো লাগেজ। যথারীতি ট্রলি নিতে গেলাম। কী আশ্চর্য, ডলার ছাড়া ট্রলি মিলবে না! লক করা। প্রতি ট্রলি ১০ ডলার, মানে বাংলাদেশি টাকায় ৮০০ টাকা! আমি মনে করেছি এসব ফ্রি! কী আর করা, যা নিয়ম তা-ই করলাম। সঙ্গে ছোট ছেলে, বয়স মাত্র ৩ মাস। কান্না করছে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। চিন্তায় পড়ে গেলাম। আল্লাহ মালুম, কতক্ষণ সময় যে লাগে! আমাকে অবাক করে দিয়ে একজন সিকিউরিটি অফিসার এসে আমাদের লাইন থেকে বের হয়ে তাকে অনুসরণ করতে বললেন।
ভাবলাম যেহেতু বাচ্চাটি কান্নাকাটি করছে, তাই হয়তো আমাদের কোথাও নিয়ে বসিয়ে রাখবে। হয়তো-বা গালমন্দ করতে পারে!
আমার ধারণা ভুল! সঙ্গে ছোট শিশু, তাই লাইনে দাঁড়াতে হবে না। সবার আগে আমাদের কাগজপত্র চেক করে ছেড়ে দিল। এমনকি লাগেজগুলোও ভালোভাবে চেক করেনি।
অবাক তো হতেই হয়! একজন শিশুকে এত সম্মান!
দিন যায়, ম্যানহাটনে একটি রেস্টুরেন্টে জব করি। জবে পরের সময়টুকু ঘুরে বেড়াই। প্রায়ই দেখি ম্যানহাটনের রাস্তায় কালো কালো মেয়েগুলো স্ট্রলারে করে সাদা চামড়ার ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তো কোনোভাবেই হিসাব মেলাতে পারি নাÑএত কালো মেয়ের ঘরে এত সুন্দর, ফরসা বাচ্চা কীভাবে এল! কাউকে বলতে পারি না আমার মনের প্রশ্নগুলো। একদিন সাহস করে আমার একজন সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করতেই হেসে উত্তর দিলÑএ বাচ্চাগুলো ওদের নয়। ঘণ্টা হিসাবে বেবি সিটারের কাজ করছে। মনে মনে অবাক হলাম, আর ভাবলামÑআমি এত্ত বোকা!
একদিন দেখলাম প্রায় ৬-৭টি কুকুরের গলায় ফিতা বেঁধে একটি ২০-২২ বছরের ছেলে রাস্তা দিয়ে ঘুরছে। আমি তো অবাক, পরে জানলাম এরাও ডলারের বিনিময়ে কুকুর হাঁটাচ্ছে! আরো অবাক হই যখন দেখি কোনো কুকুর প্রাকৃতিক কর্ম করছে, তখন তার মালিক তার হাতে প্লাস্টিকের টিস্যু দিয়ে রাস্তা থেকে পরিষ্কার করছেন। আবার সেই লোকই কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বয়ান দিচ্ছেন।
মাথায় কিছু ঢুকছে না, কত বোকা আমি, কিছুই জানি না!
পথঘাট ঠিকমতো চিনি না বলে ঘরে বসেই সময় কাটে। তাই একদিন আমার এক বন্ধুর পরামর্শে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসে গেলাম। বিকেলবেলা, একটি রেস্টুরেন্টে বসে ২-৩ জন উচ্চস্বরে কথা বলছে। মনে হলো তারা এই প্রবাসের কোনো আঞ্চলিক সংগঠনের কর্মকর্তা। কীভাবে অন্য নেতাকে বহিষ্কার করা যায়, তারা তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। মনে মনে অবাক হলাম, এই সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পাড়ে এসেও সেই সমিতি, সংগঠন, মামলা, বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কারের মতো কর্মযজ্ঞ নিয়ে ব্যস্ত সবাই! আরো একটি জিনিস দেখে অবাক হলাম, রেস্টুরেন্টের দেয়ালে কাগজে লেখা : ‘এখানে কোনো প্রকার রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’; ‘উচ্চস্বরে কথা বলা নিষেধ!’ যত দেখি, ততই অবাক হই! বাথরুমে গিয়ে দেখলাম ছোট কাগজে লেখা : ‘যেখানে সেখানে টিস্যু ফেলবেন না’; ‘প্রস্রাব করার পর ফ্লাশ করুন।’ মনে মনে ভাবলাম, আল্লাহই জানে আরো কত কিছু দেখতে হবে!
সময়ের পরিক্রমায় এখন অনেক স্থানের এবং ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু অবাক বা বোকামি কিন্তু আমার এখনো যায়নি। কোনো প্রোগ্রামে কেউ দাওয়াত দিলে বেশ আগ্রহ নিয়েই অনুষ্ঠানে যাওয়ার চেষ্টা করি। যদি সময় থাকে সন্ধ্যা ৬টা, তবে আমি ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি। প্রায়ই দেখি, আমিই সেই অনুষ্ঠানের প্রথম অতিথি! এমনকি আয়োজকরাও ওই সময়ের মধ্যে হাজির হন না। সবাই আমাকে দেখে মিটিমিটি করে হাসে। কী বোকাই না আমি! সময়মতো উপস্থিত থাকার অর্থই হলো আমার কোনো কাজ নেই, তাই আগেভাগেই অনুষ্ঠানে যাওয়া! এখন জেনেছি অনুষ্ঠানের মাঝখানে যেতে হবে, কিছু সেলফি, বক্তৃতা দিয়ে জরুরি কাজ আছে বলে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে হবে; তবেই নাকি আমি স্মার্ট!
বাংলাদেশে যারা রাজনৈতিক কর্মী হওয়ারও যোগ্যতা রাখেন না, তারাই এখানে বিশিষ্ট রাজনৈতিক লিডার! অনেকে আছেন কবিতার চার লাইন ঠিকমতো মেলাতে পারে না, তারা এখানে ‘বড় কবি’। নিজের মেধা না থাকুক, অন্যের মেধা চুরি করে, কিছু শব্দ এদিক-ওদিক বসিয়ে দিয়েই ‘বড় সাহিত্যসেবী’ এই প্রবাসে অহরহ।
সবক্ষেত্রেই এই প্রবাসে জগাখিচুড়ি মার্কা কিছু বিষয় চোখে পড়ে। এর ভেতর থেকে প্রকৃত মানুষ খুঁজে নিতে অনেক কষ্ট পেতে হয়। ডলারের ক্ষমতায় অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ হয়। তাইতো সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হয়। সবাই ‘কাক চালাক।’
একবার বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। পুরো অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ কথা দুটি একবারও উচ্চারিত হয়নি। আমি তো অবাক, স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা, অথচ এই দুটি শব্দ উচ্চারণই হলো না! পাশের এক ভদ্রলোককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি আমার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন এবং বললেন, আপনি বোকা নাকি? যারা অনুষ্ঠান করছে তারা এই দুটি বিষয় পছন্দ করে না। তাই তাদের মতো করেই অনুষ্ঠান করছে।
আর এসব আমি পারি না বলেই অনেকে আমাকে বলেন বোকা। আমি এতে আজ আর অবাক হই না। বাকি জীবনটা যেন এ রকম বোকা হয়েই থাকতে পারি।
আমি যেন ‘বোকার স্বর্গে’ বসবাস করছি!
লেখক : সম্পাদক, ইউএস বাংলা নিউজ, নিউ ইয়র্ক।