একজন অসহায়া মায়ের কাহিনি

মোহাম্মদ জামান খোকন

এ বছর ১৩ মে আমরা সারাবিশ্বের মানুষ মা দিবস পালন করছি। আমার মা ১৯৭৭ সালের ২৪ জুলাই এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছেন। সবসময় প্রাণ ভরে দোয়া করছি আল্লাহ সোবহান তায়ালা যেন পরপারে তাঁকে শান্তিতে রাখেন। আমার মায়ের নাম জামিলা খাতুন। তিনি খুব দুঃখী মহিলা ছিলেন। তার এক ছোট ভাই ছিলেন। ছোট থাকতেই আমার মা তাঁর মা-বাবাকে হারান। তিনি তাঁর চাচা-চাচির কাছে মানুষ হন। তাঁদের, আমি নানা-নানি বলে ডাকতাম। এখনও মনে আছে, নানা-নানি আমার মাকে ঠিক তাদের আপন সন্তানের মতোই স্নেহ করেছেন।
আমার বাবা, জেঠা, চাচারা পাঁচ ভাই ছিলেন। তাঁদের কোন বোন ছিলো না। যথাক্রমে- বাদশা মিঞা, উজির আলী, কলিম উদ্দিন, এয়াকুব আলী ও আকামত আলী। আমার বাবা ছিলেন ৪র্থ। আমার বাবার দুই বিয়ে হয়েছিল। প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর আমার মার সাথে বিয়ে হয়। আগের মায়ের ঘরে আমার ভাই আছেন। পরে আমার জন্ম হয়। আমার আগে তিন বছর বয়সের এক বোন মারা যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিকট আমার খুব বেশি আদর ছিলো। আমার বড় ভাইকে ছোট সময় লালনপালন করেছেন আমাদের দাদি মরহুমা সাকিনা বিবি। আমার কাকার নাম আকামত আলী। তিনি মারা গেছেন আমার মাত্র ২ বছর বয়সে। কাকার সন্তান, এক মেয়ে মঞ্জু আপা ও এক ছেলে বাবুল। প্রসঙ্গত, আমার বড় ভাইয়ের নাম মনিরুজ্জামান মণি। যাহোক, আমরা ছিলাম একান্নবতী পরিবার, এখনও তাই আছি। কুমিল্লা শহরে আমাদের বাসা মহিলা কলেজ রোডে। বাসার নাম ‘উত্তমাশা।’ যেহেতু আমরা যৌথ-পরিবার, কুমিল্লার বাসায় আপন ও চাচাতো ভাইবোন মিলে এক সাথে তাকতাম। মা-বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। আমার চাচাতো বোন মঞ্জু আপা, তার স্বামী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষিক এবং মহসিন হলের হাউস টিউটর ছিলন। তিনি ১৯৭২ সালে আমেরিকা আসেন, পিএইচডি করে আর দেশে ফেরত যাননি। আপাও ৭৫ সালে আসেন, তাদের ১ ছেলে ও এক মেয়ে; নাম কাজল ও পিয়া। আমার চাচাতো ভাই বাবুল বয়সে আমার তিন মাসের ছোট। আমরা ছোট থাকতেই এক সাথে বড় হয়েছি। দুজনে বন্ধু এবং ভাই। প্রথম শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আমরা একসাথেই চলাফেরা করেছি। এক রকম জামা, সিনেমা দেখা, কোথাও বেড়াতে যাওয়াসহ সবকিছুই একসাথে করতাম। কলেজে উঠে আমরা ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। ১৯৮০ সালে সে এদেশে আসে। আসার আগে সে কুমিল্লা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপত্বি ছিলো।
আমার মা ১৯৭৭ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন । তিনি একটু হাল্কা চিকন-চাকন ছিলেন। তখন বর্ষাকাল, আমাদের গ্রাম থেকে তাকে বাসায় আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাঁচা রাস্তা, এখন অবশ্য পাকা হয়ে গেছে। ডাক্তার বাড়িতে নেয়া হয়। তার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। ক্রমে ক্রমে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। তাকে নিচে বিছানা করে শোয়ানো হয়। একদিন রাতে দেখি তিনি বিছানা থেকে একটু সরে গিয়ে দেয়ালের কাছে চলে আসেন। ঘরটি মাটির তৈরি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করিÑ এখানে কিভাবে আসলেন? বললেন- আমায় মা-বাবা-চাচা এসে বলছেন, তুই এতো কষ্ট পাচ্ছিস, আমাদের কাছে চলে আয়! আমার তখনও লেখাপড়া শেষ হয়নি। তখন আমি বললাম, আমার কি হবে আপনি চলে গেলে? তিনি বললেন- যেভাবেই পারিস মঞ্জুর কাছে চলে যাবি, এটাই আমার দোয়া। এর দু দিন পরেই তিনি মারা যান।
আমার মা লেখাপড়া জানতেন না, কিন্তু জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি বুঝেছেন, মঞ্জুর জামাই পারবে তার ছেলেকে সাহায্য করতে। যাই হোক, মায়ের সেই দোয়াই আল্লাহ সোবহান তায়ালা কবুল করেছেন। সাথে অবশ্যই আমার বাবা ও অন্যান্য মুরব্বীদের দোয়াও ছিলো। ১৯৮৯ সালের ৬ মে আমরা স্বামী-স্ত্রী একসাথে এ দেশে আসি। আমাদের ছেলে ফরহাদ জামান অসীম ১৯৯১ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। দেশে থাকতে অবশ্য আমরা ১টি কন্যা সন্তান হারিয়েছিলাম। আপা ও আমরা একই শহরে বসবাস করছি। আজও যে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আপা-দুলাভাইয়ের পরামর্শ নেই। মা যেভাবে পরামর্শ ও উপদেশ দিতেন, সেভাবেই জীবনে সেগুলো কার্যকরী করে যাচ্ছি। এই মা দিবসে প্রাণভরে আমার মায়ের জন্য, শাশুড়ি, বাবা ও শ্বশুর সাহেবসহ মুরুব্বীদের জন্য দোয়া করছি। মহান সৃষ্টিকর্তা যেনো তাদের পরপারে শান্তিতে রাখেন।
১৯৭৪ সালের দিকে ফাল্গুন-চৈত্র মাসের দিকে একবার বিশেষ প্রয়োজনে আখাউড়া গিয়েছিলাম। বিকালে ফেরার সময় প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। কুমিল্লার গোমতী নদীর পুলের উত্তর দিকে রাজাপুর বা নয়নপুর স্টেশনের কাছে একটি পুল ভেঙে রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে সিদ্ধান্ত হয় দক্ষিণ দিক থেকে আসা সব ট্রেন দক্ষিণ দিকে যাবে, আর উত্তর দিক থেকে আসা সব ট্রেন উত্তর দিকে ফেরত যাবে। আখাউড়া ও লাকসাম জংশনে গিয়ে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী আর সিলেট ও ঢাকার ট্রেন যাত্রীরা যার যার গন্তব্য স্থানে যাবে। আমরাও সব যাত্রীরা তখন দক্ষিণ দিকের ট্রেনের দিকে যাচ্ছি, তখন দেখি হঠাৎ এক মহিলা খুব জোরে কান্নাকাটি করছেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেন, তার স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাবেন, বাপের বাড়ি কুমিল্লার দৌলতগঞ্জে। সাথে বুড়ো মা। তার মার হাঁটতে কষ্ট হয়, ধরে ধরে হাঁটাতে হয়। সাথে ছিলো ছোট দুই ছেলে। তারা ট্রেন বদলের কথা শুনেই দৌঁড়ে চলে আসে দক্ষিণ দিকের সেই ট্রেনে সিট দখলের জন্য। সবাই তখন ব্যস্ত, জিনিসপত্র ও পরিবার-পরিজনকে নিয়ে রাস্তায় চলে যাচ্ছেন। দেখে মনে খুব কষ্ট হলো। চিন্তা করছি কিভাবে তাদেরকে সাহায্য করা যায়। তখন নোয়াখালীর ১টি ছেলেও এগিয়ে আসে তার বিলাপ শুনে। আমার সাথে কিছুই ছিলো না। ঐ লোকের সাথে ছোট একটা ব্যাগ। মহিলার সাথে কাপড়ের ব্যাগ। তখন দুজনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, সেই বৃদ্ধা মহিলাকে পাঁজাকোলা করে আমরা তাকে ঐ ট্রেনের কাছ নিয়ে আসবো। আল্লাহর রহমত, তখন ছিলো চাঁদের আলো, আর মাত্র ধান বোনা হয়েছে, জমিও শুকনা। আমরা দুজনেই তাকে এভাবে এনেছি। কিছুক্ষণ পরপর আমি এপাশে উনি ওপাশে গিয়ে সাইড বদল করেছি। আধা মাইলের চেয়ে কিছু কম দূরত্ব ছিলো দুই ট্রেনের মধ্যে। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ট্রেনের কাছে আসার পর সেই মহিলা তার ছেলেদের নাম ধরে ডাকেন। তাদের খুঁজে পাওয়া যায়। দুজনে মিল তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেই। সব যাত্রীরা ট্রেনে উঠার পর প্রায় আধা ঘণ্টা পরে ট্রেন দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে। আমি কুমিল্লাতে নেমে যাই। ঐ মহিলা আমাকে ধর্মের ভাই ডাকেন। সাথে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন বা পরে যাওয়ার জন্যও অনুরোধ করন। আমি বলি, জীবনে হয়তো দেখা হবে না, দোয়া করবেন। সেই অসুস্থ মার কাছ থেকেও দোয়া চেয়ে বিদায় নেই। আজ এতো বছর পরে সেই কথা আবার মনে পড়েছে। আসলে মহান আল্লাহ সোবহান তায়ালা কাউকেই বিপদে রাখেন না। তিনি কোন বা কোনভাবে সবাইকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
আসুন এই মা দিবসে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, যাঁদের মা-বাবা বেঁচে আছেন তারা যেনো তাঁদের সেরাযতœ করেন। যাঁরা এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, তাদের জন্য সব সময় নামাজ পড়ে দোয়া করি। সৃষ্টিকর্তা যেনো তাদেরকে পরপারে শান্তিতে রাখেন। আমাদের প্রিয় নবীকে (স.) এক সাহাবি জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর প্রিয় নবী, পিতা-মাতার মাঝে সবচেয়ে কাছের কে? নবী করিম (স.) তিনবার বলেছিলেন তোমার মা। চতুর্থবার বলেছিলেন তোমার পিতা। সুতরাং এ থেকেই বোঝা যায়, কার মর্যাদা বেশি।
আমরা পত্রপত্রিকা বা বর্তমানে ফেসবুকের বদৌলতে দেখি কিভাবে মায়ের প্রতি অবজ্ঞা করা হয়। কিছুদিন আগে পড়েছি, একজন বিসিএস কর্মকর্তা তার মাকে রেলস্টেশনে রেখে চলে আসেন! কারণ তার স্ত্রী শাশুড়িকে মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তীতে এক ভদ্রলোক তাকে উদ্ধার করেন। ছেলের নাম জানতে চাইলে মা নাম বলেননি, পাছে ছেলে লজ্জা পাবে। মায়েরা সবসময়ই সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন।
ঠিক তার উল্টোটাও আমরা দেখেছি হানিফ সংকেতের সর্বশেষ ইত্যাদি পর্বে। এক মহিলা, সম্ভবত নাম আনোয়ারা। নেদারল্যান্ডে থাকেন। ছোট থাকতেই তারা দুবোন মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিদেশে অন্য মা-বাবার কাছে মানুষ হয়েছেন। দুবোনের মিলন ঘটেছে, কিন্তু মার সন্ধান পাননি সেই আনোয়ারা। তাই ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি আবেদন জানিয়েছেন কেউ যদি তার মায়ের সন্ধান দিতে পাবেন। হানিফ সংকেত আনোয়ারার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় তিনি কথা বলেছেন, বিদেশে বড় হয়েও তিনি তার শিকড়ের সন্ধানে বাংলাদেশে গিয়েছেন, মাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য। আমরাও দোয়া করি মহান আল্লাহ সোবহান তায়ালা যেনো আনোয়ারা আশা পূর্ণ করেন। তিনি যেনো তার মায়ের সাক্ষাৎ পান।
এই মা দিবসে আবারও মা-বাবা ও মুরুব্বীদের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করছি সৃষ্টিকর্তা যেনো তাদের পরপারে শান্তিতে রাখেন। আর আমাদের যাঁদের মা-বাবা বেঁচে আছেন, তাদেরকে যেনো খুব যতেœর সাথে সেবা করতে পারি, এ শক্তি যেনো আল্লাহ সোবহান তায়ালা আমাদেরকে দেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেনো, আমরা যেনো পিতা-মাতার উপদেশ মোতাবেক চলতে পারি, আল্লাহ সোবহান তায়ালা যেনো আমাদের সেই শক্তি দেন, এ প্রার্থনাই করি। হে সৃষ্টিকর্তা তুমি আমাদের সহায়। আমিন!
-পোকিপসী, নিউইয়র্ক।