নিজস্ব প্রতিবেদক : বাচ্চু। পুরো নাম মমিনুল হক বাচ্চু। প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস এঞ্জেলেসে বসবাসরত এক অতি পরিচিত প্রবাস বন্ধুর নাম মমিনুল হক বাচ্চু। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের পথ পরিক্রমায় তিনি নিজেকে কমিউনিটির সকল স্তরের মানুষের কাছে সমভাবে গ্রহনযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন। খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে জানেন তিনি। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে তার পৈত্রিক নিবাস। পিতার চাকরি সূত্রে লেখাপড়া করেন করাচীতে। ঢাকার মণিপুর পরবর্তীতে মগ বাজারে বড় হওয়া বাচ্চু দেশ ছাড়েন ১৯৭৭ সালে। প্রথমে জামার্নিতে কয়েক বছর থেকে ১৯৮২ সালে চলে যান নিউ ইয়র্কে। এক পর্যায়ে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে আসেন লস এঞ্জেলেসে। শুরু করেন ট্রাভেল ব্যবসা।
সময়ের পরিক্রমায় মমিনুল হক বাচ্চুর মধ্যে পরোপকারের যে অতুলনীয় গুনটি দেখা যায় তা কমিউনিটির সকলকে মুগ্ধ করে। এত নিরলস এবং নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করার মানসিকতার মানুষ সমাজে সচরাচর দেখা যায়না। আমাদের দেখা মতে কমিউনিটির কোন সমস্যায় কেউ খবর দিলে, হউক দিনের ৩টা বা রাতের ৩টা, কাল বিলম্ব না করে তিনি পৌঁছে যান সমস্যা পিড়িত মানুষটির পাশে। বিপদে আপনি তাঁকে পাশে পাবেন একথা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়।
পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্খী থেকে দূরে থাকা প্রবাস জীবনে যে জিনিসটি মানুষের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তা হলো বিপদে কাউকে পাশে পাওয়া। সে কাজটি তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে করে থাকেন। কারো অসুস্থতার খবর শুনলে বা কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তিনি সবার আগে ছুটে যান একেবারে ঘনিষ্ঠজনদের মত। কমিউনিটির কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির পরিবারের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহস জোগান এই মানুষটি। সবচেয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়ার মত যে কাজটি তিনি করেন তা হলো মৃতদেহ দাফন প্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। পুরা প্রক্রিয়টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সাথে করে থাকেন। মৃত ব্যাক্তির পরিবারের কাছে এই সহযোগিতাটি সত্যিই অভাবনীয় যা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারেন।
আরো গুরুত্বপুর্ণ যে কাজটি তিনি করেন তাহলো মৃতদেহ দেশে প্রেরণ। এই মানবিক কাজটির জন্য তিনি একক কৃতিত্বের অধিকারী। মৃতদেহ হিমাগরে রাখা, ফ্লাইট বুকিং দেয়া থেকে শুরু করে দেশে মৃত বক্তির স্বজনদের সাথে যোগাযোগ এ সবই তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে করে আসছেন।
এই প্রবাস জীবনে আপনি চাইলে অন্যের কাছে সাহায্যের হাত না বাড়িয়েও অনেক কিছু করতে পারবেন, যেমন- টাকা পয়সার প্রয়োজনে ক্রেডিটকার্ডের সহযোগিতা নিতে পারেন, অসুস্থ হলে ৯১১ কল দিয়ে হাসপাতালে যেতে পারেন কিন্তু একজন মানুষের মৃত্যুর পর দাফন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কাজগুলো অন্যকেই করতে হয় যা এই মানুষটি নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন।
লস এঞ্জেলেসে বাংলাদেশ কমিউনিটি তথা বাংলাদেশের জন্য গৌরবময় যে কাজটি বাচ্চুর নেতৃত্বে হয়েছে তা হলো লস এঞ্জেলস সিটির বেশ কিছু অংশ নিয়ে তৈরী হওয়া ‘লিটল বাংলাদেশ’ যা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
গত বছরের মার্চ মাসে লস এঞ্জেলেস সিটির লস ফিলেজের উপর একটি গ্যাস স্টেশনে কৃষ্ণাঙ্গের গুলিতে মিজান নামের একজন বাংলাদেশি প্রাণ হারান। তখন ভোর পাঁচটা। নিহত মিজানের সহকর্মী ঘটনা জানার পর হতবিহবল হয়ে প্রথমেই যার কথা মনে হয়েছিল তার নাম মমিনুল হক বাচ্চু। তাঁকে ফোন করার দশ মিনিটের মধ্যে তিনি ঘটনাস্থলে হাজির হন। পুলিশের সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল আনুষ্ঠানিকতা এবং দেশে মৃতের বাবা-মার সাথে যোগাযোগ পরবর্তীতে মৃতদেহ দেশে প্রেরণ সবই তিনি নিজ উদ্যোগে করেছেন। তাঁর জীবনে এধরনের অসংখ্য ঘটনা আছে।
কথা প্রসঙ্গে মমিনুল হক বাচ্চু বলছিলেন, প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে তাঁর উদ্যোগে এবং শংকু আইচ ও আবেদ – এর সহযোগিতায় বাংলাদেশি অধ্যুষিত শ্যাটা রিক্রেয়েশন সেন্টারের পাদদেশে একটি শহিদ মিনার নির্মাণের লক্ষ্যে সিটি কাউন্সিলে আবেদন, বেশ কয়েকটি মিটিং করা সহ যাবতীয় কাজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নকশা নিয়ে জটিলতার কারনে তখন সিটি থেকে তা অনুমোদন পায়নি। পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বে ২০১১ সালে আবার আবেদন করা হয়েছে এবং প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আশা করা যায় খুব শীঘ্রই সিটি থেকে এটি নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যাবে।
জনাব বাচ্চু বলেন, ধর্মীয় উৎসবগুলিতে স্কুল ছুটির বিষয়ে অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটির সাথে একত্রিত হয়ে দুই ঈদে দুইদিন স্কুলগুলোতে ছুটি ঘোষণার আবেদন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা অনেক দুর এগিয়ে গেছে। আশা করা যায় খুব শীঘ্রই সিটি কাউন্সিল থেকে এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসবে ।
এছাড়াও তার উদ্যোগে ক্যালিফোর্নিয়া ডিএমভি-র ড্রাইভিং ব্রসিউর বাংলায় অনুবাদের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় বাংলা ভাষাভাষীরা অচিরেই বাংলায় অনুদিত ড্রাইভিং ব্রসিউর দেখতে পাবেন।
এছাড়াও তিনি কমিউনিটির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়তই সিটি মেয়র ও অন্যান্য পদস্থ কর্তাব্যক্তিদের সাথে মত বিনিময় করে থাকেন।
কমিউনিটির বিনোদনের জন্য আয়োজিত বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন- বৈশাখী মেলা, আনন্দ মেলা, চাঁদরাত উদ্যাপন, পিঠামেলা ইত্যাদি সকল আয়োজনেই তার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।
বাচ্চু বলছিলেন ২০১৭ সলের জুন মাসের দিকের কথা, বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিয়ে বর্ডার পার হয়ে আসা ৭/৮ জন বাংলাদেশি যুবক যারা ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছাড়া পেয়ে বাচ্চুর খোঁজ করতে বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকায় আসে। তাদেরকে ইমিগ্রেশন অফিসারই নাকি বাচ্চুর সাথে যোগাযোগ করতে বলে দিয়েছে। পরবর্তীতে বাচ্চু তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং নিজের আইডি দিয়ে মোটেলে রুম নিয়ে দেন।
এছাড়াও নতুন কেউ এদেশে আসলে তাদের থাকা ও চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এমন সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ১৯৯৭ সালে কমিউনিটির প্রত্যক্ষ ভোটে বাচ্চু কমিউনিটির নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তিনি প্রবাসি সকল বাংলাদেশির প্রতি আহবান জানিয়েছেন যে, সকল ভেদাভেদ ভুলে আমরা যেন সবাই মিলেমিশে থাকি, আমাদের কোনো কর্মকান্ডে দেশের যেন বদনাম না হয় সেদিকে যেন আমরা খেয়াল রাখি।
বাচ্চু বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীরা আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে। আমিও তাদেরকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি । তিনি বলেন, আমি ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নই। আমার ভুল ধরিয়ে দিলে খুশি হবো এবং সাথে সাথে সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করবো এবং ক্ষমা চেয়ে নিব।
বাচ্চু প্রবাসে বসবাসরত বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সফলতায় নিজের গর্বের কথা জানিয়েছেন। তারা বাবা-মা র পাশাপাশি দেশেরও মুখ উজ্জ্বল করছে। কৃতজ্ঞতা তাদের জন্য ।
বাচ্চুর সহধর্মিনী শারমিন লস এঞ্জেলেসে একটি স্কুলে ক্যাফেটরিয়াতে কাজ করেন। একমাত্র কন্যা ফরহানা হক ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া রিভারডেলে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। একমাত্র পুত্র ওয়াকি হক দশম শ্রেণির ছাত্র। সন্তানেরাও মা-বাবার মতো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছেন।
স্বাধীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাচ্চু বলেন, স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, আমাদের গর্ব। তারাই আমার কাছে সবচেয়ে সম্মানীত মানুষ। তাদের প্রতি কোনো ধরনের অবহেলা আমাকে খুব কষ্ট দেয়।
বাচ্চু বলেন, সাধারণ মানুষ হিসাবে বাস করছি। মানুষের ভালোবাসা নিয়েই যেন শেষ সময় পর্যন্ত থাকতে পারি এটিই আমার কাম্য। তার মতে, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পদ-পদবির দরকার হয় না। তবে এক্ষত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিবারের সমর্থন। আমি আনন্দের সাথে বলতে পারি যে আমার কোনো কাজেই আমার পরিবারের কেউ বাধা দেয় না। এ জন্য যখনই করো কোনো প্রয়োজন হয় আমি ছুটে যেতে পারি রাত ৩টা বা ভোর ৫টা কোনো ব্যাপারই না। যারা সত্যিকার অর্থে মানুষের জন্য কাজ করেন তারাই আমার প্রকৃত বন্ধু। এক্ষেত্রে সব সময় নিজেকে দল মতের উর্দ্ধে রাখি।
মমিনুল হক বাচ্চু সমাজ সেবায় অসামান্য অবদান রাখার জন্য সিটি অব লস এঞ্জেলেস থেকে লোটাস এওয়ার্ড, বাফলা এওয়ার্ড, বালা এওয়ার্ড, লস এঞ্জেলেস সিটি মেয়র এরিখ গার্সিটি থেকে এওয়ার্ডসহ অসংখ্য এওয়ার্ড পেয়েছেন।
সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল এই অসাধারণ গুনের অধিকারি মানুষটির সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা কারেন আন্তরিকভাবে কম্যুনিটির সকলেই।