একজন মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়াটা খুবই জরুরি

জান্নাতুল ফেরদৌস (সুমা রহমান) :

আমি বরিশাল বিএম কলেজ থেকে সমাজকল্যাণ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমাদের সমাজকল্যাণ ডিপার্টমেন্টের অধিকাংশ মেয়েই দেখতে খুব সুন্দরী ছিল। তাদের অধিকাংশই খুব পরিপাটি এবং সাজগোজ-প্রিয় ছিল। তাই অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা সমাজকল্যাণ ডিপার্টমেন্টকে লিপস্টিক ডিপার্টমেন্ট নামেও ডাকত।

ডিপার্টমেন্টে এক বড় আপুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সৌজন্যমূলক কথার একপর্যায়ে জানতে পারি, তার বাড়িও ভোলা জেলায়। তার পর থেকে ডিপার্টমেন্টে প্রায় সময়ই আপুর সঙ্গে দেখা হতো এবং সৌজন্যমূলক কথাবার্তাও হতো।

সুন্দর বলতে আমরা যে রকম বুঝি, আপু মোটেও সে রকম ছিল না। শ্যাম বর্ণের, রোগা-পাতলা, মুখে দাগ, পোশাক-আশাকে খুবই সাধারণ, নম্র-ভদ্র, খুবই কাঁচুমাচু টাইপের ছিল। দেখলে কেমন যেন খুব মায়া মায়া লাগত। যেহেতু একই জেলায় আমাদের বাড়ি, তাই মাঝেমধ্যে ভোলা টু বরিশাল লঞ্চে উঠলেও আপুর সঙ্গে দেখা হতো। ভোলা থেকে বরিশাল যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগত। লঞ্চে এই তিন ঘণ্টা গল্প করার মানুষ পেলে খুব ভালোই লাগত। গল্পের সুবাদেই জানতে পারলাম, আপুরা আট বোন, কোনো ভাই নেই। বোনদের মধ্যে আপুই সবার বড়। আপু আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিল। বিভিন্ন সময় আপু আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। নোট দিয়েছে, নতুন জায়গায় অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে সাহায্য করেছে। বড় বোনের মতো কখনো কখনো খাবারের কোনো কিছু কিনে দিয়েছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের অনেক বন্ধুবান্ধবীর কাছে জানতে পারি, আপুর বিয়ে হচ্ছে না। পাত্রপক্ষ আপুকে দেখে পছন্দ করে না। বিয়ে ভেঙে যায়।
আপু যেহেতু বড়, তাই তার অন্য ছোট বোনদেরও বিয়ে দিতে পারছে না তার পরিবার। মাঝখানে অনেক সময় আপুর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। তখনকার সময় মোবাইলের ব্যবহারও খুব বেশি ছিল না। আপুর মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে আমার আর কখনো যোগাযোগ হয়নি।

অনেক দিন পর পরিচিত একজনের কাছে জানতে পারি, আপুর বিয়ে হয়েছে। খবরটা শুনে এত খুশি হয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তারপর আমারও বিয়ে হয়। তখন আমি এবং আমার পরিবার ঢাকায় বেশি থাকতাম। আমেরিকা কবে আসব সেই চিন্তা। কাগজপত্র লাইন করা, অন্য রকম সব চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

সেই সময়টায় অনেকের সঙ্গেই আমার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিছুদিন আগে আমার এক সহপাঠীকে ফেসবুকে খুঁজে পাই এবং তার সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা হয়। ওই সহপাঠীর কাছেই জানতে পারি, সেই আপুটা আর আমাদের মাঝে নেই। আপুটা মারা গেছে। আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভালো ছিল না। আপুর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করত। আপু যখন মারা গেছে, তখন আপুর বিয়ের দুই বছরও পূর্ণ হয়নি। কী মর্মান্তিক।

আমাদের সমাজে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত কত শত নারী এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার কোনো হিসাব আমাদের জানা নেই। সংসার ভেঙে যাবে, সমাজ কী বলবে, পরিবার-পরিজনের কী হবে-এসব ভেবে অনেক শিক্ষিত, মার্জিত মেয়েও মুখ বুজে সকল নির্যাতন সহ্য করে যায়। আর মুখ বুজে সহ্য করার শেষ পরিণতি হচ্ছে করুণ মৃত্যু।
আমি বলব, একজন মেয়ের সবচেয়ে আপনজন হচ্ছে তার পরিবার। কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হলে সেটা তার পরিবারের সঙ্গে
শেয়ার করা উচিত। আর পরিবারের মানুষগুলোরও উচিত সমাজকে ভয় না করে তাদের মেয়েকে সাপোর্ট করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়াটা খুবই জরুরি। আর নির্যাতনের শুরুতেই মুখ বুজে সহ্য না করে তাদের মুখোশ সবার নিকট তুলে ধরা উচিত। প্রতিটি মেয়েরই উচিত নিজেকে রক্ষা করার মানসিক ও শারীরিক সাহস অর্জন করা। সমাজের সবারই উচিত নারীদের যথাযথ সম্মান ও সমর্থন করা।

-নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখিকা।