দলিলুর রহমান :
পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা রথটি পুড়িয়েই শান্ত হয়নি, একদিন মির্জাপুরে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেককে খুন, ধর্ষণ করে রণদা ও তার একমাত্র ছেলে রবীন্দ্র প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসেননি।
পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে, তখন বয়স কত হবে? সবে প্রাইমারি স্কুলে পড়ি হয়তো-বা। সেই সময় একদিন আষাঢ় মাসে ধামরাই রথ মেলায় গিয়েছিলাম। সে সময় আমরা এই মেলায় যাওয়ার জন্য গোটা বছর ধরে প্রস্তুতি নিতাম। নানাভাবে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে জমা করে রাখতাম মেলায় যাওয়ার জন্য। ধামরাই রথ মেলা আমাদের জন্য একটি বিশেষ ব্যাপার ছিল, এখনো আছে। আমার চাচারা কখনো মেলায় যেতেন না কিন্তু আমার বাবা আমাদেরকে নিয়ে মেলায় যেতেন, বিশেষ করে রাতে। আমরা মেলায় গিয়ে সার্কাস দেখতাম আর পেটভরে ধামরাইর রসগোল্লা খেতাম। ওদিনকার ঘটনাটা এখনো মনে আছে, যা ছিল দিনের বেলা। ধামরাই রথখোলা ও বাজারের মাঝখান দিয়ে যে প্রধান রাস্তা, যার দুই পাশে দোকানপাট দোতলা তিনতলা বাড়িঘর, সেই রাস্তার পূর্ব পাশ থেকে পশ্চিম পাশে যাচ্ছি।
তখন কে যেন আমার হাত ধরে ফেলল। খেয়াল হতেই দেখতে পেলাম একজন সুপুরুষ, কে একজন তার মাথার উপর ভীষণ বড়, মানে প্রকাণ্ড একটা ছাতা ধরে রেখেছে। তার চারপাশে প্রায় এক ডজন লোক। তাদেরই একজন আমার হাত ধরে রেখেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও, ওকে ধরেছ কেন, যেতে দাও।’ লোকটি তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিল। আমি তার সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে এপারে এসে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলাম। আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ইনিই রণদাপ্রসাদ সাহা। আমরা ছোটবেলায় এই লোকটাকে দেখার জন্য পাগল ছিলাম, কারণ গ্রামে সবার মুখে তার গল্প শুনতাম। আমি ওই দিনই মাত্র নিকটতম দূরত্ব থেকে তাকে দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ভাবনায় ও চিন্তায় আরো বেশি কাছের ছিলেন। তিনি যে দানবীর ছিলেন, সেটা আমরা সে সময় থেকেই জানতাম এবং তার সে প্রভাব আমাদের অনেকের মনে দারুণভাবে পড়েছিল এবং কেবলই ভাবতাম, ‘আহা, যদি এমন একজন মানুষ হতে পারতাম।’
প্রত্যেকটা মানুষেরই ইতিহাস আছে, তবে তিনি যদি কোনো মহৎ ব্যক্তি হন, তার ইতিহাসটা আলোচ্যমান। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার জীবনেতিহাসও আমাদের চমৎকৃত করে। তার ভাতিজা কবি ও সাংবাদিক অরুনাভ সরকারের লেখা থেকে জানা যায়, রণদা প্রসাদ সাহার নিবাস টাঙ্গাইলের মির্জাপুর হলেও তার জন্ম শিমুলিয়ায় মাতুলালয়ে। শিমুলিয়া আমাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। কারণ, তখন আমাদের গ্রাম থেকে নিকটতম দূরত্বে শিমুলিয়া বাজার ছিল। শিমুলিয়া হাইস্কুলের মাঠে আমরা ফুটবল খেলা দেখতে যেতাম। যা হোক, রণদা ১৫ নভেম্বর ১৮৯৬ সালে সেই শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা। রণদার বয়স যখন সাত বছর, তখন তার মা কুমুদিনী মারা যান বিনা চিকিৎসায় এবং প্রায় অনাহারে। ছোটবেলায় মা হারালে যা হয়, রণদার দিন কাটে অনাদরে-অবহেলায়। ১৬ বছর বয়সে তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানেই তাকে মিস্ত্রির কাজ, খবরের কাগজ বিক্রি থেকে শুরু করে এহেন কাজ নেই, যা করতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রণদা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট অ্যাম্বুলেন্স কোরে যোগ দেন। একদিন সামরিক হাসপাতালে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। রণদা ঝাঁপিয়ে পড়ে কয়েকজন মুমূর্ষু রোগীকে রক্ষা করেন। এ ঘটনার পর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জন্য অভিনন্দনের ডালি নিয়ে আসেন। এরপর যোগ দেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে, যে রেজিমেন্টে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
যুদ্ধ শেষে ইংরেজরা তাকে শিয়ালদহ রেলস্টেশনে টিকিট কালেক্টরের চাকরি দেয়। তিনি বেশি দিন সেই চাকরি করেননি। শুরু করেন লবণ ও কয়লার ব্যবসা। তার তখন তেমন পুঁজি ছিল না, তবে তিনি ছিলেন সৎ ও অত্যন্ত পরিশ্রমী। ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায় এবং তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তখন বেঙ্গল রিভার নামে একটি নৌযান কেনেন এবং মেরামতের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন একটি ডক ইয়ার্ড। সেই সঙ্গে তিনি বেঙ্গল রিভার সার্ভিস নামে একটি নৌপরিবহন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
শৈশবের কথা। আমার এক আত্মীয় ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফেললে তাকে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। বলতে গেলে, এই প্রথম একটি হাসপাতাল দেখা, যেখানে রোগীরা বিনা মূল্যে চিকিৎসা, পরামর্শ ও নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকেন। তখন কুমুদিনী হাসপাতাল দেশের অন্যতম এবং এর বিশালতা দেখে এবং এটি এক মহান ব্যক্তির দান জেনে আমার শৈশবমনে একধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করে। রণদাকে দেখার ও জানার একটা অদম্য কৌতূহল আমার ভেতরে কাজ করত। ১৯৪২ সালে বাংলাদেশে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই খাদ্য সংকটে তিনি দেশের বিভিন্ন অংশে মোট ২৭৫টি লঙ্গরখানা চালু করে আট মাস ধরে হাজার হাজার মানুষকে বাঁচান। এ সময় তিনি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সব সম্পদ এতে ন্যস্ত করেন। শিক্ষাদান ও দেশের লোকের স্বাস্থ্যসেবাই ট্রাস্টের প্রধান কাজ। এই উদ্দেশ্যেই মির্জাপুরে লৌহজং নদীর তীরে প্রথমে প্রতিষ্ঠা করা হয় শোভা সুন্দরী ঔষধালয়। পরে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করা হয় কুমুদিনী হাসপাতাল। ১৯৪৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তখনকার অবিভক্ত বাংলার গভর্নর কে সি (কবংংু) হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। রণদার ঠাকুর মার নামে ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ভারতেশ্বরী হোমসÑমেয়েদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমের আবাসিক স্কুল। এটি কুমুদিনী হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত। মেয়েরা সেখানে শিক্ষা, থাকা-খাওয়া, জামাকাপড় সবই পেত বিনা মূল্যে। কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের টাকায় মির্জাপুরে এস কে হাইস্কুল, টাঙ্গাইলে কুমুদিনী গার্লস কলেজ ও মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার এই বিশাল জনসেবামূলক কাজের জন্যই ছোটবেলায় আমরা আমাদের বাবা-মায়ের কাছে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার গল্প শুনতাম।
ধামরাইয়ের বিখ্যাত রথযাত্রার মেলায় রণদা প্রসাদ সাহার অপরিসীম অবদান ছিল। প্রতিবছরই তিনি রথ মেলার সময় ধামরাই আসতেন। ধামরাই মাধববাড়ির ঘাটে তার বজরা অথবা স্টিমার নোঙর করা থাকত। আমরা দল বেঁধে আমাদের ছোটবেলায় মাধববাড়ির ঘাটে যেতাম তাকে দেখতে। ধামরাইয়ের যে রথটি পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি চার-পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের সমান উঁচু ছিল। এই রথের সামনে দুটি কাঠের ঘোড়া লাগানো ছিল, সেই ঘোড়ায় বসে রণদা রথ টানার নির্দেশনা দিতেন। আমার এখনো মনে আছে, রথটিতে যেদিন আগুন ধরিয়ে দেয়, আমরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সে ভয়াবহ আগুন দেখেছিলাম। পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা রথটি পুড়িয়েই শান্ত হয়নি, একদিন মির্জাপুরে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেককে খুন, ধর্ষণ করে এবং রণদা ও তার একমাত্র ছেলে রবীন্দ্র প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসেননি। তিনি ইচ্ছে করলেই ভারতে পালিয়ে যেতে পারতেন, সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু তিনি যাননি। ভেবেছিলেন তার উপস্থিতিতে মির্জাপুর গ্রাম রক্ষা পাবে। কিন্তু তা হয়নি, গ্রাম তো রক্ষা পায়ইনি বরং তার ও তার একমাত্র ছেলের জীবন দিতে হয়েছে। রণদার তিন ছেলেমেয়েÑবিজয়া, জয়া ও রবি। বিজয়ার বিয়ে হয় ব্যারিস্টার শওকত আলীর সঙ্গে আর জয়ার বিয়ে হয় এক ভারতীয় ডাক্তারের সঙ্গে।
রণদা প্রসাদ সাহা নাটক ভালোবাসতেন, নিজেও অভিনয় করতেন। তার উদ্যোগে প্রতিবছর মির্জাপুরে নাটক হতো। দুর্গাপূজার সময় হাজার হাজার মানুষকে দুবেলা খাবার দিতেন রণদা। যাত্রাগান হতো পূজার কদিন এবং শেষের দিন তিনি সবাইকে নতুন কাপড় দিতেন। রণদার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না, তবে তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালোই আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি পড়তেন ও লিখতেন। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, রণদা ও রবির অভাবে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট বন্ধ হয়ে যাবে। তা হয়নি, রণদার পৌত্র রাজিব প্রসাদ সাহার পরিচালনায় ট্রাস্ট আরো বড় হয়েছে এবং ভালোভাবে চলছে সব প্রতিষ্ঠান। আমি তাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম, যেটি আমার প্রথম বই ‘বিতর্ক কেবল সময়ের’-এ ছাপা হয়।
রণদা প্রসাদ সাহা
ঘেয়ো কুকুরেরা
কালরাত্রির অগ্নিশ্রুতর গ্রাসে
চূর্ণ করে হিরণ্য হৃদয় আমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বলে যার আলো
বেদনায় নীল তার স্মৃতি
ধামরাই রথে কাঠের ঘোড়ার পিঠে
মাধব বাড়ির ঘাটে বাঁধা বজরার ছাদে
রণদা প্রসাদ সাহা আমাদের মনে যার ছায়া
ধামরাই রথের চেয়েও উঁচু যিনি
মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের গেটে
কুমুদিনী হাসপাতালে রোগীর পাশে
টাঙ্গাইল মির্জাপুরে বিদ্যাপীঠে বিদ্যালয়ে
বেঁচে থাকে মৃত্যুহীন দানবীর
লক্ষ লক্ষ মন সরোবরে।