একজন নারীকে জীবন্ত করে তোলে নারীর সামগ্রিক পরিচিতি। একজন নারী রমনী, মা, বোন, কন্যা, প্রেয়সী, স্ত্রী। একই অঙ্গে নারীর নানা রূপ। নারীর এই রূপ এখন শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাই নারীকে স্বাগত জানাতে সারাবিশ্ব আজ প্রস্তুত।
নারী এগিয়ে আছে নারীর জন্য। আজ সমগ্র পৃথিবীর অর্থনীতির দুয়ার খুলছে। বিশ্ব নারী দিবসে আমি পৃথিবীর সব নারীকেই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সব বাধা উপেক্ষা করে নারীকে কাক্সিক্ষত সফলতার পথে যারা নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতিও রইলো গভীর কৃতজ্ঞতা।
আজ আমি বিশ্ব নারী দিবসে এমন একজন নারীর কথা বলবো, নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ তাকে অসীম সৌন্দর্যের আলোকে আলোকিত করেছেন। যার সৌন্দর্যের প্রকাশ আমার মতো তুচ্ছ মানুষের ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। যিনি বর্তমানে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী। কঠিন সত্যের সামনে এই নারী নিজেকে দেখতে পান। যে নারী তার অস্বচ্ছ ও অসম্পূর্ণ চোখের দৃষ্টি নিয়ে শুদ্ধ জীবনযাপন করেন। এই নারী দুটি নিষ্পাপ সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এক স্বর্গরাজ্যের। খুশি-আনন্দ ও ধর্মীয় আমেজে শাকিলা তার মানসিক শক্তি দিয়ে রচনা করেন তার পেশা। এভাবেই বলা চলে প্রতিদিনই ছুটছেন, ভাবছেন চেনা জানা পৃথিবী। এ চিন্তা চেতনায় বেড়ে উঠছে শাকিলার আগামী ভবিষ্যৎ। মানুষের অন্তর স্পর্শ করে সবকিছুই বুঝে নিতে পারেন তিনি।
শাকিলাকে আমি চিনি খুব বেশিদিন নয়, বছর দেড়েক হবে। পরিচয় হবার পর পরই মনে হলো কি একটা যেনো লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। আমার ভেতরেও প্রবল কৌতুহল হলো। ওকে গভীরভাবে দেখছি, জানছি। কাজ সেরে বাসায় ফিরছি, একদিন হঠাৎ শাকিলাকে বাসে দেখতে পেলাম!
এই শাকিলা? উৎসাহিত হয়ে ডাকলাম। কে জানি মনে হলো, আমার দিকে দৃষ্টি রেখেই কথা বলছে, তবে চোখের দৃষ্টিতে এক-আধটু ভিন্নতা লক্ষ করলাম। সম্পর্কের আন্তরিকতাতে একদিন আমার সাথে অনেক কথা হলো। জানলাম এই কোমলমতি মেয়েটির অস্বচ্ছ দৃষ্টির গল্প। চোখের অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতা ক্রমশই ওর জীবনে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কোনোভাবেই সরাসরি দৃষ্টি রেখে কিছু দেখা সম্ভব নয়। চিকিৎসা শাস্ত্রেও আজ অবধি এক চোখের unitral nerve tissue problem solution আবিষ্কৃত হয়নি। নিঃসন্দেহে খুব দুঃখজনক!
আমার বুকের ভেতর কেমন যেনো অদৃশ্য কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলাম। অনেক কাদামাটি মাখা মানুষের গল্প শুনেছি, দেখেছি, জেনেছি। শাকিলার জীবনের এই সত্য গল্প সম্পর্কের শুরু থেকেই আমি অন্যরকম মনে করছি। আমাদের দুজনের সম্পর্কের কুশল বিনিময়, প্রত্যাশা বেড়ে চললো। আমি আরো উৎসাহিত হয়ে শাকিলার পারিবারিক স্বপ্নচিত্র এবং বেড়ে ওঠা সোনালী দিনের সব বাস্তবতা জানলাম।
আদর্শ ও চেতনার এক দুর্দমনীয় শক্তির মধ্যে শাকিলার বেড়ে ওঠা। শাকিলার বয়স যখন দশ, তখন থেকেই ওর দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছিলো। ওর চোখের nerve tissue ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছিলো, আর সে কারণেই সরাসরি তাকিয়ে দেখা শাকিলার পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি। শাকিলার পারিবারিক প্রেক্ষাপট, ঐতিহ্য দর্শন, চেতনা আমাকে বিস্মিত করে তুললো। কীভাবে প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে এসএসসি থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স অর্জন করলো, জানতে চাইলাম।
এটা কী করে সম্ভব! বিস্ময় প্রকাশ করলাম। শাকিলার পারিবারিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মানুষের জীবনের মৌলিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে পারিবারিক অর্জন প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে শাকিলার গ্রহণযোগ্যতা শতাংশ। আর প্রশ্নবিদ্ধ না করে জানতে পারলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন কাহিনী। শাকিলা প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় সফলতা পায়। শাকিলার মায়ের ছিলো সেই মানবিক গুণ। যিনি পড়ে যেতেন, আর শাকিলা প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব ধারণ করতেন। এমনি করেই মা, ভাবি পড়ে পড়েই শাকিলাকে নিয়ে অগ্রযাত্রীর ভ‚মিকা পালন করেন। একজন মায়ের ভেতরকার মহৎ মানবিক গুণাবলী শাকিলাকে এসএসসি থেকে গ্রাজুয়েশনের পথে ধাবিত করলো। একজন সন্তানের শিক্ষার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ও মেধা, অথচ সেই সন্তানটি হয় ঝঢ়বপরধষ, একজন মায়ের জন্য সে জীবন কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। শাকিলার জীবনধারার স্পষ্ট রূপটি ভিন্ন। মা, ভাবীরা পড়ে যেতেন, আর শাকিলা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ধারণ করতেন! এভাবেই চললো শাকিলার প্রগতির পথে এগিয়ে চলা।
শাকিলা যখন ইংরেজিতে মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে, তখন আস্থাভাজন হয়ে দাঁড়ালেন শাকিলার স্বামী। যিনি অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে, কোনো রকম দ্বিধা না করে মায়ের দায়িত্ব অন্যের হস্তে অর্পণ করেন। এবং মায়ের অনুপস্থিতিতে স্বামীর সততা ও সহায়তায় অর্জন করলেন মাস্টার্স ডিগ্রি। জীবনের যথাযথ সাধনায় নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন। এমনিভাবে কেউ একজন পড়ে থাকে, আর গভীর মনোযোগী হয়ে তা শুনবে, সেই সূত্র ধরে আজ অবধি এগিয়ে চললো শাকিলার নিশ্চিত পথচলা।
শাকিলা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। ওর সাথে কথা বললেই মনে হয়, শাপলার মতো একটি স্নিগ্ধ ফুল। সহজ, সরল, বিনয়ী, সাহসী শাকিলার আনন্দ চোখে-মুখে, যেনো সতত জানিয়ে দিচ্ছে- এইতো শুভ মুহূর্ত সন্নিকটে!
শাকিলার বাবা আমাদের সমাজে একজন সফল চিকিৎসক। যিনি যুদ্ধের সময় নিজের ও পরিবারের মায়া ত্যাগ করে ছোট-বড়, গরিব-ধনী, শত্রু-মিত্র সবার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। এবং আজ অবধি প্রায় শতবর্ষস্পর্শী চিকিৎসক অদ্ভুত সেবা দিয়ে মানুষকে দেখছেন।
একজন শাকিলা, যিনি আমাদের ভাবনায় ংঢ়বপরধষ হয়েও এগিয়ে যাচ্ছেন। অসীম আনন্দ, আগ্রহ নিয়ে মানুষকে দেখছেন। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমার দুটি চোখ থাকা সত্তে¡ও আমি হেরে গেলাম শাকিলার কাছে। কিন্তু আমার এই হেরে যাওয়ার আনন্দ ঈদের আনন্দের চেয়েও বড়। শাকিলা একজন বিদুষী মায়ের সন্তান। একজন প্রেয়সী স্ত্রী। আবার একই সমতলে দুটি সন্তানের সফল মমতাময়ী মা-ও!
আমরা পৃথিবীর অনেক আলোকসজ্জা দেখি। আমরা শুনতে পাই হৃদয়ের স্পন্দন, দেখতে পাই ধরিত্রীর উজ্জ্বল উত্থান। কিন্তু তারপরও কখনো কখনো দাঁড়াতে পারছি না। শকিলার মনের চোখ সত্যের সন্ধানে আলোর দিশারী হয়ে আপন মনে এগিয়ে চলে। কিন্তু শাকিলা নিজেকে দেখতে পায়! নিজেকে বহন করে চলে নিয়ে যায়- প্রচণ্ড ক্রোধ, যন্ত্রণা, দুঃখ কিছুই ভ্রুক্ষেপ করে না। শুধু দীপ্ত শপথে এগিয়ে যায় বিরামহীন অভিযাত্রায়।
এভাবেই চলছে- একজন শাকিলার স্বপ্ন পথ চলা…!
লেখক: সাবেক সহকারি এটর্নি জেনারেল ও এভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে নিউইয়র্ক প্রবাসী।