একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত : মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়

এবিএম সালেহ উদ্দীন :

কোনো কোনো মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ ঘটে। জীবদ্দশায় হয়তো তার প্রকাশ ঘটেনি। কিংবা জীবদ্দশায় মূল্যায়ন না হওয়া মানুষটির মৃত্যুর পর যখন তার ভেতরকার মনুষ্যত্ববোধের মানবিক দৃষ্টান্তসমূহের প্রকাশ ঘটে, তিনিই মূলত শ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনিই পৃথিবীতে অমর, অনির্বাণ ও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকেন। অতএব, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই মহাজীবনের শুরু হয়।

এ জন্য মৃত্যু কখনোই নশ্বর নয়। মৃত্যু অনাদি ও অবিনশ্বর। আসলে মানবিকবোধ যদি সুদৃঢ় থাকে, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই অবিনশ্বরের পথকে খুলে দেওয়া যায়। সুদৃঢ় মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে অনন্তকাল অমর থাকা যায়। অনির্বাণ হয়ে থাকা যায় অনন্তকাল। মানবকল্যাণে যিনি চিরকাল বেঁচে থাকেন, তিনিই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, সম্মান ও ঐশ্বর্যের অধিকারী।

সভ্যতার পর থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে সে রকম মহামানব ও শ্রেষ্ঠতম মানুষের অসংখ্য নজির রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এমন একটি অবিস্মরণীয় ঘটনার অবতারণার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি দেখে চমকিত ও উদ্বেলিত হয়েছি। যার মৃত্যুর মাধ্যমে মানবতার শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত ইতিহাসে সংযোজিত হলো। মাত্র ২০ বছরেই যে মানবিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিগণিত হয়েছেন বাংলাদেশের সোনার কন্যা ‘সারাহ ইসলাম’। সারাহ বয়সে ছোট হলেও অনেক বড়দের চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। মানবতার কল্যাণে, মানুষের জীবন ফেরানোর পথে বিস্ময়কর আলো জ্বালিয়ে সারাহ যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন; তা ইতিহাসে বিরল। এমন একজন, যাকে স্মরণে রাখার জন্য তার নামে কোনো হাসপাতালের একটি বিভাগ চালু হতে পারে।

স্কুলজীবন থেকেই সারাহর ভেতরে মানুষ্যত্ববোধের দিকগুলো ফুটে ওঠে। মায়ের নিকট থেকে বরাদ্দকৃত প্রতিদিনকার হাতখরচের টাকা জমিয়ে তিনি সহপাঠীদের প্রতি, নিরন্ন ও অসহায়ের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন। মৃত্যুর আগেই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয়ে নিজের দুটো কিডনি ও চোখের কর্নিয়া দান করে সারাহ নিজের নামটি মানবতাবোধের খাতায় অনন্তকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

সারাহ ইসলামের মতো এমন ঐশ্বর্য, এমনতর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কজন স্থাপন করতে পারে? বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনি দুটো দান করেন সোনার কন্যা সারাহ ইসলাম। লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়ার পর ১৮ জানুয়ারি বুধবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর চারটা পর্যন্ত দুটি কিডনির একটি প্রতিস্থাপন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ); অন্যটি প্রতিস্থাপন করা হয় কিডনি ফাউন্ডেশনে। সারাহ তার চোখের কর্নিয়াও দান করে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, মায়ের স্নেহপরশে থাকাকালীন তিনি প্রায়ই বলতেন, আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর তাঁর ব্রেন গবেষণার জন্য যেমন কাজে লাগানো হয়েছে, তেমনি সারাহর মৃত্যুর পর তার ব্রেনকেও গবেষণার জন্য মা চাইলে দিতে পারেন। কম বয়সের একটি মেয়ে তার মানবতাবোধকে এতটা উচ্চকিত করেছেন, বর্তমান মানববিধ্বংসী পৃথিবীর স্বার্থান্বেষী রাষ্ট্রসমূহ ও মানবতাহীন নিষ্ঠুর সমাজে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় এই বিস্ময়কর খবরটি ফলাওভাবে প্রচারিত হচ্ছে। প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কিডনি প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, সারাহর মা জানিয়েছিলেন, সারাহ মৃত্যুর আগে তার দেহের সবকিছুই দান করে দিতে বলেছিল। সেই হিসেবে শুধু তার কিডনি ও কর্নিয়া নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘সারাহকে বীরের মর্যাদা দেওয়া উচিত। মরণোত্তর কিডনিদানে উদ্বুদ্ধ করতে এই দান মানুষের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।’

পত্রিকাটি আরও জানায়, ‘করোনার কারণে কিশোর আলোর অফলাইন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সারাহ ঐশ্বর্য কিশোর আলোর নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবক ছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে কিশোর আলোর সঙ্গে তার পথচলা শুরু। তাদের মাসিক সভা ও আড্ডায় এসেছিল সে। তারপর ধীরে ধীরে কিশোর আলো পরিবারের একজন হয়ে ওঠে। কাজ করে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে।’

সারাহ ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, মানবদরদি এবং সত্য-সুন্দর বিনয়ের অধিকারী। অনেক ভালো হবি ছিল তার। ছোটবেলা থেকে তিনি ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি আর হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর মেধাবী ছাত্রী সারাহ ভর্তি হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের চারুকলা বিভাগে।

সারাহর মা শবনম ইসলাম মিডিয়াকে জানান, ‘শিশুকাল থেকেই “টিউবেরাস স্কে¬রোসিস” নামক খুব জটিল একটি রোগে আক্রান্ত হয়েছিল সারাহ। তার চিকিৎসার জন্য সারা জীবন চেষ্টা করেছি। সিঙ্গাপুরে অনেক অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা করতে গিয়ে এই জটিল রোগটি ধরা পড়ে। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ভালো করার কোনো উপায় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ১৫-১৬ বছর পার হওয়ার পর সে ভালো হয়েও যেতে পারে। কিন্তু খুব যন্ত্রণাদায়ক রোগটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। তার পরও নিজের ভালো লাগার পছন্দের কাজগুলো করার মধ্য দিয়ে পরির মতো কন্যাটি জীবনের সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।’

তার মা মিডিয়াকে আরো জানান, ‘১০ জানুয়ারি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার মস্তিষ্কের টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়। পরবর্তীতে তার অবস্থার অবনতি হলে বিএসএমএমইউর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।’

খবরে প্রকাশ : ‘গত ১৮ জানুয়ারি রাত ১০টায় তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। রোগশয্যায় থেকেই নিজের ব্রেনসহ অন্যান্য অরগানÑঅঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের জীবন রক্ষার্থে দান করার ইচ্ছা মাকে জানিয়েছিল সারাহ। সেই সূত্রেই তার দুটি কিডনি ও দুটি কর্নিয়া চার ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করেছেন দেশের চিকিৎসকেরা।

গেল সোমবার হাসপাতালে সারাহর মা বলছিলেন, সারাহ বাসা থেকে যে টাকা নিত, তা নিজের জন্য খরচ করত না। খরচ করত অন্যকে উপহার দিতে। সারাহ ‘স্যান্টা ক্লজ’ হতে চাইত।
উপহার দিতে সত্যিই খুব পছন্দ করতেন সারাহ। আর সে জন্যই বোধ হয় মৃত্যুর সময়ও উপহার দিয়ে যেতে ভুলে যাননি তিনি। সারাহ চলে গেলেও তার দেওয়া (সফলভাবে প্রতিস্থাপিত) কিডনি নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ পাচ্ছেন দুজন মানুষ। আর সারাহর দান করা কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর আরও দুজন পৃথিবীটাকে দেখতে পারছেন নতুন করে। পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য এর চেয়ে সুন্দর উপহার আর কী হতে পারে!

পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণে কাজ করার অনেক পথ আছে। নানা ক্ষেত্রে সেটি করা যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয়, সে-ই মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’
ঠিকই তো, মহান স্রষ্টা মানুষ বানিয়েছেন, যাতে মানবতা চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে। মানবতার
কল্যাণে, মানুষের জীবন ফেরানোর পথে বিস্ময়কর আলো জ্বালিয়ে সারাহ যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন; তা ইতিহাসে বিরল। সারাহ ইসলামকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য অনেক কিছু করা যায়। তাকে স্মরণে রাখার জন্য তার নামে কোনো নির্দিষ্ট হাসপাতাল চালু হতে পারে। দেশে আরও এমন মহত্তম ও গৌরবজনক কাজের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষ কোনো চিকিৎসা বিভাগ চালু হতে পারে।
সারাহ যেমন তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য দুর্লভ সম্মানজনক মানবিকতার ইতিহাস সৃষ্টি করে আমাদের জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন, তেমনি দেশের চিকিৎসকেরা সারাহ কর্তৃক মরণোত্তর দানকৃত কিডনি ও কর্নিয়া অন্যের দেহে সফলভাবে ট্রান্সপ্লাট/স্থানান্তর করে সুনাম ও মর্যাদায় বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেছেন। এই স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসে সারাহ ইসলাম এবং তার রত্নগর্ভা মা শবনম ইসলাম ঐশ্বর্যের ইতিহাস সৃষ্টি করে মানবতাবোধকে উচ্চকিত ও বেগবান করেছেন। সারাহর দানকৃত কিডনি ও কর্নিয়ায় অন্য মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। পৃথিবীর এসব মানুষের মধ্যেই সারাহ চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
সারাহর চিরশান্তি

২০১৪ সালে ইরানের সুপ্রিম কোর্ট রেহানে নামের এক তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টাকারীকে হত্যার অভিযোগে দণ্ডাদেশ দিয়ে নির্দয় ও অমানবিকভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। প্রকাশ থাকে যে, রেহানের বয়স যখন ১৯ বছর, একটি অফিসের বস তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। তখন রেহানে আত্মরক্ষার অনেক চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে ধর্ষণচেষ্টাকারী লোকটি ছুরিকাঘাতে মারা যায়। রেহানে সাত বছর বিনা জামিনে জেলেই ছিল। তার মা অনেক চেষ্টা-তদবির করলেও তাকে রক্ষা করা যায়নি। মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় এবং রেহানের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। তাকে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার জন্য পৃথিবীর অনেক মানুষ ও বিশ্ব মানবতাবাদী সংস্থাগুলো আহ্বান জানিয়েছিল। তবু তাকে নির্দয়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ২৬ বছর। মৃত্যুর আগে রেহানেও তার কিডনি, কর্নিয়াসহ অন্যান্য অর্গান তার মায়ের মাধ্যমে দান করে গেছেন। মৃত্যুর আগে মায়ের কাছে একটি সুদীর্ঘ হৃদয়স্পর্শী চিঠিতে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুই শেষ নয়, তার পরও জীবন আছে।’ কী অসাধারণ চিরন্তন কথা।

সারাহ ইসলাম তার আত্মত্যাগ ও মহত্ত্বের মাধ্যমে মানবতার ইতিহাসে চির অনির্বাণ এক মাইলফলক। তার আত্মার শান্তি কামনা ও পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।