একটি গরু ও আমি

তামান্না ঝুমু :

আমার শহর থেকে বের হলেই দেখা পাওয়া যায় অবারিত মাঠ-ঘাট-সবুজের। কাচের মতো মসৃণ সড়কের ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটে যেতে থাকে অতি দ্রুত বেগে। গাড়ির ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পরপর সড়কের দু’ধারে মাঠে কিংবা খামারের পাশে গরুদের চরতে দেখা যায়। গরু দেখলেই আমি আমার কন্যাদ্বয়কে চমৎকৃত কণ্ঠে বলি, দেখো গরু! ওই যে গরুরা কী সুন্দর ঘাস খাচ্ছে! ওরা বলে, মা, তুমি সব সময় গরু দেখলে এমন করো কেন? গরু ঘাস খায়, এটা কি দেখার জিনিস হলো?

আমার শহরে গরুর দেখা পাওয়া অসম্ভব। শহরের বাইরে গেলে গরু দেখতে পেলে আমার মনে হয়, গরু নয়, আমি আমার কোনো স্বজনের দেখা পেলাম। গরু আপনমনে ঘাস খাচ্ছে কিংবা উদাস দৃষ্টিতে কোনো দিকে তাকিয়ে আছে, এমন দৃশ্য আমার কছে শিল্পের মতো সুন্দর লাগে। কিন্তু কেন এমন হয়? গরুর প্রতি কেন আমার এমন হৃদয়গ্রাহিতা? অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে তা বোঝার চেষ্টা করি।

একেবারে জন্মলগ্ন থেকে দেখি, কী পাওয়া যায়! আমার জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলায়, আমার নানাবাড়িতে। আমার জন্মের পর নবজাত আমাকে কোলে নিয়ে আমার এক নানা, নূরুল ইসলাম খান, যিনি আমার বড় মামির বাবা, ৭০০ টাকা উপহার দিয়েছিলেন। বছর চল্লিশেক আগে ৭০০ টাকা অনেক টাকা। বর্তমান সময়ে সেই ৭০০ টাকার সমমূল্য কত হবে, ঠিক জানি না। তবে বিশাল একটা অঙ্ক হবে, তা বুঝতে পারি। জন্মের কয়েক মাস পর আমি আমার দাদাবাড়ি তথা বাবাবাড়িতে আসি। আমার পিতা সেই ৭০০ টাকায় তখন একটি গরু কিনেছিলেন।

বাবা-মায়ের বিয়ের অনেক আগেই আমার নিজের নানা মারা গিয়েছিলেন। আমার জন্মের সময় নানাবাড়িতে ছিলেন আমার নানি, দুই মামা ও অবিবাহিত ছোট খালা। আমার নানা কাস্টমসে চাকরি করতেন। নানা মারা যাওয়ার পর তাই নানি পেনশন পেতেন। নানির জমিজমাও প্রচুর ছিল। বড় মামারও ভালো চাকরি ছিল। ছোট মামার তখনো রোজগারের বয়স হয়নি। কিন্তু নবজাত আমাকে কেবল বড় মামার শ্বশুর, নানা নূরুল ইসলামই উপহার দিয়েছিলেন। আর কেউ কিছুই দেননি।

আমার মায়ের তখনো স্কুল-মাস্টারির চাকরিটা হয়নি, পিতা হার্টের অসুখে জর্জরিত। আমাদের সংসারে তাই আর্থিক টানাপোড়েন চলছিল। এ জন্য আমার প্রাপ্ত উপহারের টাকাটা দিয়ে আমার জন্য জামাকাপড় ইত্যাদি কিনে অপচয় না করে পিতা তা দিয়ে একটি গরু কেনেন। গরুটি আমাদের কাছে আসার পর প্রথম বাচ্চা দেয়। আমি তখন দুগ্ধপোষ্য শিশু। মায়ের দুধের পাশাপাশি আমি সেই গরুর দুগ্ধও পান করি। আমি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি, সঙ্গে গরুটিও বড় হতে থাকে। পরের কয়েক বছরে আমার ছোট দুই ভাইয়েরও জন্ম হয়। আমাদের গরুটি বছর বছর বাচ্চা দেয়। আমরা ওর দুধ পান করি, নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর কিছুটা বিক্রি করি। ওর দুগ্ধে আমাদের জন্য পায়েস রান্না হয়, সেমাই রান্না হয়, চা বানানো হয়, দই পাতা হয়।

গরুটিকে খড় দেওয়া, ঘাসের মাঠে চরানো, ওকে গোসল দেওয়া, ওর গোহালটি পরিষ্কার করা, দুধ দোহানো ইত্যাদি কাজ পিতা নিজেই করতেন। কখনো-সখনো ছোট্ট একটি বালক রাখা হতো এসব কাজে সাহায্যের জন্য। আমাদের গরুটি স্বভাবে খুব শান্ত আর নিরীহ ছিল। ও কখনো শিঙের গুঁতো মারত না কাউকে। ওর গায়ের রং ছিল লালচে বাদামি। শরীরটি প্রশস্ত। ওর দুগ্ধের স্বাদ ছিল অমৃতের মতো। খুব ঘন মিষ্টি আর সুঘ্রাণযুক্ত ছিল সেই দুগ্ধ। আমাদের ক্রেতারা, যারা একবার সেই দুগ্ধের স্বাদ পেত, তারা বারবার কিনতে চাইত। আমার পিতার এ ব্যাপারে কিছু গুণ ছিল। পিতা কখনো দুধে পানি মেশাতেন না, মাপে দুধ কম দিতেন না, আর দুধ দোহানোর বালতিটি খুব পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত রাখতেন সব সময়। সকালে কিংবা বিকেলে দুধ দোহানোর সময় পিতা মাঝে মাঝে আমাকে ডাকতেন, ওর বাছুরটিকে ধরে রাখার জন্য। ও কাজলমাখা দুটি মায়াময় ডাগর চোখে আমার ও ওর বাছুরের দিকে তাকিয়ে থাকত। নাগালে পেলে বাছুরটির গায়ে জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে আদর করত। ওর গায়ে আঠালি হতো, যা দেখতে কিছুটা উকুনের মতো। পিতা ও আমি ওর গায়ের আঠালি বেছে দিতাম। সে সময়টায় ও চুপ করে আমাদের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থাকত। হয়তো তাতে ও শরীরে আরাম পেত। মনে হয়, তারই কৃতজ্ঞতা জানাত অমন মায়ার চোখে আমাদের পানে চেয়ে থেকে। কখনো কখনো আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। ও ছলছল চোখে আমার দিকে চাইত। আরাম আর কৃতজ্ঞতায় ওর চোখে জল এসে যেত কি?

প্রতিবছর ওর বাচ্চারা একটু বড় হলে ওদের বিক্রি করে দেওয়া হতো কিংবা কারো কাছে বর্গা দিয়ে দেওয়া হতো। ও থেকে যেত আমাদের পরিবারের একজন হয়ে। ওর দুগ্ধ এবং বাচ্চারা আমাদের পরিবারে এভাবে খাদ্য, পুষ্টি ও অর্থের জোগান দিয়ে যেতে থাকে।
আমার কৈশোর সময়ে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর পিতা আমাকে প্রায়ই আমাদের প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি পাঠাতেন, আমাদের গরুর জন্য ভাতের ফেন চাইতে। অধিকাংশ মানুষে ফেন দিয়ে হাঁস-মুরগির আদার বানাত, কেউ কেউ তাদের নিজেদের গরুকে খাওয়াত, আর কেউ কেউ আমি পৌঁছানোর আগেই ফেলে দিত। দু-একজনের কাছে পেতাম অবশ্য। পিতা আমাদের ফেন ও সেই সংগৃহীত ফেন দিয়ে গরুর জন্য খাদ্য বানাতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেন চাওয়া তখন আমার কাছে বিষম মানহানিকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু পিতার হুকুমের অবাধ্য হওয়ারও সাধ্য বা সাহস ছিল না।

একবার ওর বাছুরটির বয়স যখন কয়েক মাস, পিতা একদিন সকালে দুধ দোহাতে গোয়ালে গেলেন। সেখান থেকে হাউমাউ কান্না শুনে আমরা ছুটে গেলাম, প্রতিবেশীরা ছুটে এল। দেখলাম, ওর বাছুরটি গোয়ালের মেঝেতে মৃত পড়ে আছে। পাশে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে ও। আর আমার পিতা ওদের পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদছেন, স্বজন হারালে মানুষ যেভাবে কাঁদে, সেভাবে। ওর মৃত্যু আমাদের পরিবারের জন্য খাদ্য, পুষ্টি ও আর্থিক সংকট বয়ে এনেছিল। কিন্তু পিতার কান্না শুধু সে জন্য নয়, ওর জন্য পিতার ভালোবাসাও ছিল। বাছুরটির কোনো অসুখ করেছিল, নাকি ওকে সাপে কেটেছিল, আমরা কিছুই জানতে পারিনি।

আমার উপহারের ৭০০ টাকায় ওকে কিনে আনা, তার পর থেকে আমাদের পরিবারে ওর ও ওর বাছুরদের আর্থিক ও খাদ্য-পুষ্টি বিষয়ে ভূমিকার কথা পিতা বারবার বলতেন। কিন্তু পিতা মাঝে মাঝে ওকে খুব মারতেন। কারণে-অকারণে পিতার রাগ উঠে যেত। সেই রাগ তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। কোনো দিন হয়তো ওর হাঁটা পিতার পছন্দ হলো না। ধরে লাগাতেন মার। কোনো দিন ওর চাহনি পছন্দ হলো না হয়তো। ধরে লাগাতেন মার। ও আঘাত সহ্য করত নীরবে, কখনো প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করত না।

এভাবে দিন যেতে যেতে আমি আরো বড় হতে থাকলাম। আর আমাদের গাভিটি বৃদ্ধ হতে থাকল। আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ি, তখন ও এমন বৃদ্ধ হলো যে ওর চলতে-ফিরতেও খুব কষ্ট হতে শুরু হলো। ও মেঝেতে বসলে আর উঠতে পারত না। অনেক কষ্টে উঠলেও হাঁটতে পারত না। হাঁটার সময় পায়ে পায়ে পেঁচিয়ে যেত। আমাদের কোনো রাখাল ছিল না তখন। পিতার একার পক্ষে ওর দেখভাল করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। ওর প্রশস্ত ওজনদার শরীরটি মাটি থেকে টেনে তোলা বা মাটিতে শুইয়ে দেওয়া একজনের দ্বারা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। পিতা খুব বিমর্ষ আর চিন্তিত হয়ে পড়লেন ওকে নিয়ে। একদিন দেখলাম, এক অপরিচিত লোক এসে ওকে নিয়ে গেল। ওকে বিদায় দিতে দিতে পিতা আবার খুব কাঁদলেন, যেভাবে একদিন কেঁদেছিলেন ওর বাছুরের মৃত্যুতে। পরে জানলাম, ওকে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। আমাদের মন খুব খারাপ হয়েছিল। আমাদের অন্নদাত্রী গাভিটি, যে আমাদের সারা জীবন দুগ্ধ দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে; তাকে পিতা অনন্যোপায় হয়ে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর ওর কী হয়েছিল, তা ভাবলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আজও।

ছোটবেলায় গরুটির জন্য মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাতের ফেন চাইতে আমার মর্যাদাহানি হতো। তখন বুঝতে পারিনি, গরুটি তার পুরোটা জীবন আমাদের কেবল দিয়েই গেছে। তার জন্য সামান্য খাদ্য সংগ্রহ করে অন্তত কিছুটা হলেও আমি অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিÑএটা ভেবে এখন বেশ ভালো লাগছে। এ জন্যই কি এত বছর পরও প্রবাসজীবনে কখনো কদাচিৎ গরু দেখলে মনের ভেতরে এমন আপনজন দেখার মতো অনুভূতি হয়? কী জানি!