একটি পরিবারের নির্মম ট্র্যাজেডি

এম আর ফারজানা

একটি শিশুর মনের বিকাশ হয় পরিবার থেকেই। তার শৈশব কৈশোর থেকেই মনের মধ্যে লালন করে এক প্রতিচ্ছবি, যা তার পায়ে পায়ে ছায়া হয়ে থাকে চলার পথে। পরিবার অনেক কিছু শিক্ষা দেয়, যা বই থেকেও পাওয়া যায় না। শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের ও পরিচর্চা করতে হয়। ঠিক এই জায়গা এসে অনেকে বুঝতে পারে না, বা বুঝতে চায় না। এখন আমরা যান্ত্রিক হয়ে গেছি। যন্ত্রের মতো আমাদের হৃদয়। মানবিকতা, ভালোবাসা নেই। যা আছে তা শুধু ব্যস্ততা। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা শুধু পড়াশোনা করুক। ভালো রেজাল্ট চাই চাই। প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি কার সন্তান বেশি ভালো রেজাল্ট করেছে। সমাজে স্ট্যাটাস বাড়াতে চাই। কিন্তু সন্তান কি চাইছে সেটা কি আমরা সত্যি বুঝতে চাই? কয়েকদিন আগে আমেরিকার টেক্সাসে বাঙালি পরিবারের সে ট্র্যাজেডি হলো তা নিয়ে চলছে আলোচনা। দুই ভাই মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছিল দীর্ঘদিন ধরেই। আর তার পরিণামে শেষ হয়ে গেল একটি পরিবার। বাবা-মা বোন – নানীকে হত্যা করে দুই ভাই ও আত্মহত্যা করল।

এখানে দুটো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, পরিবারের দায় কতটুকু ছিল এবং অস্ত্রের সহজলাভ্যতা।

১৯ বছর বয়সী ফারহান তৌহিদ এবং তার বড় ভাই তানভীর তৌহিদ (২১) সুসাইডল নোটে স্পষ্ট করেই লিখে গেছে তাদের ডিপ্রেশনের কথা। সেই নবম শ্রেণী থেকে লড়াই করে আসছে। মনের ভেতরে বিষণ্নতার ঘুণ পোকা বাসা বেঁধেছিল যা থেকে তারা বের হতে পারেনি। প্রশ্ন হচ্ছে এত দিন ধরে এমন একটি সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা পরিবার টের পেল না কেন? এতটা ডিপ্রেশনে তো এক দিনে যায়নি। অনেক সময় পার হয়েছে এর মধ্যে। বিষণ্নতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেই তবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। যারা এই পরিবারের সাথে মিলেমিশে ছিল তারা বলছে এমন কিছুই তাদের চোখে পড়েনি বা পরিবার থেকেও তাদের সাথে এই নিয়ে কোনদিন কোন আলোচনা হয়নি। তারা বিশ্বাস করতে পারছে না এমন অযাচিত হত্যাকাণ্ডের খবর তাদের শুনতে হবে। হাজারো প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে কিন্তু পরিবারের কেউ বেঁচে নেই বলেই সত্যিকার অর্থে কি ঘটেছিল,কতটুকু ঘটেছিল তা বলা মুশকিল। সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হল বাবা-মা। ফারহানের বাবা-মা কি কিছুই টের পাননি? যদি পেয়ে থাকেন যথাযত কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? নিয়ে থাকলে তো এই নির্মম ঘটনা ঘটত না। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছি উত্তর মিলছে না। আমি তাদের দায়ী করছি না, আবার বিপরীত দিক থেকে ভাবলে মনে হয় তারা কি দায় এড়াতে পারে? না পারে না। যেহেতু কেউ বেঁচে নেই তাই কোনোদিন জানা সম্ভব হবে না আসলেই কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তারা। কারণ কোন বাবা-মা চায় না তার সন্তান এমন হোক। যাই ঘটেছিল কঠিন সত্যটা হলো একটা পরিবার নির্মমভাবে শেষ হয়ে গেল।

আত্মহত্যার আগে ফারহান তৌহিদ তার ইনস্টাগ্রামে সুইসাইডাল নোটে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক আইন ব্যবস্থা নিয়ে কটাক্ষ করে গেছেন। লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ একটি রসিকতা।’

এক দিক থেকে ভাবলে আসলেই তাই। কারণ পরিবারের এই বাবা-মা বোন, নানী সবাইকে হত্যা করল দুই ভাই অস্ত্র সহজে হাতে পেয়েছে বলেই। যদি অস্ত্র না পেত এমন ঘটনা ঘটত না । আমেরিকাতে ১৮ বছরের উপরে হলে আইনগতভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক ধরা হয়। ফলে তারা তাদের নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ফারহান, তানভীরও তাই করেছে। অস্ত্র সহজে পাওয়া যায় বলেই দিন দিন সহিংসতা বাড়ছে আমেরিকাতে। এঁহ ভায়োলেন্স আর্কাইভ ডেটাবেইসের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন একটির বেশি গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। কারো প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হলে, কিংবা কাউকে ঘায়েল করতে হলে সহজেই হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র।

তৌহিদুল ইসলামের পরিবারের এই নির্মম ঘটনার প্রভাব পড়েছে আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর। কমিউনিটির লোকজন করছেন আলোচনা সমালোচনা। অস্ত্র সহজ প্রাপ্তি বলেই ভবিষ্যতে এমন আরো ঘটনা ঘটতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিরা কেন, খোদ আমেরিকান কমিউনিটিতে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে মত দিচ্ছেন অস্ত্র আইন নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো এক হতে পারছে না। ডেমোক্র্যাটরা পক্ষে মতো দিলে দেখা যায় রিপাবলিকানরা বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। এইতো কয়েক দিন আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আধা ডজন নির্বাহী আদেশ জারি করেন ঠিক তার পরেই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত টেনেসি রাজ্যের রিপাবলিকান গভর্নর বিল লি অস্ত্র সংক্রান্ত আইনে স্বাক্ষর করেছেন ৮ এপ্রিল। এই রাজ্যে ২১ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষ ‘হ্যান্ডগান’ বহন করতে পারবে। রাজনীতির এই মারপ্যাঁচে এই অস্ত্র আইনের কোন পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।

ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই অস্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমেরিকাকে বলা হয় ওপেন কান্ট্রি। এখানে সবকিছু যেমন সহজ আবার কঠিনও। সহজে অস্ত্র পেয়েছে বলেই আজ তৌহিদুল ইসলামের পরিবারে হারিয়ে গেল। না হয় অন্য কিছু হতো; কিন্তু এত জঘন্য ঘটনা ঘটত না। কিন্তু এই দেশে বসবাস করতে হলে আমাদের ভাবতে হবে নতুন করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে।
বাচ্চারা অনেকভাবেই নির্যাতনের শিকার হয়। সেটা হতে পারে যৌন নির্যাতন, বা মানসিক নির্যাতন। অনেক সময় ভয়ে বাচ্চারা বলতে পারে না, বা লজ্জায়। বাবা-মা কঠিন শাসনের মধ্যে রাখে। ভাবে বাচ্চা যাতে বখে না যায়। সমস্যা হচ্ছে কঠিন শাসন করলে এতে হিতে বিপরীত হয়। বাচ্চারা অনেক কিছু ভয়ে লুকিয়ে ফেলে তাদের সমস্যাগুলো ফলে তারা আরো সমস্যায় পরে।
\
আমরা যারা প্রবাসে বসবাস করি অনেক সময় আমরা কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, সন্তানের প্রতি মনযোগ থাকলে ও সময়ের অভাবে তাকে সময় দিতে পারি না। এমন কি নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেই তাদের ওপর। অনেকে আবার হিসাব মিলাতে বসে যায়, বলে আমার শৈশব আমি এই করিনি, তুমি কেন করছ। আমরা ভুলে যাই সময় বদলেছে, এটা প্রযুক্তির যুগ। ব্যস্ত হয়ে পরি সোসাল কর্মকাণ্ডে। অথচ নিজের পরিবারকেই সময় দেই না। সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে হলে আগে তাকে সময় দিতে হবে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো দিক। সময় দিলে বন্ধুর মতো আচরণ করলে, সে কি চায় তখন জানা যায়। ভুল কিছু করলে বকাবকি বা রাগ নয় বরং তার পাশে থেকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয়া যে এটা ভুল এমন সবার ক্ষেত্রেই হতে পারে। বাচ্চাদের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় থাকে যেমন যা তারা বাবা মায়ের কাছ থেকেই শিক্ষা নেয়। যখন দেখে বাবা মা কোন মানবিক কাজ করছে, কিংবা ভালো কোন কাজ করছে সামনে কিছু না বললেও মনে মনে ঠিকি তারা ভাবে যে আমার বাবা-মা কত ভালো। এই যে তাদের এই পজেটিভ চিন্তা তা থেকেই কিন্তু তারা গড়ে উঠে ভালো কিছু করতে। তারা উৎসাহ পায়। অনেক বাবা-মা দেখা যায় অনুষ্ঠানে যাচ্ছে কিন্তু বাচ্চাকে বাসায় রেখেই যাচ্ছে। হোক সে প্রাপ্ত বয়স্ক, তাতে কি জোর করে ও নেওয়ার দরকার নেই। শুধু দেখতে হবে সে কি চাইছে। সে যেতে না চাইলে তার সাথেই থাকুন তাকে বুঝিয়ে দেন যে তার প্রায়োরিটি বেশি আপনার কাছে অনুষ্ঠানের চেয়ে।

বাচ্চাকে গণ্ডির মধ্যে আটকে না রেখে তাকে নিয়ে মাঠে যান, খেলাধুলা করেন, পছন্দের রান্না করেন একসাথে, আত্মীয়র বাসায় যান, অনুষ্ঠানে যান, মানবিক সংগঠনের সাথে কাজ করতে দেন। সহজ কথায় তার মানসিক ভিত মজবুত করে দেন এমন ভাবে যেন সে বুঝতে পারে আপনি তাকে এটেশন দিচ্ছেন। সে যেন বুঝতে পারে আপনার ভালোবাসার তার প্রতি কত গভীর। সব বাবা-মা তাদের সন্তানদের ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসার প্রকাশ এমন হয় সন্তান যেন বুঝতে পারে। বাচ্চাদের মন থাকে কোমল, আর শারীরিক হরমোনের কারণে অনেক সময় বাচ্চাদের মাঝে পরিবর্তন ঘটে এটা কে স্বাভাবিকভাবেই নিতে হবে। সত্যটা হলো একজন সন্তান মানুষ হলে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় বাবা-মা। তেমনি তাদের গড়ে জীবন গড়ে দেয়ার দায়িত্ব ও বাবা-মায়ের। এ ক্ষেত্রে মানসিক ক্ষেত্রটা যত প্রসারিত হবে, বিকশিত হবে ততই মঙ্গল। এতে করে বাচ্চারা ডিপ্রেশন, হতাশায় যাবার ভয় থাকে না। বরং চলমান জীবনের অনেক ভুল তারা নিজেরা শুধরে নিতে পারে। পরে তারাই হতে পারে বাবা-মায়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ, সবচেয়ে ভালো বন্ধু- এমনটাই প্রত্যাশা করি।

-নিউজার্সি
১০ এপ্রিল ২০২১।