একটি রঙিন রুমাল

(গত সপ্তাহের পর)

আহম্মদ হোসেন বাবু :

(ছয়) : স্বপ্নের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করল আবারও। গায়ে চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো যে, সে এতোক্ষণ তাহলে স্বপ্নই দেখছিল। স্বপ্নের সেই লাবণ্যময়ী মেয়েটির অপূর্ব মুখশ্রী শুয়ে শুয়ে আবারও মনে করার চেষ্টা করল রকিব। মুখটা ভেসে উঠতেই চমকে উঠলো সে! এতো সেই নারী মূর্তি! প্রতিদিন যে মেয়েটি বিকেলে হাঁটতে যাবার সময় রকিবের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। এমন গভীর কাজল কালো চোখ রকিব আর কখনো দেখেনি। লম্বা কালো চুলের বেণী দুটি, রঙিন ফিতা দিয়ে বাঁধা। পরণে ছাপা চেকের সুতি শাড়ি। মুখে কোনো প্রসাধনীর চিহ্ন নেই, তবুত্ত মায়াময় সেই মুখশ্রীর দুর্বার আকর্ষণে প্রতিদিন বিকেলের আলোয় আটকে থাকে রকিব।

এর মাঝে শিউলির কথা ঢাকা পড়ে গেছে রকিবের মনে। হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলে দ্রুত কথা শেষ করে সরে পড়ে সে। শিউলি হয়তো বুঝতে পেরেছে রকিবের মনের কথা। তবু শিউলি হাল ছাড়েনি।

এর মাঝে শিউলি মাকে নিয়ে রকিবদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। রকিবের মা শিউলিকে দেখে তো মহাখুশি! মনে মনে পুত্রবধূ হিসেবে চিন্তা করেছে। তাইতো ওরা চলে যাবার সাথে সাথে রকিবের মা রকিবকে ডেকে বলেছিলেন, শিউলিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে বাবা। ভারী মিষ্টি মেয়ে। তুমি রাজি থাকলে বলো, আমি প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করি।
রকিব কিছুটা আনমনা হয়ে বলেছিল, আর কটা দিন যাক না মা…
ছেলের মনের কোনো হদিস না পেয়ে, মা আর কথা বাড়াতে সাহস করেননি।

(সাত)

আজকাল কেনো জানি রকিব উদাসীন, আনমনা। সবুজের সমারোহে কোথায় যেন আটকে থাকে সে। বিধাতা বুঝি সবাইকে কোথাও না কোথাও আটকে রাখেন। মনে হয় এই বুঝি প্রেম এলো জীবনে!
রকীবের জীবনেও আজ উথাল-পাতাল ঢেউ। শুধু একবার দেখেই, রকিব আজ এতোটা এলোমেলো। অথচ এদিকে শিউলি তার গন্ধ বিলানোর জন্য, আজ কতোইনা ব্যাকুল প্রতীক্ষায় থাকে। এ এক আশ্চর্য প্রেম! আশ্চর্য মানব জীবন!
আজ রকিব মনস্থির করেছে, যে করেই হোক সে মেয়েটির সাথে কথা বলবে। জিজ্ঞেস করবে ওর নাম। জানতে চাইবে কোন বাড়িটা ওদের ? মেয়েটির বাবাকে নিশ্চয় রকিব চেনে। সেটাও সে কথার ফাঁকে জেনে নিবে। দীর্ঘদিন পর গ্রামে এসে আজ রকিবের মন হারালো এক ফর্সা সুন্দরী তিলোত্তমার কাছে।
রকিবের জীবনে আজ যেন অনেক কিছুই নতুন রূপে দেখা দিয়েছে। নতুন আলোয় আরও সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে সেই অপরূপা মেয়েটি। মনে হয় সে যেন এক স্বর্গের দেবী।
কথা বলবে বলবে করে, দুটি প্রাণ থেকেছে মন বাড়িয়ে প্রতিদিন, অথচ কোনো কথা আজো হলো না ওদের। শুধু নীরবে চেয়ে চেয়ে থাকা, আর মনে মনে ছবি আকা!
সেই ছবি মনের ক্যানভাসে আঁকতে গিয়ে হঠাৎ আজ আবার সেই অপ্সরীকে স্বপ্নে দেখলো রকিব। এতো নিবিড়ভাবে আর কোন নারীকে সে স্বপ্নে কখনো পায়নি।
অনেকক্ষণ ধরে বিছানার এপাশ-ওপাশ করলো, কিন্তু চোখে ঘুম এলো না রকিবের। বিছানা ছেড়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। অন্ধকার রাত। মেঘশূন্য আকাশে আজ যেন তারার মেলা। ছোট-বড়, উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল বিভিন্ন রকমের তারাভরা আকাশের ভেতরে আবারও ভেসে উঠলো সেই মুখ! ওর স্বপ্নের সেই প্রভারানি।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, কাল বিকেলে যে করেই হোক, রকিব দাঁড়াবে মেয়েটির সম্মুখে। মনের যতো কথা জমা আছে, উজাড় করে দেবে। এমনি হাজারো এলোমেলো চিন্তা করতে করতে বিনিদ্র রাত কাটলো রকিবের। ফজরের আযান হলো, ঘুম নেই ওর চোখে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে, তবুত্ত মসজিদে গেল সে। নামাজে দাঁড়িয়ে মনটা কিছুটা স্থির হলো। সকালের নাস্তা সেরে ঘুমুতে গেল রকিব।

(আট)

ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। চোখ বন্ধ করেই রকিব বলল, হ্যালো কে ?
মামা আমি রাজু। সর্বনাশ হয়েছে মামা!
কেন কি হয়েছে ?
মামা, আমার নতুন আম বাগানের সবগুলো গাছ, কারা যেন কেটে ফেলেছে।
বলো কী! গাছ কেন কাটবে ?
রকিব আর কিছু ভাবতে পারে না। চোখ মেলে ঘড়িতে দেখে দুপুর বারোটা বাজে।
রাজু অস্থিরতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি এখন কি করবো মামা ?
রকিব একটু ভেবে উত্তর দেয়, তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমি থানায় সংবাদ দিচ্ছি। উনারা আসুক, দেখুক, কি বলেন শুনি; তারপর না হয় একটা কিছু করা যাবে। তুমি ভেঙে পড়ো না ধৈর্য ধরো; আম এক্ষুণি আসছি।
রকিবের জীবনে গাছ কেটে ফেলার এই প্রথম অভিজ্ঞতা।
ইতিমধ্যে থানা থেকে লোক এসে তদন্ত করে গেছেন। অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ছবি তুলেছেন। তাঁরা শিগগিরই ব্যবস্থা নিবেন, এমন আশার বাণী শুনিয়ে ফিরে গেছেন।
রাতের অন্ধকারে মানুষ খুন হয়, চুরি হয়, ডাকাতি হয়। কিন্তু এভাবে কয়েকশত আম গাছের চারা কেন কাটবে মানুষ! গাছের সাথে মানুষের এ কোন ধরণের শত্রুতা!
সারাটি দিন দৌড়ের উপরে কাটলো রকিবের। গত রাতের স্বপ্নের কথা উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়।
শ্রাবণের বিকেল। পশ্চিমের কোণে ঘন কালো মেঘ। রকিবকে বাইরে বেরুতে দেখে মা নিষেধ করলেন।
মায়ের কথা উপেক্ষা করে, রকিব বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। অস্থির চিত্ত। চোখে ভাসে বৃক্ষ-নিধনের মতো মানুষের জঘন্যতম হিংস্রতা। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা, বৃক্ষগুলির নাজুক দৃশ্য মনে হতেই, আবারও ছটফট করে উঠলো রকিব।
আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই রকিবের। উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছে সে। বুকের ভেতরে এতগুলি গাছ কাটার গভীর ক্ষত।
এতো কিছুর ভেতরে রকিব খেয়াল করল, হঠাৎ সেই বাড়ি থেকে একটি ছায়ামূর্তি পথে এসে দাঁড়িয়েছে। একবারে রকিবের মুখোমুখি। এই সেই স্বপ্নের নারী! কিন্তু কি চায় সে রকিবের কাছে ?
দুই জোড়া চোখ, চেয়ে আছে অপলক চোখের অরণ্যে। কি যেন খুঁজে ফেরে ওরা সেই বনভূমির গভীরে!
মেয়েটির ঠোঁট দুটি একটু কেঁপে উঠলো! কিছু কী বলতে চায় সে! আরও এক ধাপ এগিয়ে এলো রকিব। কিছু বলার জন্য সাহায্য করল মেয়েটিকে। একটু অস্পষ্ট শব্দ হলো, কিন্তু কিছু বোঝা গেল না।
শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল রকিবের দিকে। এমন মায়াবী চোখের আলো, এমন মায়াময় দৃষ্টি, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না রকিব। মেয়েটির হাত ধরে জোর ঝাকুনি দিল সে। সেই ঝাকুনিতে মনে হলো, বৃক্ষ থেকে সমস্ত শুকনো পাতা নিঃশব্দে ঝরে পড়ল।
রকিব আর একটু কাছে এসে বলল, কি নাম তোমার ?
মেয়েটি নির্বিকার!
রকিব আর একটু জোরে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়ে তোমার নাম কি ?
চমকে উঠলো রকিব। বিদ্যুৎ চমকালো দূরে! ভীষণ জোরে বজ্রাঘাতের শব্দে কেঁপে ওঠলো চারিধার! রকিব কানে হাত দিয়ে বসে পড়েছে মাটিতে। খুব কাছে কোথাও বজ্রপাত ঘটেছে। গত কয়দিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বজ্রপাতে অনেক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে।
কিন্তু একি ? মেয়েটি এখনো এমন নির্বিকার কেন ?
তা হলে মেয়েটি কি সত্যি সত্যি …
না না, তা হবে কেন ?
রকিব মেয়েটির মুখের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বলল, তুমি কী আমাকে শুনতে পাচ্ছো ?
মেয়েটির মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। ওর বুকের ভেতরটা আচমকা মোচড় দিয়ে উঠলো।
মেয়েটি কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে রকিবের চোখের দিকে চেয়ে থেকে তার হাতে একটি ফুলতোলা রুমাল গুঁজে দিয়ে দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল!
রকিব ভাবলো, ওকে ডেকে আর কোনো লাভ নেই।
রকিব অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটির পথপানে চেয়ে রইলো।

(নয়)

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। ভয়ানক মেঘের গর্জন, সেই সাথে মুষলধারে বৃষ্টি। মূহূর্তেই ভিজে গেল রকিব। তবুও দাঁড়িয়ে রইল সে। একসময় হাতের রুমালটি চোখের সামনে মেলে ধরলো রকিব। রঙিন সুতা দিয়ে ফুলতোলা চমৎকার একটি রুমাল। তাতে লেখা- ‘মনে রেখ’।
রুমালের এক কোণায় লাল সুতা দিয়ে লেখা- ‘শ্রাবণী’।
মুষলধারে বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে চারিধার। ভিজে ধুয়ে যাচ্ছে রকিব, সাথে শ্রাবণীর দেয়া প্রাণের উপহার মনে রেখ রঙিন রুমাল।
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে রাস্তা একেবারে জনশূন্য। উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছে রকিব।
এদিকে দোতলার জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিল শিউলি। মনটা উড়ু উড়ু। হঠাৎ দেখে, দূরে একটা লোক বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে চলে যাচ্ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে চিনতে পারে শিউলি। আনন্দে চিৎকার করে বলে ওঠে, রকিব ভাই, রকিব ভাই, রকিব ভাই না!
তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে সে রকিবের কাছে এসে দাঁড়ায়। রকিব কোনো কথা না বলে হেঁটে চলে।
শিউলি একসময় আচমকা রকিবের হাত ধরে ফেলে। অনুভূতিশূন্য রকিব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে দূরে দিগন্তের পানে।
শিউলি তখনো শক্ত করে ধরে রেখেছে রকিবের হাত। রকিবের তাতে কোনো অনুভূতি নেই।
হাতে মৃদু চাপ দিয়ে শিউলি বললো, এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর খারাপ করবে রকিব ভাই। আমাদের বাড়িতে চলুন, বৃষ্টি থামলে না হয় যাবেন।
কোনো কথা না বলে সামনে এগিয়ে চলেছে রকিব। শিউলি মরিয়া হয়ে, রকিবের পথ আগলে ধরে মিনতিভরা কণ্ঠে বললো, প্লিজ রকিব ভাই, এভাবে বৃষ্টিতে ভিজবেন না, আকাশে মেঘের ভয়ানক গর্জন, আপনার বিপদ হতে পারে। চলুন, ঘরে চলুন।
রকিব কিছু না বলে, শিউলির হাতে শ্রাবণীর ফুলতোলা রঙিন রুমালটি দিয়ে বৃষ্টির জলে স্নান করতে করতে সামনে এগুতে থাকে। হঠাৎ দপ করে নিভে যায় শিউলির জীবনের সব আলো। সে সবকিছু বুঝতে পেরে শ্রাবণীর রঙিন রুমালটি মুখে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
আকাশে আবারও বিদ্যুৎ চমকালো। আবারও গর্জে উঠলো মেঘমালা। আবারও অবিরাম বৃষ্টির জলধারা এসে ধুয়ে দিলো শিউলির চোখের অঝোর ধারা আর একটি নির্বাক বধির রঙিন রুমাল। তখনো তাকিয়ে রইলো রকিবের বৃষ্টি ভেজা পথের দিকে।

লেখক : কবি ও কথাশিল্পী