আহম্মদ হোসেন বাবু :
সুদীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে ফিরেছে রকিব। দেশের মাটিতে নেমেই, থরথর করে কাঁপছিল সে। মাটির সোঁদা গন্ধে চক্ষু বন্ধ করে, রকিব খুঁজে ফিরছিলো দুরন্ত কৈশোর-যৌবনের নানা রঙের দিনগুলো।
তিলোত্তমা ঢাকা শহরটি আরও সুন্দর হয়েছে। বড় বড় শপিং মল, উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়। তার ভেতরে থেকে চেনা রাস্তা, চেনা দোকান-পাটের কথা মনে করার চেষ্টা করছিল সে। ছোট ভাই রমিজ এসেছিল এয়ারপোর্টে বড় ভাইকে রিসিভ করতে। গাড়িতে বসেই রকিবের একটার পর একটা প্রশ্নে, ছোট ভাইয়ের একেবারে নাজেহাল অবস্থা। এরিমধ্যে বাবা-চাচার মৃত্যুসহ গ্রামের আর সব খবরাখবর জেনেছে ছোট ভাই রমিজের কাছ থেকে।
মা গ্রামের বাড়িতে আছেন জেনে রকিবের মন মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। সিঁড়ি দিয়ে বাসার দোতলায় উঠতে উঠতে রকিব বলল, আমি আজকেই রাতের বাসে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে চাই। তুমি আমার টিকেটের ব্যবস্থা করো।
ছোট ভাই রমিজের এক ছেলে এক মেয়ে। অনেক বড় হয়েছে ওরা। বড় আব্বু-বড় আব্বু করে একেবারে পুরো বাসা মাতিয়ে রেখেছে। ছোট ভাইয়ের সাজানো গোছানো সংসার দেখে মুগ্ধ হয়েছে রকিব।
ভাতিজা-ভাতিজির মায়াভরা আবদার উপেক্ষা করে রকিব রাতের গাড়িতেই রওনা হলো গ্রামের উদ্দেশ্যে। প্রায় বিশ বছর পরে মায়ের সাথে দেখা হবে রকিবের। চোখ বন্ধ করে মায়ের চাঁদমুখটি মনে করার চেষ্টা করল সে।
দ্রুত ছুটে চলেছে গাড়ি। জানালা দিয়ে রাতের বাংলাদেশকে পলকহীন দৃষ্টিতে দেখছে রকিব। একেবারে গ্রামের ভেতরে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলতে দেখে অবাক সে। মনে মনে ভাবলো, নিশ্চয় ওর গ্রামটিও এমনি আলো ঝলমল করছে। আজ কতো স্মৃতি মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে। প্রবাস জীবনের কত কষ্টের কথা, একটার পর একটা দৃশ্য যেন দ্রুত সরে যাচ্ছে। চোখে ঘুম নেই। দারুণ স্মৃতি কাতরতায় কাটলো পথের রাতটুকু।
ভোরে এসে গাড়ি পৌঁছাল। একটা ভ্যান রিক্সা নিয়ে সোজা বাড়ির দরজায়। রকিব অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে পুরো বাড়িটা ভালো করে দেখে নিল কয়েকবার। দরজায় টোকা দিয়ে একবার মা বলে ডাক দিতেই; বাড়ির ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো- কে? বাবা রকিব!
সেই ডাক! সেই আদরমাখা কণ্ঠস্বর! মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল রকিব।
মা দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তোমার বাবা তোমার কথা খুব করে বলছিল; দিন-রাত সবসময় শুধু রকিব আর রকিব। তোমার নাম জপতে জপতে তিনি চলে গেলেন। তোমার আর ভাগ্য হলোনা, বাবাকে দেখার- বলেই মা শাড়ির আঁচল দিয়ে অশ্রু লুকালেন।
কয়েকদিন দারুণ ব্যস্ত সময় কাটলো রকিবের। ওকে দেখার জন্য ছুটে এসেছে গ্রামের সকল শ্রেণির মানুষ। রকিব অনেককেই চিনতে পারে, কিন্তু এই প্রজন্মের অনেককে সে চিনতে পারেনা। এতো বছর পরে, এ এক অন্যরকম অনুভূতি।
(দুই)
কিছুদিন যেতে না যেতেই শুরু হলো করোনাকাল। চীনের উহান শহরের কোভিড-১৯ এর করাল থাবা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীময়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই করোনা মহামারির কাছে কত যে অসহায়, সেটা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছে রকিব।
প্রবাসীদের মধ্যে রকিবের অনেক পরিচিত বন্ধু ও সজ্জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে; অনেকেই মারা গেছে। বাংলাদেশে বসে বন্ধুদের জন্য নীরবে চোখের জল ফেলেছে সে।
বাংলাদেশেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করছেন। সেই সাথে লকডাউন এবং সাটডাউনের ভেতর দিয়ে চলছে এই দেশের মানুষের জীবন।
একদিন দুপুরের খাবারের টেবিলে মা রকিবকে বললেন, তোমার বাবা তো বেঁচে নেই, তাই আমাকেই বলতে হচ্ছে। এবার তুমি বিয়ে কর, প্রবাসে থাকার জন্যে তোমার বিয়ের অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি নয় বাবা, আমিও বউয়ের মুখ দেখার জন্যে হয়তো আজো বেঁচে আছি।
রকিব গ্লাছে জল ঢালতে ঢালতে বলেছিল, চারিদিকে এখন করোনা মহামারি মা, এখন কে তোমাকে মেয়ে দেবে ?
মা হতাশ হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ।
দেশের বড় বড় শহরগুলোতে করোনার প্রকোপ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুসংখ্যা। ঘরবন্দী জীবনে একেবারে হাঁপিয়ে ওঠেছে সে। শরীরের ওজনটাও বেড়েছে অনেক। হাঁটতে যাওয়া জরুরি, মনে মনে ভাবলো সেকথা।
রকিবের বাড়ির পেছন থেকেই শুরু হয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে, পাকা পিচঢালা পথ। আগে এই রাস্তাগুলো মাটির ছিল। বর্ষাকালে এসব রাস্তা দিয়ে চলাচল খুব কঠিন ছিল। বিদ্যুৎ আর এই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য রকিব বর্তমান সরকারের উপরে দারুণ খুশি।
ঘরবন্দী জীবনে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এক বিকেলে রকিব বেরিয়ে পড়লো গ্রামের রাস্তায়। দীর্ঘদিন পরে সূর্যের আলো গায়ে মেখে আকাশে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে রকিব মূহূর্তেই মিশে গেল প্রকৃতির মাঝে।
গ্রামের অনেক মানুষই এখন রকিবকে চেনে। রকিবের বাবা এই এলাকার একজন সৎ ও পরোপকারী মানুষ ছিলেন। এলাকায় তাঁর যথেষ্ট সুনাম এবং নামডাক। সেই সুবাদে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে রকিবও যে এতো আদর সম্মান পাবে- এটা সে কোনোদিন কল্পনা করেনি। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই রকিবও তার বাবার মতো সম্মানিত একজন মানুষ হয়ে উঠলো। কেউ ভাই ডাকে, কেউ ডাকে মামা, কেউ আঙ্কেল আবার কেউ কেউ বিদেশি বাবু বলে ডাকে। বিভিন্ন রকমের ডাকাডাকিতে ভরতে থাকে রকিবের মন-প্রাণ। গ্রামের সহজ সরল মানুষ, মাটি আর সবুজের সমারোহে, রকিবের মনটা একেবারে পুরোপুরি কবিমন হয়ে ওঠেছে। আজকাল মনে মনে ভাবে, কবিতা লেখার কাজটি হয়তো আবার সে শুরু করতে পারবে।
(তিন)
প্রকৃতির রূপসাগরে ডুব দিয়ে, পথ হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন ছয়টি মাস পার হয়ে গেছে। রকিবের কাছে মনে হয় যেন এইতো সেদিন। গ্রামের মানুষেরাও এখন বেশ স্বাস্থ্য সচেতন এবং করোনা সচেতন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পথ চলতে শিখেছে অনেকেই। রকিবের দেখাদেখি এখন অনেকেই সকাল-বিকাল হাঁটাচলা করে। রকিব গ্রামের নারী- পুরুষ সকলের সাথেই দারুণ আন্তরিকতার সাথে কুশল বিনিময় করে। তাই খুব তাড়াতাড়ি শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সকলের মধ্যমণি হয়ে ওঠে রকিব। একেকটি নতুন ঋতু আসে, আর বাংলার রূপ পাল্টে যাওয়া প্রত্যক্ষ করে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে ওর মন। সকালের মিষ্টি সোনারোদ, ঘুঘু ডাকা দুপুর, বিলের ডাহুক পানকৌড়ি, গোধূলির মায়াময় আলো, সন্ধ্যায় রাখালের ঘরে ফেরা, আর মাটির সোঁদা গন্ধে বিভোর হয়ে ঘরে ফেরে সে। প্রবাসে থাকা অবস্থায় সে ভীষণভাবে দেশকে উপলব্ধি করেছে। ছয় ঋতুর এই দেশে যাদুমাখা এই পরিবর্তন আবারও কবিতা লেখাতে অনুপ্রাণিত করেছে রকিবকে। এ বছরের বইমেলায়, এই বাংলার মোহিনী রূপ নিয়ে একটি কবিতার বই প্রকাশ করবে সে। রকিবের বাড়ির চারিদিকে সারাবেলা নানা রকম পাখির কিচির-মিচিরে মুখরিত থাকে চারিধার। মাঝে মাঝে সে ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যায় পাখির ডাক শুনতে। পাখির সুরে সুর মিলিয়ে সেও কিছু বলার চেষ্টা করে। বাড়ির চারিদিকে নারিকেল, সুপারি, তাল, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, আমসহ নানান রকমের গাছের সাথেও মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি যেন বলে রকিব। মনে মনে বলে- বৃক্ষ আমার বন্ধু।
(চার)
বরাবরের মতো আজও বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে রকিব। বিকেলের এই সময়টা ওর কাছে দারুণ প্রিয়। সে সারাদিন অপেক্ষায় থাকে এই সময়টার জন্য। আজকাল বৈকালিন ভ্রমণের আরেকটি মাত্রা যোগ হয়েছে!
শিউলি। হ্যাঁ শিউলি। শিউলি অবশ্য রকিবের একটি প্রিয় ফুলের নাম। তবে এখানে শিউলি একটি মেয়ের নাম। শিউলি ফুলের মতোই সুন্দর মিষ্টি সে। হালকা-পাতলা গড়ন। গায়ের রং শ্যামলা। এম এ ক্লাশের ছাত্রী। করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বাড়িতে এসেছে।
সেদিন বিকেলে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল! সাথে আরেকটি মেয়ে শিউলির বান্ধবী রীতা। এইচএসসি পাসের পর রীতার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আর লেখাপড়া সামনে এগুতে পারেনি। এই অতিমারির কারণে আবার দুই বান্ধবী কাছাকাছি এসেছে। শিউলির অতি আগ্রহের ব্যাপারটি বুঝতে রকিবের একটুও সময় লাগেনি। পড়ন্ত সেই বিকেল বেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওরা অনেক কথাই বলেছিল। সেসব কথা রকিবের মাঝে মাঝেই মনে পড়ে।
হঠাৎ দুই জন মুখোমুখি হতেই রকিবই প্রথমে কথা শুরু করেছিল সেদিন।
বলেছিল, আপনারা এখানে ?
লেখক : কবি ও কথাশিল্পী।