রত্না চক্রবর্তী
(গত সংখ্যার পর)
বরেণ্য কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার বলেছেন – “চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে, কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশী বিশে দংশে নি যারে”। কবির উক্তি চিরায়ত এবং শাশ্বত। তাই বার বার বলতে ইচ্ছে করে “৭১” কে বুঝতে হলে দংশনকে বুঝতে হবে !
আমার বাবার মামাবাড়ি ছনদন্ডী গ্রাম থেকে সেদিন ৫ জন ছেলে যাবে ঠিক হলো। ২ দালাল কিছুতেই মহিলাদের নিয়ে যেতে রাজি হলো না। ৫ জনের মধ্যে ১ জন আমার ভাই ১২ বছরের বালক, আমার ২ কাকু, ঐ বাড়ির দাদা আর পাশের বাড়ির ১ জন। দালাল সবাইকে বলল পুরানো কাপড় পরবেন, হাতে কিছু নেবেন না। মা আমার কাকুকে একটা রেডক্রসের চিহ্ন দেখিয়ে বলে দিল, তোমরা ঐ পারে পৌঁছে ছোট্ট কাগজে রেড ক্রসের শুধু এই চিহ্নটা দিও, তাহলে বুঝতে পারবো তোমরা নিরাপদে পৌঁছেছ। অনেক ভোরে ওরা রিকশা করে বাসস্ট্যান্ড গিয়ে বাস থেকে নেমে পটিয়ার কাছে নদীর ঘাটে গিয়ে লঞ্চে চাপল। নদীপথে তল্লাশি ছিল না, তাই তখন সবাই এই পথেই যেতো। লঞ্চ থেকে নেমে চাকতাইর একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিরতি। এখানে ওদের সাথে আরো ৭ জন যোগ হয়। দালাল ওদের একটু খাবার ব্যবস্থা করল। খেয়ে মোট ১২ আর দালাল ২ জন সহ ১৪ জন মিরেরসরাইর বাসে উঠে মোড়লগঞ্জ নামে। তখন ভীষণ বৃষ্টি, গ্রামের কাদা রাস্তা, ওখান থেকে ফেনী নদীর কাছে যেতে প্রায় ৫ মাইল রাস্তা পার হয়ে বডার্র ক্রস করতে হবে। ৭ টি রিকশায় করে সবাই যাচ্ছিল, ১ মাইল যেতেই পাকিস্তানী প্রায় ১২ জন হানাদার । দূর থেকে খুব জোরে হুঙ্কার দিয়ে থামতে বলল। দালাল আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল কি বলতে হবে। তার উপর সবার গায়ে বেশ করে কাদা মাখা, যাতে মনে হয় সবাই হালচাষ করে বাড়ি ফিরছে। দালালের শেখানো বুলিগুলো সবাই খুব ভাল করে উচ্চারণ করল। পাক সেনারা একটু আশ্বস্ত হলো যে, এরা গ্রামের গরীব কৃষক, মুক্তিবাহিনী নয়। উপরন্তু ওদের রাস্তায় দেরী করালে বাড়িতে বাচ্চারা খাওয়ার কষ্ট পাবে। তাই প্রতিটি রিকসা টান দিয়ে কাদা থেকে ভালো রাস্তায় উঠিয়ে দিল। ওদের হাত থেকে বেঁচে ফেনী নদী পার হয়ে গ্রামের ধান ক্ষেতের আলের উপর প্রায় ৭ মাইল হেঁটে বর্ডার পার হতে হবে। তখন সন্ধ্যা ৭ টা। ধান ক্ষেতের আলের উপরের লাইন ধরে সবাই কোন শব্দ না করে হাঁটছে। দু’ পাশে হাঁটুর উপর জল। হঠাৎ একজন অন্ধকারে পা পিছলে বিলের জলে পড়ে গেল। সাথে সাথে বৃষ্টির মতো গুলি ও লাইটের ফোকাস। সবাই জলে নেমে ডুব দিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করল ও বাঁচার আশা ছেড়ে দিল। আধ ঘন্টা এভাবে চলার পর দালাল খুব নীচুস্বরে সবাইকে খুঁজতে লাগলো। ১০ মিনিটের মধ্যে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা এসে ওদের সবাইকে জল থেকে টেনে উঠিয়ে বর্ডার পার করার ব্যবস্থা করে দিল। “এ জন্যই ওরা বীর – আমাদের সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা”।
মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ভারতীয় সেনাসদস্যদের কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নির্দ্বিধায় প্রাণ দিয়েছেন। এককথায়, ত্রিশ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের আত্মোৎসর্গের বিনিময়েই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছি। স্বাধীন দেশের বাসিন্দা হিসেবে প্রতিটি ক্ষেত্রে যার যার দায়িত্বপূর্ণ কাজ সঠিকভাবে সমাপ্ত করে দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিলেই শহীদদের সম্মান করা হবে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে।
অথচ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বেশ কিছু কাল ধরে চলছে লুটপাটের রাজত্ব এবং সরকারি কোষাগার লুন্ঠনের তীব্র প্রতিযোগিতা। আগে হাতে গোনা কয়েকজন কোটিপতি থাকলেও এখন দেশে কোটিপতির সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা অত্যন্ত দুরূহ।
জানা মত, আগে ব্যবসায়ীগণ সের বা কেজি প্রতি ২ টাকা- লাভ করেই সন্তুষ্ট হয়ে ঘরে ফিরতো, এখন ১০০ টাকা- খাটিয়ে ৩০০/- মুনাফা করার ধান্দায় ব্যস্ত ! আমাদের মতো কয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রতিটি দেশে দেশের মানুষকে কতো বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায় তার জন্য প্রত্যেকে যার যার কাজের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে। তাই আজ তারা উন্নত, প্রকৃত শিক্ষায় উদ্ভাসিত। তারা মেধা কিনতে পারে, আর আমরা মেধা কে দেশ ত্যাগে বাধ্য করি। শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার বিভিন্ন কায়দা ! সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছি চাকরীর পর টিউশানী সেরে রাত ১১ টায় আমার বাবা বাড়িতে ঢুকেই বাড়ির ৫টি লাইট অফ করে ঘরে ঢুকতো। সেই যে দেশের সম্পদ রক্ষা করতে শেখা তার অভ্যেসটা আজো যায় নি। অবাক কান্ড ! আমার ২ বছরের ও কম বয়সের নাতিটিও তাই করছে। ঘরের অপ্রয়োজনীয় লাইট নিজেই নাগাল পেয়ে অফ করে দেয়। আমি মনে করি এটাই দেশকে দেশের সম্পদকে ভালবাসতে শেখা। তখন ভীষণ কষ্ট হতো যখন দেখতাম প্রায় অনেকের ঘরে গ্যাসের চুলা জ্বলছে। এখন তার ফল ভোগ করছে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ। সেই প্রথম থেকে দেশের অমূল্য সম্পদকে রক্ষা করার কোন পরিকল্পনা নেই। কি করে থাকবে, সবকিছু তো দেশপ্রেমিক জনগণ দ্বারা পরিচালিত ! মেধা তো পাচার। অথবা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে যোগ্য লোককে হটিয়ে দেয়া। এইসব বলতে কষ্ট হয়, শুধুমাত্র আমাদের প্রজন্মকে কিছুটা যদি জাগ্রত করতে পারি, তাই এই প্রচেষ্টা।
আমাদের পরিবারের কয়েকজন সদস্য অন্তত প্রাণে বাঁচলো, এই ভেবে সবাই একটু নিশ্চিন্ত হলো। পরের দিনই একজন দালাল এসে রেডক্রস চিহ্নের ছোট্ট কাগজটা দিয়ে গেল। সবাই ঠিক আছে বললো। এরপর শুরু হলো আমাদের বাঁচার বিভিন্ন রকমের সংগ্রাম।
৭১ এর জুলাই মাসের প্রথম দিকে, প্রায় ১৫ দিন থেকে পাকিস্তানী হানাদার আর গ্রামে আসছে না। সবাই বলছে কি করে আসবে এখন তো মুক্তিবাহিনী গ্রামের ঝোঁপ জঙ্গল পাহাড়ে ছড়িয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছে। এরা গ্রামে ঢুকলেই ভ্যানিশ হয়ে যাবে। কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছি একটা লোক অষ্টছেঁড়া কাপড় পরিহিত, গ্রামের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ধুলো কাদা মেখে ঘুরছে। সারা মুখ চুল দাঁড়ি ভর্তি, দেখে বোঝার উপায় নেই বয়স কতো। কখনো আপন মনে হাসছে, কখনো গাছের পাতা ভাঁজ করে মুখে দিয়ে পিপ করে বাঁশির মতো শব্দ করে। গ্রামের প্রায় সবাই যারা যা পারছে ওকে খেতে দিচ্ছে। সে কখনও মানুষের খুব কাচ্ছাকাচ্ছি দাঁড়াতো না, একটু দূরত্ব বজায় রাখতো। এই সময় আমরা বাড়ি থেকে বেশি দূর যেতাম না। এখন পাকিস্তানী হানাদারদের চাইতে দেশীয় হানাদারদের অত্যাচারের ভয়। তাই বেশি মানুষদের দলের সাথে সারাদিন কাটাতাম। তখন এতো সব বুঝতে পারিনি, স্বাধীনতার পর যখন জানলাম, ওই ছেলে মুক্তিবাহিনীর কাছে খবর আদান প্রদান করতো। তখনই ওর গতিবিধি চোখের সামনে ভেসে উঠল।
গ্রামে হানাদারের হামলা বন্ধ হওয়ায় মানুষ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের খবর আদান প্রদান করছে। তাই আমরা দেশের আত্মীয়দের খবর নিচ্ছিলাম বিভিন্ন লোক মারফৎ। এদিকে আমার ঠাকুর মাকে নিয়ে আমরা সবাই একটু বিব্রত হয়ে পড়েছি। তিনি অনবরত নীরবে চোখের জল ফেলছেন। স্বামীর শোক তো আছেই তার উপর তাঁর ছোট ছেলে অর্থাৎ আমার কাকু, উনার দেওরের ছেলে, আমার আর এক কাকু, তাঁর অল্প বয়সী নাতি, আমার ছোট ভাই সবার বিছিন্ন হয়ে চলে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তার উপর খবর পাওয়া গেল আমার ছোট পিসি তাঁর অতি আদরের ছোট মেয়ে সন্তানসম্ভবা। তাই এই যুদ্ধের ডামাডোলে কি করে পিসি এই গ্রামে গঞ্জে নিরাপদে মুক্ত হবে তা ভেবে অনবরত চোখের জল ফেলছেন। তাঁকে খুশী করার জন্য আমরা বাড়ির ছোট ছেলেদের ট্রেনিং দিয়ে বুঝিয়েছি কিভাবে “চরমপত্রের প্রতিটি ডায়লগ তাঁকে অভিনয় করে শোনাবে যাতে তিনি খুব আনন্দ পান। এতে খুব কাজ হলো, ঠাকুরমা ওদের কথায় অভিনয়ে খুশী হয়ে বলল ওই মুক্তিবাহিনী, জেনারেল পিয়াজীকে(নিয়াজী) কবে হটিয়ে দেবে আমি তো তাই দেখার জন্য মনের জোর নিয়ে বেঁচে আছি।
জুলাইয়ের শেষভাগে খবর পাওয়া গেল গ্রামের রাজাকার, আলবদর আলসামস বাহিনী মানুষের উপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করছে। পরের দিন সোহবানকাকু এসে আরো বলল, এই সব রাজাকার, আলবদর, আলসামসের গুন্ডারা ভীষণ নির্যাতন করছে। গ্রামে যাদের বাড়ি নয় তাদের কোন রকম কথা না শুনেই ধরে একদম ব্যারাকে নিয়ে যাচ্ছে। এই খবর শুনে বাবা খুব মুষড়ে পড়লো। অতএব, আমাদের নতুন গন্তব্যের সন্ধানে যাত্রা শুরু হলো।
এবার শুরু হলো খোদ নিজ দেশের ঘরের শত্রু বিভীষণদের অত্যাচার। তারা গ্রামের অচেনা লোকদের ধরে নিয়ে ব্যারাকে নিয়ে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তাই আর দেরী করা যায় না, ঠিক হলো পরের দিনই রওনা হতে হবে, আবার চট্টগ্রাম শহরে। কিন্তু কোথায় যাবো ? আমাদের এতোব ড় বাড়ি, এর ত্রিসীমানায় ও যাওয়া যাবে না। ২৭শে মার্চ আমাদের পূর্ব বাংলার বীর সেনাবাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্ট খালেক বিল্ডিং থেকে আক্রমণ চালানোর দরুন হানাদাররা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আমাদের বাড়ির প্রতিটি মানুষকে শিকারীর মতো খুঁজছে। তাই বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গোপনে থাকতে হবে। তখন মোবাইল ছিল না, তাই খবর দেয়া নেয়া করে কোন ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। বাবা বলল আমি একটা জায়গা চিন্তা করেছি, একটা সংস্থান নিশ্চয়ই হবে। ঠিক হলো খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগে রওনা হতে হবে। বাড়ি থেকে একটু দূরে পরিচিত একজনের দোকানে ঘন্টা খানেক বসে তারপর রওনা হতে হবে। প্রথমতঃ কেউ যেন বুঝতে না পারে আমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। দ্বিতীয়তঃ এবার আমি সহ ৩ জনকে বোরখা পরতে হবে, হিন্দু বাড়ি থেকে বোরকা পরে বের হওয়া যাবে না। ভোরে আমাদের যাবার পালা – সাধারণত কোন বাড়িতে এতো গুলো মানুষ বেশিদিন থাকলে চলে গেলে মনে হয় হাফ ছেড়ে বাঁচলো। না এই বাড়ির ছোট থেকে বড় প্রত্যেকে এমন ভাবে ফুঁফিয়ে কাঁদছিল মনে হচ্ছিল, “যেতে নাহি দেব হায় তবু যেতে দিতে হয়”।
আমরা দোকানে গিয়ে বোরখা পরে নিলাম, ঠাকুর্মাকে মা পরিয়ে দিল। আশ্চর্য, জীবনের মায়া কি অপূর্ব সৃস্টি ! সংস্কারে আবদ্ধ আমার বুড়ো ঠাকুর মা বোরখা পরা নিয়ে একবারও কোন আপত্তি করলো না। একটু ভোরের আলো ফুটলে হঠাৎ বাবাকে দেখে আমি তো থ ! আমার তাকানো দেখে বাবা হেসে বলল, এসব আমি আগেই যোগাড় করে রেখেছি। সাদা লম্বা পাঞ্চাবী পায়জামা গলায় ক্রুশ, ঠিক যেন খ্রিস্টান ধর্মগুরু। বাবা বলল রাস্তায় কেউ আমার সাথে কথা বলবে না, আমাকে বাবা ডাকবে না। এমন ভাবে থাকবে যেন আমি তোমাদের কেউ নই। তোমরা সোবহানের মানুষ। এসব বলে বাবা আগেই রওনা হয়ে গেল। আমরা ৩ ভাইবোন মা ঠাকুরমা সোবহান কাকুর সাথে রিকশা পরে বাসে করে নদীর ঘাটে পৌঁছলাম। লঞ্চ ঘাটে ছিল, সোবহানকাকু টিকেট কেটে আমাদের লঞ্চে বসিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় বললো, “সগিরা তোয়ারা রে নামাই লইব, কন চিন্তা ন কোরগো” আসলে কেউ আসবে না, লঞ্চের লোকদের বোঝানো ওরা একা নয়। এবার সোবহানকাকু লঞ্চ থেকে নেমে যাবে। আমি একটা প্রণাম করতে উঠতেই সোবহানকাকু ইশারায় না করলো। পরে বুঝতে পেরেছি আমার প্রণাম দেখে সবাই বুঝে ফেলবে আমরা হিন্দু, এখানে সোবহানকাকু পর্ব শেষ।
জীবনে প্রথম এই ছোট লঞ্চে ওঠা। একদিকে নদীর বুকের উপর যাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে বিপদের অজানা আশঙ্কা। হঠাৎ দেখি ৫ জন লোক বিদঘুটে ড্রেস পরা হাতে অস্ত্রসহ বেশ জোরের সাথে বলছে সবার ব্যাগ খোল। আমরা তল্লাশি করবো, এখানে কোন মুক্তি বাহিনী আছে কি না দেখতে হবে। কিছু তো পাবে না, নির্যাতন এর ভয়ে সবার মুখে দুরু দুরু ভাব। ৩০ থেকে ৩৫ বছরের ৪ জন কে লঞ্চ এর সীট থেকে উঠিয়ে নীচে বসালো, ওরা সীটে গিয়ে বসলো। তারপর শুরু হলো অকথ্য ভাষায় বিভিন্ন রকম প্রশ্ন সাথে চড় থাপপড়। হঠাৎ এদের জানোয়ারদের মধ্যে বস টাইপের একজন সীটে বসে পা উঁচিয়ে বুট জুতা দিয়ে দুই জনের গালে জোরে মেরে দিল। আর চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি, শুধু মনে মনে ঈশ্বরকে বলেছিলাম এদের তুমি উপযুক্ত শাস্তি দিও। পাঠক, যে ঘটনা গুলো জানাবো ভেবেছিলাম আজ আর পারলাম না। এইসব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠায় মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে গেল। পরের পর্ব পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করো।
(চলবে)।আমাদের বাড়ির প্রতিটি মানুষকে শিকারীর মতো খুঁজছে। তাই বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গোপনে থাকতে হবে। তখন মোবাইল ছিল না, তাই খবর দেয়া নেয়া করে কোন ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। বাবা বলল আমি একটা জায়গা চিন্তা করেছি, একটা সংস্থান নিশ্চয়ই হবে। ঠিক হলো খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগে রওনা হতে হবে। বাড়ি থেকে একটু দূরে পরিচিত একজনের দোকানে ঘন্টা খানেক বসে তারপর রওনা হতে হবে। প্রথমতঃ কেউ যেন বুঝতে না পারে আমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। দ্বিতীয়তঃ এবার আমি সহ ৩ জনকে বোরখা পরতে হবে, হিন্দু বাড়ি থেকে বোরকা পরে বের হওয়া যাবে না। ভোরে আমাদের যাবার পালা – সাধারণত কোন বাড়িতে এতো গুলো মানুষ বেশিদিন থাকলে চলে গেলে মনে হয় হাফ ছেড়ে বাঁচলো। না এই বাড়ির ছোট থেকে বড় প্রত্যেকে এমন ভাবে ফুঁফিয়ে কাঁদছিল মনে হচ্ছিল, “যেতে নাহি দেব হায় তবু যেতে দিতে হয়”।
আমরা দোকানে গিয়ে বোরখা পরে নিলাম, ঠাকুর্মাকে মা পরিয়ে দিল। আশ্চর্য, জীবনের মায়া কি অপূর্ব সৃস্টি ! সংস্কারে আবদ্ধ আমার বুড়ো ঠাকুর মা বোরখা পরা নিয়ে একবারও কোন আপত্তি করলো না। একটু ভোরের আলো ফুটলে হঠাৎ বাবাকে দেখে আমি তো থ ! আমার তাকানো দেখে বাবা হেসে বলল, এসব আমি আগেই যোগাড় করে রেখেছি। সাদা লম্বা পাঞ্চাবী পায়জামা গলায় ক্রুশ, ঠিক যেন খ্রিস্টান ধর্মগুরু। বাবা বলল রাস্তায় কেউ আমার সাথে কথা বলবে না, আমাকে বাবা ডাকবে না। এমন ভাবে থাকবে যেন আমি তোমাদের কেউ নই। তোমরা সোবহানের মানুষ। এসব বলে বাবা আগেই রওনা হয়ে গেল। আমরা ৩ ভাইবোন মা ঠাকুরমা সোবহান কাকুর সাথে রিকশা পরে বাসে করে নদীর ঘাটে পৌঁছলাম। লঞ্চ ঘাটে ছিল, সোবহানকাকু টিকেট কেটে আমাদের লঞ্চে বসিয়ে চট্টগ্রামের ভাষায় বললো, “সগিরা তোয়ারা রে নামাই লইব, কন চিন্তা ন কোরগো” আসলে কেউ আসবে না, লঞ্চের লোকদের বোঝানো ওরা একা নয়। এবার সোবহানকাকু লঞ্চ থেকে নেমে যাবে। আমি একটা প্রণাম করতে উঠতেই সোবহানকাকু ইশারায় না করলো। পরে বুঝতে পেরেছি আমার প্রণাম দেখে সবাই বুঝে ফেলবে আমরা হিন্দু, এখানে সোবহানকাকু পর্ব শেষ।
জীবনে প্রথম এই ছোট লঞ্চে ওঠা। একদিকে নদীর বুকের উপর যাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে বিপদের অজানা আশঙ্কা। হঠাৎ দেখি ৫ জন লোক বিদঘুটে ড্রেস পরা হাতে অস্ত্রসহ বেশ জোরের সাথে বলছে সবার ব্যাগ খোল। আমরা তল্লাশি করবো, এখানে কোন মুক্তি বাহিনী আছে কি না দেখতে হবে। কিছু তো পাবে না, নির্যাতন এর ভয়ে সবার মুখে দুরু দুরু ভাব। ৩০ থেকে ৩৫ বছরের ৪ জন কে লঞ্চ এর সীট থেকে উঠিয়ে নীচে বসালো, ওরা সীটে গিয়ে বসলো। তারপর শুরু হলো অকথ্য ভাষায় বিভিন্ন রকম প্রশ্ন সাথে চড় থাপপড়। হঠাৎ এদের জানোয়ারদের মধ্যে বস টাইপের একজন সীটে বসে পা উঁচিয়ে বুট জুতা দিয়ে দুই জনের গালে জোরে মেরে দিল। আর চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি, শুধু মনে মনে ঈশ্বরকে বলেছিলাম এদের তুমি উপযুক্ত শাস্তি দিও। পাঠক, যে ঘটনা গুলো জানাবো ভেবেছিলাম আজ আর পারলাম না। এইসব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠায় মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে গেল। পরের পর্ব পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করো। (চলবে)।