
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ ধাপ।
নভেম্বর মাস। চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকার দেবেন্দ্র মহাজন এর ৪ তলা বাড়ি। আমরা যারা ঐ বাড়িতে যুদ্ধের সময় আশ্রয় নিয়েছিলাম, প্রায় ৯০ শতাংশ বাইরের। এক একটা ফ্ল্যাটে ৪ টা করে পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। সব সমেত ৫০ পরিবার ঐ বিল্ডিং-এ ছিল। সেদিন রাত ২টা, দারোয়ান জানতো কি করতে হবে। ৯জন যুবক (আলবদর আলসামস) হাতে অস্ত্র, গেইটে ভীষন শব্দে গেইট খুলতে চীৎকার করছিল। দারোয়ান এতো জোরে কাশি শুরু করল, এই কাশির মধ্যে ছিল পালিয়ে যাওয়ার সংকেত, ধুম ধুম করে যতো মুক্তিযোদ্ধা ছিল সবাই পাঁচিল বেয়ে লাফ দিয়ে নিরাপদে চলে গেল। নিশ্চিত হয়ে দারোয়ান গেইট খুলে দিল। গেইট খুলতে দেরী হওয়ায় সেই দারোয়ান চাচা কে লাথি কিল ঘুষি মেরে রাগের মাশুল তুলে নিল, যা আমরা সবাই শব্দের মাধ্যমে অনুভব করলাম। ২ জন গেইটে পাহারায় থাকলো বাকি ৭ জন তল্লাশির নামে সব রুম শেষ করে আমাদের রুমে এসে ঐ বিল্ডিং এর যতো জন পুরুষ ছিল সবাইকে বারান্দায় এনে একসাথে হাত তুলে দাঁড় করিয়ে রাখলো। ওদের রাগ কোন অল্প বয়সী অর্থাৎ ৫০ বছরের নীচে কাউকে পায়নি। পেলে মুক্তিবাহিনীর লোক বলে ব্যারাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নিজেদের আখ্যায়িত নাম গুলোর যর্থাথতা প্রমাণ করতে পারতো, দারোয়ান চাচা তা হতে দেয়নি, তাই অত্যাচারের পুরো মাত্রা টা উনার উপর প্রয়োগ করেছে। তারপর শুরু হলো বয়স্ক লোক গুলো, যাদের হাত তুলে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তাদের উপর আস্ফালন।

একজন বলল, আলবদর এর কমান্ডার সাহেব আপনাদের কিছু প্রশ্ন করবেন, ঠিকমতো উওর না দিলে বিপদ আছে। এই বাড়িতে কোন বাইরের ছেলে আসে কি না, বার বার তা জিজ্ঞেস করছিল, যাতে ভয় পেয়ে কেউ বলে দেয়। কারো মুখ থেকে কিছুই বের হয়নি। প্রত্যেকের বয়স ৫০ এর উপর তাই কাউকে মারতে সাহস হয়নি। আমাদের সামনেই আবার দারোয়ান কে খুব মারলো, হঠাৎ একটা কল আসে ওয়ারলেস এ, প্রায় দৌড়ে ওরা চলে যায়। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করলেন। পরে দারোয়ান চাচা কে সবাই মিলে ওষুধ পত্র দিয়ে ভালো করলো। উনি বললেন ২০ বছর আগে এই বাড়িতে কর্তা আমাকে জায়গা দিয়েছেন, উনার ঋণ শোধ করতে পারবো না, তাই যতক্ষণ আমার জান থাকবে আপনাদের কিছু হতে দেবো না। সেই দিনগুলো প্রতিদিনই এক একটা ঘটনা।
নভেম্বর মাস, পুরো চট্টগ্রাম শহরের চারদিকে থমথমে ভাব। সবাই বলাবলি করছে গ্রাম থেকে যতো রাজাকার আলবদর আলশামস আছে সব শহরে চলে এসছে। কারণ গ্রামে চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনীরা অস্ত্রসহ এগিয়ে এসছে। তারা ঐ গ্রামের আঞ্চলিক ভাষা শিখে গ্রামের লোকের সাথে মিশে গেছে, তাদের চেনার উপায় নেই। কাকে কখন চোরাগোপ্তা আক্রমণ করবে, এই ভয়ে প্রাণ নিয়ে সব মীরজাফরের দল লেজ গুটিয়ে শহরে এসে জড়ো হয়েছে। প্রতিদিনই শহরের কোন না কোন বাড়িতে তল্লাশির নামে হামলা করছে। শহরের সব মানুষের আতঙ্কে রাতদিন ঘুম নেই।
প্রতিদিন খবর পাওয়া যাচ্ছে আজ অমুক জায়গায় হানা দিয়ে কোন নেতা, সাংবাদিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উকিল, মোটের উপর দেশের সব শিক্ষিত নামি দামি যাকে পাচ্ছে ধরে পাকিস্তানী হানাদারদের ব্যারাকে নিয়ে যাচ্ছে। কাউকে নির্যাতন করে ছেড়ে দিচ্ছে, আর যাদের ছাড়েনি তাদের স্বাধীনতার পর আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি, তারা শেষ মূহুর্তে আর রক্ষা না পেয়ে শহীদদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেন। আমাদের যারা চেনাজানা তারা সবাই কী করবেন একে অন্যের পরামর্শ চাইলেন। পরের দিনই ভোর থেকে আমরা দেখছি মানুষ আবার গ্রামের দিকে ছুটছে। আমাদের দেবেন্দ্র মহাজন এর বিল্ডিং এর প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ উধাও। নিজেকে বাঁচানোর জন্য মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। কেউ কাউকে কিছু বলছে না, চুপচাপ পালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যে আত্মীয়রা এতোদিন একসাথে ছিল। তারাও আমাদের চোখের সামনে রওনা হয়ে যাচ্ছে। কেউ সঙ্গে যেতে বলল না। আমাদের শহরে এত বড় বাড়ি, গ্রামে আমাদের কোন বাড়ি নেই। কিন্তু আমাদের বাড়ির ধারে কাছেও যাওয়ার জো নেই, ওদের নজরে পড়লে আর রক্ষা নেই, আমরা কোথায় যাবো! বাবা বলল সবাই মনকে শক্ত করো, এখান থেকে আর কোথাও নড়বো না। বিপদের সাথে সংগ্রাম করে এতো মাস কাটালাম, বাকিটা ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দাও। মা ঠাকুরমা শুধু চোখ মুছছে। বাবা আরো বলল, বাড়ি ওয়ালার দা বটি ছুরি যা আছে সব এক জায়গায় জড়ো করে রাখো, কেউ আক্রমণ করতে আসলে ওকে মেরে তারপর মরবো। সবাই যাওয়ার পর ও ৬, ৭ জন উচ্চশিক্ষিত কাকুরা ছিলেন। উনারা বাবাকে খবর দিলেন, সবাই সন্ধ্যার সময় ৪ তলা একটু নিরাপদ হওয়ায় আমাদের ঘরে একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন পরবর্তী দিনগুলো কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
(চলবে)।