একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শিশু মুক্তিযোদ্ধা ও কিছু স্মৃতি

শহীদুল ইসলাম তালুকদার :

১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। যেমন তারা ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। সত্তরের নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের এত বড় ভরাডুবি হবে, তা তারা কখনো ভাবতেও পারেনি। বিশ্বের গণতন্ত্রকামী দেশগুলোও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ধরে নিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানও কিছুটা নমনীয় হয়েছিলেন, কিন্তু বাধ সাধেন লারকানার নবাব, কুখ্যাত জুলফিকার আলী ভুট্টো।

ইয়াহিয়া ও ভুট্টো যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরাজিত সৈনিকেরা, বিশেষ করে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী, নুরুল আমিন, জামায়াত নেতা গোলাম আজম প্রমুখ ভুট্টো ও ইয়াহিয়াকে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা না দিতে অনুরোধ করেন।

বৈঠকের নামে নানা টালবাহানা করে শেষ পর্যন্ত ২৫ মার্চ সামরিক আইন জারি করে কুখ্যাত ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের প্রাক্কালে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এই লোক (শেখ মুজিব) ও তার দলকে সমগ্র পাকিস্তানের ১২ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না।’ এখানে অনেকে মনে করেন ও বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি বা স্বাধীনতা চাননি। অনেকে আরো বলেন, উনি সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রয়াসে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন! কিন্তু ৭ মার্চের ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ভাষণেই পুরোপুরি স্বাধীনতাসংগ্রামের ঘোষণা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া ডাকসুর তৎকালীন ভিপি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন, তখন তিনি তাদের বাধা দেননি।

স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারে যে Controversy রয়েছে, তারও সহজ সমাধান রয়েছে। মেজর জিয়াউর রহমানের দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরে ঘোষণা পাঠ-দুটিই ছিল কিছুটা Confusing। কেননা তিনি যে পদে ছিলেন, সেখান থেকে তার পক্ষে একটা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার মতো Protocol ছিল না। তিনি ছিলেন বেশ Excited ও Confused।
যা-ই হোক, স্বাধীনতা ঘোষণা হলো এবং স্বাধীনতা এল, যার সুফল আজ আমরা ভোগ করছি। ১৯৭১ সালে আমি পিরোজপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। পিরোজপুরে আর্মি আসে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে। প্রথমে দু-তিন দিন কোনো অ্যাকশনে না এলেও চতুর্থ দিনে তারা তিন-চারটি স্পিডবোটে রাজাকারসহ আমাদের পার্শ্ববর্তী টোনামাধব গ্রামে হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে মোট ৪৬ জন হিন্দুকে হত্যা করে। পাক আর্মি চলে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পরে আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধুসহ বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখি, একটি ডোবার মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি লাশ।

ওই লাশগুলোর মধ্যে একটি ছিল আমার স্কুলবন্ধু অনিলের। অনিলের বড় ভাইকে দেখলাম ভাইয়ের লাশ জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছেন। আমি অনিলের লাশ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলাম না। তার ভাইকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দেখলাম, আমার শরীরও রক্তে ভিজে গেছে। আমি জীবনে এত লাশ ও এত রক্ত কখনো দেখিনি। অনিল আমার এত ভালো বন্ধু ছিল যে নবান্নের সময় আমি তো যেতামই, সঙ্গে সঙ্গে ওর মা, অর্থাৎ মাসিমা আমাদের বাড়ির সবার জন্য নবান্ন পাঠিয়ে দিতেন। তা ছাড়া অনিল ছিল আমার একজন আদর্শ বন্ধু। অর্থাৎ আমরা দুজনই ছিলাম বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমি ছিলাম পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (পরে বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন) পিরোজপুর কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও অনিল ছিল সাংগঠনিক সম্পাদক। ভালো বক্তা ছিল সে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা চীনকে সমর্থন করতাম এবং আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে আমরা CPIML-Communist Party of India (Marxist-Leninist)-কে সমর্থন করতাম। যার নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চারু মজুমদারদের ভারতের রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় জানানোর প্রয়াস চালাতে গিয়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছিলেন। চারু মজুমদারদের পতনের পর আমরা মন্দের ভালো CPIM (Communist Party of India, Marxist)-কে সমর্থন করতাম। এর নেতৃত্ব ছিলেন পি সুন্দরাইয়া, জ্যোতি বসু, সুরজিৎ সিং প্রমুখ।
তাদের মধ্যে জ্যোতি বসু ও সুরজিৎ সিংয়ের সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ হয়েছে আমার। জ্যোতি বসু ছিলেন ভারতের বাঙালি রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ১৯৯৬ সালে দেব গৌড়ার স্থলে তারই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পার্টির হটকারী ও সংকীর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য তা সম্ভব হয়নি। আর CPI-এর রাজনীতি বরাবর ছিল মস্কোপন্থী। তাদেরকে আমাদের দল কখনো সমর্থন করত না। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন দাঙ্গে, ডি রাজা প্রমুখ। তা ছাড়া বাংলাদেশে তাদের দোসর সিপিবি (মণি সিং) ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি)-এর প্ররোচনার জন্য বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু কারও কাম্য ছিল না।

আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের আজকের রাজনীতির অস্থিরতা ও ভারতের প্রতি আমাদের অস্বাভাবিক নির্ভরতা তাঁর মৃত্যুর জন্য হয়েছে। উনি বেঁচে থাকলে ভারত আমাদের ওপর এত মাতব্বরি করতে পারত না।

ওইদিনের বধ্যভূমি থেকে ফিরে রাতে কিছুই খেতে পারিনি। ঘুমও আসছিল না। বারবার স্কুলবন্ধু অনিলের মুখখানা ভেসে উঠতে লাগল। আমরা ছিলাম তরুণ বিপ্লবী। একে অন্যকে ‘কমরেড’ বলে ডাকতাম। শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং পায়চারি করতে করতে ভাবলাম, এর প্রতিকার করতে হবে। এভাবে ওরা আমাদের মারতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে। ওদেরকে মেরে তাড়িয়ে বিদায় করে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। মনে পড়ল বঙ্গবন্ধুর অমর ঘোষণা : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এদিকে আমাদের ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের অত্যাচার খুবই বেড়ে গিয়েছিল। তাই আমি খুলনায় চলে গিয়েছিলাম আমার বড় ভাই ও মামাতো বোনের কাছে। উল্লেখ্য, প্রয়াত প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা মফিজউদ্দিন আহমেদ তখন পিরোজপুরে কর্মরত ছিলেন। পাক আর্মিরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হুমায়ূন আহমেদের বড় বোন শেফুর সঙ্গে আমার মামা প্রখ্যাত ছাত্রনেতা আলী হায়দার খানের বিয়ে হয়। তিন মেয়ে তাদের। আলী হায়দার খান ১৯৬২ সালের দিকে অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। আলী হায়দার খানের সহযোগিতায় আমার মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর ট্রেনিংয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অন্যথায় পশ্চিম বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে পচে মরতে হতো।

খুলনা থেকে ফিরে এলাম আবার গ্রামের বাড়িতে। আমাদের ও পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুবকদের ধরে ধরে অনেকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকার বানিয়েছিল।

এরপর আমি বুদ্ধি করে আবার খুলনা যাওয়ার নাম করে গ্রামের বাড়ি ছাড়লাম। এটি ছিল জুন মাস। বৃষ্টি ও গরম উপেক্ষা করে বড় লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের বনগাঁয় পৌঁছালাম। আমরা যে বন্ধুরা একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তাদের মধ্যে অনেকেই বর্ডার ক্রস করার সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে তাদের সবাইকে আর একসঙ্গে পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

কয়েক দিনের অবিরাম পথচলায় আমি খুবই ক্লান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। গায়ে জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম হাসনাবাদ টাকী নামে এক হাসপাতালে। তিন দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর হাসনাবাদের একটি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ভর্তি হলাম। খুবই আনন্দিত হলাম আমার স্কুলবন্ধু লোকমানকে দেখে। লোকমান আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের ছেলে। সে আমার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিহারের চাকুলিয়ার উচ্চতর ট্রেনিং নিই। সেখান থেকে পশ্চিম বাংলায় ফেরত এসে সুন্দরবনে মেজর জিয়াউদ্দিনের কমান্ডে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে ছিল সে। এখনো সে আমার একজন অকৃত্রিম বন্ধু, আমার ভাইয়ের মতো।

আমরা হাসনাবাদ ক্যাম্পের অবস্থা দেখে একদম ঘাবড়ে গিয়েছিলাম! এক হযবরল অবস্থা! খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। দেশে দুর্ভিক্ষ হলে যে ধরনের অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েও মানুষকে বাঁচার চেষ্টা করতে হয়, আমাদের অবস্থাও ছিল অনেকটা সেই রকম। দু-তিন সপ্তাহ হয়ে গেল, কোনো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হচ্ছিল না আমাদের। তবে সকালবেলা কিছুটা শারীরিক কসরত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মানে কিছুটা ব্যায়াম জাতীয় ব্যাপার ঘটত। আর মাঝে মাঝে কোনো কোনো এলাকার এমএনএ ও এমপিরা তাদের নিজের এলাকার লোকদের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠাতেন। আমাদের পিরোজপুরের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপি ছিলেন যথাক্রমে এনায়েত হোসেন খান ও ডা. আব্দুল হাই। তাদের কোনো খোঁজখবর আমরা কখনো পাইনি।

তা ছাড়া ভাসানী ন্যাপ ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের বড় কোনো নেতারও খোঁজ মেলেনি। স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার জন্য কলকাতায় মওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান করে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা ছিলেন সৈয়দ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, মো. কামরুজ্জামান, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ। কিন্তু চেয়ারম্যান মওলানা ভাসানীকে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল।
আমি ও আমার এক বন্ধু সুকান্ত হালদার ক্যাম্প থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় আমাদের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। অনেক দিন পরে তাদের উষ্ণ আতিথেয়তায় আপ্লুত হয়েছিলাম। তাদের অনেকেই ছিলেন ষাটের দশকে আমাদের পিরোজপুর থেকে আগত ইমিগ্র্যান্ট। তারা দেশে থাকতে আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। এর মধ্যে দুদিন গিয়েছিলাম ৪ নং থিয়েটার রোডে, যা ছিল প্রবাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে দেখলাম তৎকালীন অনেক মন্ত্রী-এমপিকে। কথা হয় ফণীভূষণ মজুমদার ও অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সঙ্গে। কথায় কথায় তাদের জিজ্ঞেস করলাম মওলানা ভাসানী সম্বন্ধে। তারা বললেন, তিনি ভালো আছেন। কিন্তু তার নিরাপত্তার জন্য তিনি কোথায় আছেন, তা জানানো যাবে না। তা ছাড়া আমার মনে হলো, তারা আমার এই প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হয়েছেন।

থিয়েটার রোডে আরো দেখা হয়েছিল এম আর আখতার মুকুল, আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায়, কামাল লোহানী, রথীন্দ্রনাথ রায়, সংগীতশিল্পী আব্দুল জব্বারসহ অনেকের সঙ্গে।

কলকাতা থেকে আবার ফিরে এলাম হাসনাবাদ ক্যাম্পে। সেই আবার আগের মতো অবস্থা। ডিপ্রেশনের মতো অবস্থা। এর মধ্যে একদিন আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন আমার মামা আলী হায়দার খান, যার কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি। তার সঙ্গে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড নলিনী দাস। হায়দার মামা আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন। আমি কথায় কথায় আমাদের ক্যাম্পের অসুবিধাসমূহ তাকে বললাম এবং অনুরোধ করলাম আমাদের উচ্চতর ট্রেনিংয়ে পাঠানোর জন্য।
তিনি আমাকে বললেন, তুই একটা লিস্ট কর। আমি তার কথামতো একটা লিস্ট বানিয়ে তার হাতে দিলাম। ঠিক দুদিন পরে তিনি আবার এসে বললেন, তোরা সবাই রেডি থাকিস, কাল সন্ধ্যায় তোদেরকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য বিহারের ঢাকুলিয়ার পাঠানো হবে। যথারীতি পরের দিন সন্ধ্যায় মামা ও কমরেড নলিনী দাস এসে আমাদেরকে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। এর সঙ্গে আরো অনেক ঘটনা আছে। লেখাটা বেশি বড় করতে চাই না।

বিহারের ঢাকুলিয়ায় বেশ উন্নত ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়েছিল। বড় বড় তাঁবুতে দু-তিনজন করে মুক্তিযোদ্ধাকে রাখা হয়েছিল। উন্নত মানের খাবার ছিল, তাতে পুরোপুরি মিলিটারি কায়দায় ট্রেনিং দেওয়া হতো। এসব কাজ আমার জন্য কিছু কষ্টকর ছিল, কারণ স্টেনগান খোলা এবং জোড়া লাগানোর সময় প্রায়ই আমার হাত কেটে যেত। ৩০৩ রাইফেল চালাতে গিয়ে বুকে বেশ জোরে ধাক্কা লাগত। এলএমজি বা লাইট মেশিনগান চালানো বেশ সহজ ছিল। ব্রাশফায়ার করতে বেশ মজা লাগত। এসএলআর ছিল একধরনের অটোমেটিক রাইফেল-সিঙ্গল ফায়ার ও ব্রাশফায়ার দুটিই করা যেত। মাইন কীভাবে ব্লাস্ট করতে হয়, তাও শিখিয়েছিল। তিন ধরনের মাইন ছিল : ১. অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন; ২. অ্যান্টি পারসোনান মাইন ও ৩. অ্যান্টি পারসোনাল NMMIL। এ ছাড়া শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার বিভিন্ন পদ্ধতি। এরপর এল ট্রেনিং শেষে বিদায়ের পালা। আমাদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী অনেক ক্যাম্প থেকে সাত থেকে আটশ মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং শেষ হয়েছিল। তাদের সবার সামনে লে. জেনারেল সুরজিৎ সিং বক্তব্য দেন। তার সঙ্গে ছিলেন দুজন মেজর জেনারেল, তিনজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কর্নেলসহ অন্যান্য পদের অফিসাররা।

বিহারের ট্রেনিং শেষে আমরা পশ্চিম বাংলার এক ক্যাম্পে ফিরে এলাম। সেখানে কয়েক দিন ছিলাম। একদিন জেনারেল ওসমানী এলেন। এলেন বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, তার ছেলে শেখ হেলালকে নিয়ে। শেখ হেলালের বয়স তখন ১০-১২ বছর। তা ছাড়া এসেছিলেন চার খলিফার ছাত্রনেতারা এবং নন-খলিফা নেতারাও এসেছিলেন। একেকজনকে দেখলে মনে হতো প্রিন্স বা ক্রাউন প্রিন্সের মতো। তাদের একজন তো বাংলাদেশে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আবার বিয়ে করেছিলেন। একমাত্র শাজাহান সিরাজকে মনে হতো বেশ বিষণ্ন ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার মতো।

ক্যাম্পে ৮-১০ দিন থাকার পর আমরা নৌকাযোগে সুন্দরবনে মেজর জিয়াউদ্দিনের কাছে রিপোর্ট করলাম। তিনি ছিলেন ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এমএ জলিল।
বিহারের ট্রেনিং শেষে আমাদের সবাইকে একটি হলুদ রঙের ছোট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশে এসে
জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষরকৃত সার্টিফিকেট পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমি আরেকটি সার্টিফিকেট পাই তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের কাছ থেকে। তারপর চলে আসি বিদেশে। সর্বমোট ৪৩ বছর বিদেশে। যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬ বছর। অতি সম্প্রতি অর্থাৎ কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি স্থায়ী সার্টিফিকেট পেয়েছি। বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ২০ হাজার টাকা ও বছরে তিনটি বোনাস দিচ্ছে।

তবে দুঃখের বিষয় হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেক শিশু মুক্তিযোদ্ধাও ঢুকে পড়েছে! একাত্তর সালের শিশুরা এখন বেশ বড় হয়েছেন। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে তারা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে ত্বরান্বিত করতে পারবেন। হয়তো তারাই পারবেন গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে।

খোদার কসম, যারা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভাতা নিচ্ছেন, তারা তাদের টাকাটা হালাল করবেন দেশের জন্য। নইলে একে তো আপনারা বিবেকের দংশনে জর্জরিত হবেন এবং আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন হারাম খাওয়ার জন্য।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা; নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সাউথ এশিয়া ওয়াচের মহাসচিব; এশিয়ান-আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটির কো-চেয়ারম্যান এবং ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য (ডিএনসি)।