একাত্তরের বীরাঙ্গনা মায়ের তথ্য জানতে কানাডা থেকেই মিশনারিজ অব চ্যারিটিজকে চিঠি লিখেছিলেন শামা জমিলা মলি হার্ট। কিš‘ কোনো খোঁজ মেলেনি। তার মায়ের কোনো তথ্যই রাখা হয়নি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত নৃশংস অত্যাচারের প্রতীক হয়ে আছে যুদ্ধশিশু, যাদের অনেকে বিদেশে বিভিন্ন পরিবারের সদস্য হয়ে নতুন জীবন গড়ে তুলেছেন। ১৯৭২ সালে কানাডায় যে কয়েকজন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম শামা জমিলা মলি হার্ট। তাকে দত্তক নিয়েছিলেন মন্ট্রিয়ল শহরের জোয়েল ও ট্রুডি হার্ট। এই দম্পতি শামাকে নিজেদের একজন সন্তান হিসেবে মানুষ করে তোলেন। আজ শামা হার্ট নিজেই একজন মা এবং স্কুল শিক্ষিকা। তিনি তার কন্যা সাভানা বোনেলকে নিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশে এসেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনকার চেয়ে অনেক ভিন্ন। সে সময়ের গণমাধ্যমেও এই যুদ্ধশিশুদের ‘শত্রুসন্তান’, ‘জারজ সন্তান’, ‘অপ্রত্যাশিত সন্তান’Ñ এ ধরনের নামে অভিহিত করা হতো। পরি¯ি’তির কারণে অনেক মা তার যুদ্ধশিশুদের পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। সামাজিক কারণে তাদের নাম, ঠিকানাও রাখা হয়নি। এখনো বিষয়টি নিয়ে অনেক স্পর্শকাতরতা আছে। তাই গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে যুদ্ধশিশু শামা হার্টের সঙ্গে আলাপচারিতা অনুষ্ঠানে আয়োজক বারবার মনে করিয়ে দেন, তিনি আহত বা অপমানিত বোধ করেন এমন কোনো প্রশ্ন যাতে তাকে না করা হয়।
শামা হার্ট জানান, তাকে দত্তক নেওয়া কানাডীয় মা ও বাবা বড় করে তুলেছেন পরম মমতায়। তারা তাকে সব সময় সহায়তা করেছেন। জন্মভূমি বাংলাদেশে আসার স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ততটা জানেন না। ধীরে ধীরে জানতে পারছেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন জানতে চান, শামা হার্ট মায়ের খোঁজ করেছিলেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘মাকে সম্মান জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি মিশনারিজ অব চ্যারিটির কাছে চিঠি লিখেছিলাম। আমার মাকে সুরক্ষার জন্যই এ বিষয়ে কোনো তথ্য রাখা হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার মা বীর। মাকে নিয়ে আমি গর্বিত।’
কানাডাপ্রবাসী যুদ্ধশিশু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা চৌধুরী বলেন, শামা হার্টের জন্ম ঢাকার ২৬ ইসলামপুর রোডের মিশনারিজ অব চ্যারিটির শিশু সদনে। শামা হার্ট কানাডা থেকে লাগেজভর্তি উপহার নিয়ে এসেছেন শিশু সদনের অনাথ শিশুদের জন্য। আর তার সেভেন গ্রেড পড়ুয়া মেয়েও সঙ্গে অর্থ উপহার এনেছেন। শামা হার্টকে দত্তক হিসেবে গ্রহণকারী কানাডীয় মাও উপহার পাঠিয়েছেন শিশু সদনের এখনকার বাসিন্দাদের জন্য। শামা হার্ট আজ তার জন্ম¯’ান সেই শিশু সদনে যাবেন মেয়ে সাভানা বোনেলকে নিয়ে।
মোস্তফা চৌধুরী জানান, বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করেন বলেই শামা হার্ট বাংলাদেশে এসেছেন। কানাডীয় নাগরিকত্বের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্বও নিতে চান।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালিয়েছে। ৪৭ বছর পরও আজ এমন ঘটনা ঘটছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে।
একাত্তরে শহীদ আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী অনুষ্ঠানে উপ¯ি’ত তরুণ প্রজন্মের নারী প্রতিনিধিদের বলেন, এখন যদি মুক্তিযুদ্ধ হতো বা তাদের জন্ম যদি ষাটের দশকে হতো, তাহলে হয়তো তাদের কেউ না কেউ শামার মা হতেন।
পশ্চিমা দেশগুলো এখনও গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়নি। তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করা, একাত্তরের নৃশংসতা চালানো ও তাদের দোসরদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা।
অনুষ্ঠানে একাত্তরের যুদ্ধবন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস বীরাঙ্গনাদের রক্ষায় মাদার তেরেসার ভূমিকার কথা স্মরণ করেন।