জামালউদ্দিন বারী
আমাদের সমাজে, রাজনীতিতে-অর্থনীতিতে ও রাষ্ট্রে এক প্রলম্বিত অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা ভর করেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সে অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা জনগণের মধ্যে এক ধরনের সংক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। দেশের সচেতন, কর্মক্ষম মানুষের অর্ধেকই হচ্ছে তরুন প্রজন্ম, যাদের বয়স প্রায় তিরিশ বছরের নিচে। কোটি মানুষ যারা স্কুল-কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে গেছে, দারিদ্র্য অথবা পারিবারিক কারণে শিক্ষার নানা স্তরে ঝরে পড়ার পর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান বা আত্মকর্ম সংস্থানে যুক্ত হয়েছে। অথবা বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে চাকরি ও আত্মকর্ম সংস্থানের জন্য লড়াই করে করে ক্রমে হতাশ ও সংক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে এই হতাশ ও সংক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদেরকেই লাইমলাইটে দেখা গেল। দেশে কোটি কোটি মেধাবী তরুণ যখন বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে ঘুরছে, তাদের অনেকেই পারিবারিক চাহিদা পূরণের জন্য দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে, তখন মাত্রাহীন, অনৈতিক কোটা ব্যবস্থার কারণে সরকারি চাকুরীতে তাদের প্রবেশের পথ সংকুচিত করে রাখার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। সাধারণ ছাত্রছাত্রী অধিকার সংরক্ষণের ব্যানারে পরিচালিত সাম্প্রতিক আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলপ্রয়োগ এবং সরকারের দায়িত্বশীল মহলের নানা ধরনের উসকানি সত্ত্বেও কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলন ছিল যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ। সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের স্বার্থসংশ্লষ্টি এমন একটি অরাজনৈতিক ও স্পর্শকাতর ইস্যুতে সব ধরনের রাজনৈতিক ভেদাভেদ ও মতপার্থক্য ভুলে ক্যাম্পাস ছেড়ে এক কাতারে রাজপথে নেমে আসার এই বাস্তবতা থেকে দেশের সরকার ও সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের জন্য অনেক কিছুই শিক্ষণীয় রয়েছে। নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশাকে ক্ষমতার লাঠি-বন্দুক দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাদের সাধারণ স্বার্থের প্রশ্নে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনীয় সময়ে তারা নিজেদের সংগঠিত করে সব প্রতিবন্ধকতাকে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ভাসিয়ে দিতে সক্ষম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগামী দিনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার মূল পাদপীঠ হিসেবে স্বীকৃত হলেও গত তিন দশক ধরে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি সামরিক স্বৈরাচারী শাসনামলেও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডাকসু, চাকসু, রাকুসু’সহ ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এসব নির্বাচন এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর পারস্পরিক সহাবস্থান এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চায় কখনো কখনো সংঘাত-সহিংসতা ও সীমালঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও তার পেছনেও বড় রাজনৈতিক দলের প্রভাব কাজ করত। ছাত্র রাজনীতিকে শুধু শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্বার্থে এবং বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে শিক্ষাঙ্গন কখনো এমন সহিংস হয়ে ওঠার কোনো কারণ ছিল না। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে এ দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গৌরবজনক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাঙ্গন কখনো এখনকার মতো ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি বা চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি। বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনগুলোকে হীন দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যথার্থরূপে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সুযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার সূতিকাগারে পরিণত হতে পারত। স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ী হওয়ার পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা, গবেষণা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ ও পরিবেশ ধরে রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
গত বছরের প্রথম দিকে প্রকাশিত এক জরিপ রিপোর্টে দেখা গেছে, দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে অনীহা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। তারা রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ বা বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাদের এই রাজনীতি বিমুখতার পেছনে কাজ করছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয় এবং সহিংস রূপ। যেনতের প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকার পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা কখনো কখনো আইন ও মানবাধিকারকে চরমভাবে লঙ্ঘিত করেছে। বিশেষত শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি অশুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গে একটি বগে প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দিতে যাওয়া জাসদের নেতাকর্মীদের উপর পুলিশ গুলি চালালে প্রায় ৫০ জন নেতাকর্মী নিহত হয়। এটা তারা কল্পনাও করেনি তারা ভেবেছিল, পুলিশ তাদের বাধা দেবে, লাঠিপেটা করবে। কিন্তু পুলিশের গুলিতে একসঙ্গে এতসংখ্যক নেতাকর্মীর মৃত্যুতে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহা দেখা দেয়। পচাত্তুরের ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-, একাশি সালের ৩০ মে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের গুলিতে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যু, গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমাতে বারবার পুলিশি নির্মমতার উদাহরণ এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা, দ্বিচারিতা, দুর্বৃত্তপনা, লুণ্ঠন-সন্ত্রাসের ধারাবাহিক উদাহরণ শিক্ষিত নতুন প্রজন্মকে ক্রমে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও অনীহ করে তুলেছে। সারা বিশ্বেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবক্ষয় বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি বিমুখতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষিত নতুন প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ায় দেশের অভীজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কিছুটা বিচলিত বোধ করলেও রাজনীতিকে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা ও ভাবাবেগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে তারা তেমন কোনো রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে না। আমাদের দশম জাতীয় সংসদ যতই বিতর্কিত হোক না কেন, এই সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬ সালে জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের ১৩৪তম কাউন্সিল অধিবেশনে বক্তব্য দিতে গিয়ে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিশ্বের তরুণ সমাজকে রাজনীতি ও সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহী সচেতন করে গড়ে তুলতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। রাজনীতিতে তরুণদের অনাগ্রহ এবং অনুপস্থিতি এমনকি ভোটাধিকার প্রয়োগে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেন তিনি। এটি বৈশ্বিক প্রবণতা হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে শিরীন শারমিন চৌধুরী যেমন সিপিএর চেয়ারপারসন, তার আগে তিনি বাংলাদেশের পর্লামেন্টের স্পিকার। তিনি এমন একটি পার্লামেন্টের স্পিকার, যে সংসদের বেশির ভাগ আসনের সদস্যরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন এবং সে নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল শতকরা ২০ ভাগেরও কম। তিনি ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের কাউন্সিল অধিবেশনের বক্তৃতায় যুবসমাজকে রাজনীতি ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলার আহ্বান জানালেও ও নিজ দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের চরম অবক্ষয় এবং অগণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো জোরালো বক্তব্য বা ভূমিকা নিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। আমাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক স্পিকার বাস্তবতায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর মতো সুশিক্ষিত ও সজ্জনব্যক্তিত্বের উপস্থিতি কিছুটা আশাব্যঞ্জক। তবে দেশে এবং বিদেশে তার বক্তব্য ও এবং ভমিকায় যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তাতেই বুঝা যায়, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে কথা বলা খোদ সংসদের স্পিকারের পক্ষেও হয়তো সম্ভব নয়।
রাজনীতিতে চলমান অবক্ষয়, হিংস্রতা-নিষ্ঠুরতা, লুণ্ঠন ও লুম্পেন প্রবণতা দূর করতে না পারলে আমাদের শাসকশ্রেণির জন্য সর্বগ্রাসী এক বিপদ অত্যাসন্য। চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা গত চার দশক ধরে রাজনীতিতে সৎ, সুশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান ও সম্ভাবনাময় তরুণদের অনাগ্রহ ও অনুপস্থিতির ফলস্বরূপ আমাদের রাজনৈতিতে নীতিহীনতা, মুনাফাবাজি, সন্ত্রাস-দুর্বৃত্তায়ন বিস্তার লাভ করেছে। খুব কম হলেও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো কিছু সুশিক্ষিত, প্রজ্ঞাবান ও দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষ আছেন। তারা দেশের গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব ও উদ্যোগ নিলে দেশের নতুন প্রজন্মের অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব এ ধরনের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। কোটাব্যবস্থার মতো রাজনীতিতেও দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্রের ব্যবস্থা রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরে শেকড় গেড়েছে। গণতন্ত্রের খোলসের ভেতর অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচার ও বেপরোয়া লুটেরাশ্রেণির উত্থান দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্ভাবনার অনেকটাই নস্যাৎ করে দিয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে গণতান্তিক রাজনীতির পথ প্রশ্বস্ত না হলে, নির্বাচন ব্যবস্থায় সব রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ এবং সহাবস্থান নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। গত দশকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সম্ভাবনার জানান দিয়েছিল এবং বিদেশি বিনিয়োগের যেসব প্রস্তাব ও সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে বাংলাদেশে আরো কয়েক হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও অন্তত ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হত। চীন-জাপানসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলো শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিল। মাইক্রোসফট কোম্পানির কর্ণধার বিল গেটস বাংলাদেশ সফর করে এখানকার হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসহ কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছিল। সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যথাযথ উদ্যোগ নিলে এত দিনে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত গার্মেন্ট সেক্টরের চেয়েও বড় রেমিট্যান্সে আয়ের খাতে পরিনত হতে পারত। দু’ বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফর করে কয়েক হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণচুক্তি করে গেছেন। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে সেসব বিনিয়োগ ও ঋণচুক্তি বাস্তবায়নে চীনের গড়িমসি ও সময়ক্ষেপণ দেখা যাচ্ছে। এমনকি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগাপ্রকল্পগুলোতেও প্রতিশ্রত ঋণচুক্তির টাকা ছাড় স্থগিত বা মন্থর করছে চীন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে চীনের নীতি ভারতের চেয়ে ভিন্ন। তারা সাধারণত প্রকাশ্য মন্তব্য করতে চায় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি এবং আগামী নির্বাচন সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে চীন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি গুয়ংজুন সম্প্রতি ঢাকার চীনা দূতাবাসে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, চীন বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর চায়। তিনি আরো বলেছেন বাংলাদেশে বিপুল চীনা বিনিয়োগের স্বার্থে চীন আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরগতিতে হলেও বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই চীনা বিনিয়োগ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে এবং বিনিয়োগ প্রস্তাবের কাক্সিক্ষত মাত্রা এবং গতি নিশ্চিত করছে আগামী নির্বাচনের ওপর। একই সুর পাওয়া যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ, নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও সুশাসনের মতো বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না।
বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার পক্ষে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি নানা পক্ষের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ভারতের একপক্ষীয় সমর্থনে বাংলাদেশে একটি বিতর্কিত ও ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমারা আবারো রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে সংসদ বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অনড় অবস্থান দেখা যাচ্ছে। বিগত নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতীয় ভটনীতিকদের নগ্ন হস্তক্ষেপ দেশের সাধারণ মানুষ সহজভাবে মেনে নেয়নি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের কারণেই ভারতীয়রা আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের প্রত্যাশা ও পালস না বুঝে শুধু নিজেদের স্বার্থে আধিপত্যবাদি নীতি গ্রহণের কারণে কোনো প্রতিবেশী দেশের প্রতিই আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলতে পারছে না ভারত। চীন, পাকিস্তানের কথা বাদ দিলেও নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ বা ভুটানের মতো দেশেও জনগণের ভারতবিরোধী অবস্থান এখন অনেকটাই পরিষ্কার। দেশের জনগণের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল ভারতের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়, সাম্প্রতিক সময়ে নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপের রাজনৈতিক ঘটনাবলি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা যেন এখনো জনগণের ইচ্ছা বা মতের চাইতে ভারতীয়দের সমর্থনকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ভারত যে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে এটা সবারই জানা। দশম জাতীয় সংসদ ও বর্তমান সরকারের উপর ভারতীয় হস্তক্ষেপের ভূমিকা কতটা গভীর তা নিয়েও ময়দানে অনেক গুঞ্জন রয়েছে। ভারতীয় হস্তক্ষেপের প্রশ্নে জনগণের সমর্থন না থাকায় এ বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিতে না পারলে ক্ষমতাসীনদের নিরবতাই হয়তো শ্রেয়। গত ২২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আমন্ত্রণে ভারত সফরে যাওয়ার এক দিন আগে গত ২১ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না। এ ধরনের মন্তব্য শুধু ভারতীয় কূটনীতিকদের কণ্ঠেই হয়তো মানায়। বিগত নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের ভমিকা এবং একতরফা নির্বাচনের পক্ষাবলম্বনে ভারতের ভূমিকা কোনো গোপন বিষয় ছিল না। ভারতের পত্র-পত্রিকাগুলোতেও ভারত সরকারের এমন ভূমিকার সমালোচনা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সফর বিনিময় একটি সাধারণ ঘটনা। আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল গত বছর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গত বছর চীন সফর করেছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে যখন একটি ঝড়ের পূর্বাভাস ঘনীভূত হতে চলেছে, সংশ্লিষ্ট সবার তীক্ষè নজর তখন ভারতের ভূমিকার ওপর। তবে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিলে ভারত বা অন্য কোনো দেশের যেকোনো প্রভাব এখানে ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ভারত তোষণ করে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে তাতে এ দেশের সাধারণ মানুষ লজ্জিত বোধ করে এবং এসব রাজনৈতিক নেতার ওপর বিরক্ত হয়। ক্ষমতার জোরে দেশের নির্বাচনীব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে হয়তো কিছুদিনের জন্য অকার্যকর করে রাখা সম্ভব। জনসমর্থনপুষ্ট প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, জেলে ভরে এবং দল ভেঙে দিয়ে নিবন্ধন বাতিল করে দুর্বল ও অকার্যকর করে রাখা অসম্ভব নয়। তবে যে দেশের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে বন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে, এবং আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা দেশত্যাগ করে ভারতে আত্মগোপনের পরও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করতে পারে। সে দেশের মানুষ জাতীয় প্রয়োজনে বারবার জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে। বিশেষ সময়ে জনগনই রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিবর্তন নিশ্চিত করেছে। শুধু ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের প্রশ্ন নয়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক পরিবেশ, গুম-খুন, নিরাপত্তাহীনতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। দেশের নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণরা সম্মানজনক কাজ চায়, মেধার মূল্যায়ন চায়। তারা যেমন পুরনো বিতর্ক ও ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলতে একাত্তুরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে সমর্থন করে, একইভাবে জাতিকে বিভক্ত করে, মেধাবীদের বঞ্চিত করে পিছিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রও তারা রুখে দিতে চায়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মের এই মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হলে এর খেসারত তাদেরকেই দিতে হবে।