একুশ দিয়েছে ভাষার অধিকার একুশ দিয়েছে ঠিকানা

মুহম্মদ ফজলুর রহমান


একুশে ফেব্রুয়ারিকে আমরা বলি মহান শহীদ দিবস, ভাষা দিবস। বাঙালিদের প্রথম আত্মশক্তির জাগরণের দিন। এমন একটি দিন, যে দিনটির সূত্রপাত হয়েছিল ছাত্রদের হাতে। সমাপ্তি ঘটে সমগ্র বাঙালি জাতির স্বতঃপ্রণোদিত অংশগ্রহণ এবং রক্তদানের মধ্য দিয়ে। আবার ১৯৫২ থেকে ১৯৯০-৩৮ বছর পর একই রক্তধারায়, একই চেতনা ও বোধকে ধারণ করে প্রায় ১৪ হাজার মাইল দূরে আত্মপ্রকাশ করে ‘ঠিকানা’ নামের একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। ইংরেজি ভাষার আধিপত্য বিস্তারিত, ইংরেজি কোলাহলমুখর পরিবেশে সদ্য অঙ্কুরিত একটি কমিউনিটি, যাদের বাংলাদেশের বাঙালি পরিচয় তখনো গড়ে ওঠেনি, সদ্য প্রস্ফুটময় সেই কমিউনিটিকে তার নিজ পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাতে এবং নিজ পরিচয়ে সগর্বে বিজয়ের পতাকা ওড়ানোর স্পর্ধা দেখাতে কয়েকজন যুবকের দুঃসাহসকে ভর করে জন্ম নেয় ‘ঠিকানা’। যার বয়স এখন ৩৪ বছর।
একুশের শিক্ষা অন্যায়, অপশক্তির কাছে মাথা না নোয়ানো। কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় না পাওয়া। মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা ও অহংকার রক্ষায় কোনো দানব, দখলদার বা ঔপনিবেশিক শক্তিকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের জাতিগত বোধ, বুদ্ধি, চিন্তা ও চেতনাকে শাণিত করে তুলে সব পরিবেশে বিজয়ীর মতো বুক চিতিয়ে চলার শিক্ষা বাঙালিরা প্রথম অর্জন করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির কাছ থেকেই। সেই একুশ আমাদের শিক্ষা দেয়- কীভাবে নিজের মায়ের মুখের ভাষা রক্ষা করতে হয়। কীভাবে মায়ের মান বাঁচাতে হয়। একুশ শিক্ষা দেয়- শত্রু যত দানবীয় শক্তির অধিকারী হোক, যত বিধ্বংস শক্তিধর হোক, একটি জাতি যদি নিজেদের ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর হয়ে একটি একক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তবে বিশ্বের কোনো শক্তিরই ক্ষমতা হবে না সেই জাতিকে পরাজিত করা। পাকিস্তানি দখলদার পরদেশলোভী সেই শক্তিও পারেনি মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষায় একক শক্তিতে পরিণত হওয়া বাঙালি জাতিকে পরাজিত করতে। সেদিন দখলদার শক্তি রক্ত ঝরিয়েছে রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ শত শত নাম না-জানা বাঙালির বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে। রাজধানী ঢাকার পিচঢালা কালো রাজপথ সেদিন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ছাত্র-জনতার রক্তে। তবে বিজয়ী হয়েছে জাগ্রত ছাত্র-জনতার সম্মিলিত শক্তি।
বাঙালির গৌরবের এ ইতিহাস জানতে হলে যেমন ফিরে যেতে হবে ১৯৪৮ সালের ইতিহাসে, ঠিকানার সাফল্যের পেছনে প্রবাসের বাঙালি কমিউনিটির ভালোবাসা জয়ের গল্প জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯০-এ। যখন আমেরিকার প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির কেবল সূর্যোদয় হচ্ছে, সেই শুভ মুহূর্তে প্রবাস কমিউনিটির পাশে দাঁড়াতে ঠিকানা প্রবল দুঃসাহসে আত্মপ্রকাশ করে। এবং সেই ইতিহাসের মতো ‘এলাম, দেখলাম এবং জয় করে নিলাম’(ভিনি, ভিডি, ভিসি)।
একুশের কথা বলতে গেলে পাকিস্তান জন্ম এবং পাকিস্তান জন্মে বাঙালির অবদান ও ত্যাগের কথা তুলে আনতে হয়। সে লম্বা ইতিহাস, যা সম্পাদকীয়র নির্ধারিত কলেবরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষ ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ফিরে গেল স্বদেশে। যে ব্রিটিশ রাজার আদেশে ভারতবর্ষে এসেছিল, সেই ব্রিটিশ রাজ্যেই। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেয়েই দুই পথে যাওয়া শুরু করল। ভারত গণতন্ত্রের পথে আর পাকিস্তান ধরল স্বৈরতন্ত্রের পথ। পাকিস্তান দুই পাখা-পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে স্বাধীন হলো। তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিও হলো দ্বৈত নীতি। পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জন করলেও জন্ম নিতে না নিতেইং ধর্মের অনুশাসন ও নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার নীতি গ্রহণ করে এবং সব রকম অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বাঙালিদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে থাকে।
পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় বাঙালির ভাষা। ভাষা কেড়ে নিতে পারলে বাঙালিদের চিরকাল তাদের পরাধীন করে রাখা যাবে-এই ভাবনায় সাহেবি কালচার এবং মুসলমানি পোশাকধারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ঢাকায় দম্ভভরে ঘোষণা করেছিলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ কিন্তু সচেতন বাঙালি ছাত্রসমাজ জিন্নাহর কুমতলব অনুধাবন করতে মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে দাম্ভিক জিন্নাহর দম্ভ চূর্ণ করে দিয়ে ‘না, না’ বলে তার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে দিল। শুরু হয় বাঙালির ভাষা রক্ষার লড়াই।
এদিকে বাঙালিদের ধারাবাহিক আন্দোলন এবং পাকিস্তানি শাসকদের বর্বরতার মধ্য দিয়েই আসে ১৯৫২ সাল। আসে ফাগুনের সেই আগুনঝরা দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত সেই দিন। রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ শত শত নাম না-জানা বাঙালির রক্তে লেখা শহীদ দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনকারীরা পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। বিপরীতে হরতাল বানচাল করতে শাসককুল জারি করে ১৪৪ ধারা। ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল সফল করতে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ডাকা হয় সমাবেশ। সকাল থেকেই সমাবেশে ছাত্র-জনতা জমায়েত হতে শুরু করে সব নির্যাতন, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে। সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে ১০ জনের গ্রুপ করে করে রাস্তায় বের হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ছাত্রদের কয়েকটি গ্রুপ বের হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গেটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই পুলিশের গুলিবর্ষণ! শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ অনেকে। চলমান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অধিবেশন স্থগিত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অধিবেশন বর্জন করে ঢাকা মেডিক্যালে যান। বাকি ইতিহাস সবার জানা। কেননা প্রতিবছর এ নিয়ে কথা বলা হয়। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে শহীদ দিবস পালন করা হয়। উল্লেখ্য, সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে জেলের মধ্যে অনশনে ছিলেন।
পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দান করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশে বাংলা ভাষা আজও অবহেলিত। বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে বাংলা ভাষা স্বদেশে কোণঠাসা হয়ে আছে। এই অবস্থা থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করতে হবে। এ জন্য চাই বাংলাদেশের সর্বমহলে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধ।
২১ ফেব্রুয়ারি ইতিহাস ধারণ করেই শহীদ দিবসের ৩৮ বছর পর নিউইয়র্কে আত্মপ্রকাশ করে ‘ঠিকানা’। এ জন্য কারো আত্মদান, রক্তদান কিছু করতে হয়নি। তবে শ্রম ও মেধা ব্যয় করতে হয়েছে। নিতে হয়েছে চরম ঝুঁকি। সদ্য উঁকি মারা কমিউনিটির পাশে সাহসের বাতি হয়ে অচেনা-অদেখা পথকে জয় করে নিজেদের স্বপ্ন ধরতে, সাফল্য এনে দিতে পাশে দাঁড়ান এক সাহসী যুবক- এম এম শাহীন। তাঁর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে, সব নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলেন ঠিকানা। সেই সংগ্রামকালে পরম ভরসা হয়ে পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর সহোদর সাঈদ-উর-রব। পাশে পান কিছু বিশ্বস্ত শুভাকাক্সক্ষীও।
পত্রিকার নীতি এবং আদর্শ হিসেবে সাথি করে নেওয়া হয় একুশের শিক্ষা- কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় না পাওয়া এবং কোনো অপশক্তি ও পেশিশক্তির কাছে নতজানু না হওয়া। সত্যকে সত্য বলতে, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে দ্বিধাহীনতায় না ভোগা। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার দুঃসাহস দেখিয়ে পথ চলা। একুশের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে পথচলার সাহস ও সততা দেখে সদ্য গড়ে ওঠা প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটিও পরম ভালোবাসায় নিজেদের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঠিকানাকে ভরসাযোগ্য পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
এমন এক সময় এম এম শাহীন ঠিকানা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন, যখন নিউইয়র্কে পত্রিকা প্রকাশনা কেবল নয়, যেকোনো ক্ষেত্রে বিনিয়োগই তখন বাঙালিদের জন্য চরম অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। সেই চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা নিয়েই কেবল নবীন কমিউনিটির পাশে দাঁড়ানো ও প্রবাস-স্বদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সেতুবন্ধ রচনার বাসনা যার মধ্যে তীব্র, তিনি কি তোয়াক্কা করেন কোনো রকম ঝুঁকির? তিনি সব রকম ঝুঁকি নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েন পরার্থে। এম এম শাহীনও ঠিক তেমনি করেই লাভজনক বিনিয়োগ থেকে অর্থ তুলে নিয়ে পত্রিকা প্রকাশনার মতো ঝুঁকির খাতে পুঁজি বিনিয়োগে একটুও দ্বিধা করেন না।
যে কেউ মানুষের কল্যাণে নিখাদ ভালোবাসা এবং মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো কিছু করার প্রয়াস নিলে তার সেই প্রয়াস সফল করে তুলতে সবাই এগিয়ে আসেন। ঠিকানাকেও ঠিক সেভাবেই সবাই ভালোবেসে গ্রহণ করেন, যা অদ্যাবধি অটুট রয়েছে। ঠিকানাও তার শিক্ষা ও অঙ্গীকার থেকে সরে আসেনি। সত্যকে সত্য, ন্যায্যকে ন্যায্য বলার শক্তি ও সাহস নিয়ে নির্ভীকভাবে ৩৩ বছর পথ চলে ৩৪ বছরে পদার্পণ করল। এর মধ্যে কাছের-দূরের, আপন-পর, পরশ্রীকাতর অনেকেই ঠিকানার সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। তবে অন্ধকারের অপশক্তির মতো, বায়ান্নতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মতো তারা সফল হয়নি। ঠিকানার বর্তমান কর্ণধার প্রাক্তন এমপি একজন প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী মানুষ। তিনি বাস্তবতার আলোকে তাঁর পরিকল্পনা সাজাবেন। একজন দক্ষ সেনাপতির মতো যুদ্ধজয়ের কৌশল ও পরিকল্পনা করবেন তিনিই। ঠিকানা একদিন সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করে শতবর্ষে পা রাখবে। ঠিকানা সেদিনও পথ হারাবে না। সেদিনও একুশের শিক্ষায় ঠিকানা আলোকিত ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত থাকবে।
শেষ কথা, আমাদের সবার ভালোবাসার ঠিকানা সবার সহযোগিতায় এগিয়ে যাক। ঠিকানার মধ্যে সবার স্বপ্ন বেঁচে থাক। কোনো দুর্যোগ, কোনো মহামারি, অন্ধকারের কোনো অপশক্তি যেন ঠিকানার এগিয়ে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। প্রবাস কমিউনিটি, স্বদেশবাসী সবার যেন ভালো থাকে। সভ্যতা যেন নিরাপদ থাকে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন থাকে দুধে-ভাতে। ঠিকানার সব সহকর্মী, পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ীকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উষ্ণ ও অতল শুভেচ্ছা।