নিজস্ব প্রতিনিধি : বৃদ্ধ বয়সেও এরশাদের খেলার শেষ নেই। ছলচাতুরী, রাজনীতির কূটচালের হীনতায় পারঙ্গম সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ শেষ বয়সেও কথায় এবং কাজেও পুরোনো ধারাই ধরে রেখেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, দেশের মানুষ প্রথম তাকে বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়েছে। এখন আর কোনো কথায়ই মানুষ কান পাতে না, নিতান্ত হাস্যরস করে। তারপরও এরশাদ রাজনৈতিক ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছেন। বৃহত্তর রংপুর এবং অন্যান্য কয়েকটি এলাকায় অবস্থান ভালো থাকার সুবাদে আগামী দিনের রাজনীতিতেও এরশাদ তার একটা অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন। এমনকি তা সরকার গঠনে নিয়ামক হলেও বিস্ময়ের হবে না।
এরশাদ সর্বশেষ বলেছেন, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে তিনি আগামী নির্বাচনে ৭০টি আসন এবং সরকারে ১২টি মন্ত্রণালয় চান। সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি তার এ দাবি তোলেন এবং আগামী নির্বাচন দলীয়ভাবে করলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার ওপরই নির্ভর করবে এই সমঝোতার ধরন। বিএনপি বেগম খালেদা জিয়াবিহীন নির্বাচনে অংশ নিলেও ৩০ থেকে ৩৫টি আসনে এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ গোপন সমঝোতা করবে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এরশাদ বৃহত্তর রংপুরের ৩২টি আসনের সব কটিতেই ছাড় চেয়েছেন। এরশাদ নিজে গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে প্রার্থী হবেন। এই আসনে ছাড় দেওয়ার আগাম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বৃহত্তর রংপুর ও অন্যান্য নির্বাচনী এলাকা নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা ও সমঝোতা এখনো হয়নি।
এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগের বড় সমস্যা শীর্ষ থেকে কোনো পর্যায়েই আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে শতভাগ বিশ্বাস করেন না। তাদের ধারণা, এরশাদ জামায়াতকে নিয়ে গোপন নির্বাচনী সমঝোতা করবেন। তারা যৌথভাবে ৪০-৪২টি আসন পেয়ে যেতে পারে। ন্যূনতম ৩৫-৩৭টি আসন পেলেও সরকার গঠনে তারা নিয়ামক হয়ে উঠতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কঠিন দর-কষাকষিতে যাবেন। এমনকি সরকারপ্রধান হওয়ার, তা যদি না-ও হয় মন্ত্রিসভার এক-তৃতীয়াংশ সদস্য দাবি করবেন, যা উপেক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। বিএনপি নির্বাচনে যদি ১১০-১২০টি আসনও পায়, তাহলে এরশাদ তার ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে বিএনপির সঙ্গেও হাত মেলাতে পারেন। চরম অসহায় অবস্থায় থাকা বিএনপিও এরশাদের শর্তে তার সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই সরকারের। নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনে সূক্ষ্ম ইঞ্জিনিয়ারিং করা হলেও ফলাফল প্রত্যাশিত হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা-সংশয় সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও রয়েছে। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক ময়দানে গভীর আশাবাদ প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে তারা চিন্তিত। গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে যাবে সরকারের জনপ্রিয়তা। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা ভীতি রয়েছে বলেই এই নির্বাচনে তারা এরশাদের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় এসেছেন। গাজীপুরে এরশাদ দলীয় প্রার্থী দেননি। খুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। তারপরও এই দুই সিটি করপোরেশনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এবং বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত নয় সরকারি দল।
জামায়াতের সঙ্গে জাতীয় পার্টি একটি সমঝোতা গড়ে তুলেছে। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত এরশাদের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে এরশাদ বৃহত্তর রংপুরে জামায়াতকে অন্তত দুটি আসনে ছাড় দেবেন। অন্যান্য স্থানে ১২ থেকে ১৫টি আসনে এরশাদের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার ব্যাপারে কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা, আলাপ-আলোচনা দৃশ্যমান না হলেও এরশাদ ভিন্ন মাধ্যমে যোগসূত্র রক্ষা করছেন। জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার এবং সরাসরি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে যোগাযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনা জানিয়ে রাখতেই এই যোগসূত্র রক্ষা করা হচ্ছে।
এদিকে পূর্ণ আস্থা না থাকায় মঞ্জুর হত্যা মামলার রায় ঝুলিয়ে রাখার একমাত্র এবং প্রধান শর্ত এরশাদকে কাবু করে রেখেছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার সুযোগ তার এ পর্যায়ে নেই। ৭০টি আসন দাবি করলেও আওয়ামী লীগ তাকে ৪০টির বেশি আসনে ছাড় দেবে না। দর-কষাকষিতে তা বড়জোর আরো চার-পাঁচটি বাড়তে পারে। বৃহত্তর রংপুরেও সব কটি আসনে ছাড় দেওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব নয়। তার এখানে ২৪টির বেশি আসনে এরশাদকে ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে না বলেই জানা যায়। এ বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত করা হবে। এ নিয়ে বড় ধরনের ঝামেলায় জড়াবেন না এরশাদ। তার বিশ্বাস, বৃহত্তর রংপুর ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থান থেকে তারা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আসন পাবেন।
নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে এরশাদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করতে চান। নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে তা ঘোষণা করার কথাও বলবেন। এরশাদকে ভবিষ্যতে দায়বদ্ধ রাখতে আওয়ামী লীগও এর বিপক্ষে নয় বলেই জানা যায়। রাজনীতির যেমনি শেষ কথা নেই, এরশাদের কোন কথা সে লিখিত, অলিখিত যা-ই হোক, একদিন, এক ঘণ্টা পরও বিশ্বাস করা যায় না- এ ভাবনাও আওয়ামী লীগের নেতাদের তাড়িত করে।