ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান
এহসান শব্দের আভিধানিক অর্থ সুন্দর করা। নিজের ব্যক্তিগত কর্মকান্ড ও আচরণ এবং অন্যের সাথে ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে এহসান করা যায়। এহসান সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৯০: আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা [আল-আদল], সদাচরণ [আল-এহসান] এবং আত্মীয়-স্বজনকে [আল-কুরবা] দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা [আল-ফাহশা], অসঙ্গত [আল-মুনকার] এবং অবাধ্যতা [আল-বাগহী] করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন-যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। {১৬-নাহল}। এই আয়াতে সদাচরণকে এহসান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এর অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। মুসলিমদের পার্থিব জীবনের যাবতীয় ইবাদত এবং সকল কর্মই এহসানের সাথে সম্পন্ন করা হচ্ছে ঈমানের অংশ। নামায, যাকাত, রোজা এবং হজ্বে এহসান অবলম্বন না করলে ইবাদতের দাবী পরিপূর্ণ হয় না। কারণ মুসলিম এক আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন এবং সান্নিধ্যলাভের প্রত্যাশায় যাবতীয় কার্য সম্পাদন করে। আল্লাহ তালা সর্বদর্শী ও সর্বজ্ঞ- এটা পুরোপুরি বিশ্বাস করলেই ইবাদত এবং কাজের বিশুদ্ধতার প্রতি মনোযোগ দেওয়া যায়। এক কথায় বলা যায়, আল্লাহ-সচেতন হৃদয়েই এ ধরনের মনোবৃত্তি সৃষ্টি হয়। স্মতর্ব্য যে, আল্লাহ তা’আলা পবিত্র। কাজেই পবিত্র, ভালো, সুন্দর এবং হালাল ছাড়া অন্য কোন কিছুই তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্য হবেনা। রাসূলের (সঃ) কাছে একবার জীব্রাঈল (আঃ) এসে তিনটি প্রশ্ন [ঈমান, এহসান, কিয়ামত] করেন। তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল এহসান কি? রাসূল (সঃ) বললেন, (এহসান এই যে) তুমি (এমনভাবে আল্লাহর) ইবাদত করবে যেন তাঁকে দেখছ। যদি তাঁকে না দেখ, তিনি তোমাকে দেখছেন (বলে অনুভব করবে)। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ১, নম্বও ৪৮}।
এই হাদিসে একাগ্র চিত্তে এবাদত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, আল্লাহ তা’আলাকে দেখা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মহান আল্লাহ যে বান্দার ইবাদত, কর্ম, আচরণ, অন্তরে লালিত স্বপ্ন ও জাগতিক যাবতীয় ক্রিয়া-কলাপ সীমাহীন জ্ঞান দিয়ে অবলোকন করছেন সে বিশ্বাস সকল মুসলমানকে অন্তরে পোষণ করতেই হবে। তাই জাতিÑধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী- ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলের সাথে সদাচরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব। মানব সন্তানের জন্যে প্রতিষ্ঠিত আল্লাহ তা’আলার কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন আল-ইসলামী শরিয়তের বা বিধিবিধানের [পরিপূর্ণ জীবনাদর্শের] সৌন্দর্য এ রকম। অথচ বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর অংশ দৈনন্দিন জীবনে এই আদেশের কোন গুরুত্ব দেন না। কাজেই ইসলামী জীবনাদর্শ যে অতীব সুন্দর এবং জাগতিক কল্যাণধর্মী সকল কিছুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা মুসলমানদের কর্মকান্ডে বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পায় না। এ কারেণেই ইসলামী জীবনাদর্শ এখন হয়েছে গোঁড়া এবং সাম্প্রদায়িক আদর্শ। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই অতি প্রতিক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে দ্বিধা করেন না। মূলত ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই তারা এ ধরনের মন্তব্য করছেন। মুসলমানদের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে বর্তমানে অশান্তি ও ধ্বংসের দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের গুরুত্ব না বুঝা এবং ইবাদতে এহসান থেকে দূরে থাকা।
যাহোক আয়াতে যে তিনটি আদেশ এবং তিনটি নিষেধাজ্ঞা আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন তার সবই এহসানের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহর সান্নিধ্যাভ ও সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে উল্লেখিত আয়াতের আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা পরিপূর্ণরূপে মানা মুসলিম উম্মাহর জন্য বাধ্যতামূলক কাজ। বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ন্যায়বিচার এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিচারক সম্প্রদায়ও অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিচার কার্য পরিচালনা করেন না এবং এহসানের দিকটি আমলে নেন না। মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক; রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে লেন-দেন এবং সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে এহসানের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়না। ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে অশ্লীলতা ও নানা ধরনের সামাজিক অনাচার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আত্মশুদ্ধি এবং প্রতিহিংসার পরির্বতে অন্যদের সাথে শোভনীয় আচরণ করা অপরিহার্য বিষয় হয়ে পড়েছে। এককথায়, জীবনের প্রতিটি স্তরে রাসূলের (সঃ) চারিত্রিক আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। রাসূল (স) এর হুবহু অনুসরণ এবং অনুকরণ ছাড়া অন্যকোন পন্থায় সাফল্য আসবেনা। কারণ রাসূল (সঃ)-কে আল্লাহ তা’আলা করেছেন পূর্ণ বুদ্ধিমান, পূর্ণজ্ঞানী ও সর্বগুণে গুণান্বিত মানবজাতির জন্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। এ কারণেই রাসূল (সঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৪: তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।{৬৮-কলম}। মুসলিম উম্মাহর প্রতি আদেশ দিয়ে আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, ২১: যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। {৩৩-আহযাব}। রাসূল (সঃ) এহসানের সাথে সবকিছু করেছেন। বিশে^র মানুষকে দেখিয়েছেন কিভাবে এহসানের সাথে জীবন যাপন করতে হবে। এ কারণেই ব্যক্তিচরিত্র পরিশোধনে এবং সামাজিক স্বস্তি-শান্তি এবং নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টিতে রাসূল (সঃ) প্রতিষ্ঠিত এহসানসম্পৃক্ত সুন্নাহ অনুসরণের বিকল্প আর দ্বিতীয় কোন ব্যবস্থা নাই। মুসলিমদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য নিজের নিয়্যাতকে বা উদ্দেশ্যকে সুন্দর করা। যাতে অন্তর পরিশুদ্ধ হয়। কারণ নিয়্যাতের ভিত্তিতেই কর্মের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন, “নিয়্যাত অনুযায়ী কর্মের ফলাফল নির্ধারিত হয়। আর প্রত্যেক ব্যক্তি যেমন নিয়্যাত করবে তেমনি ফল পাবে।” {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ১, পৃষ্ঠা খ}। নামাযের প্রস্তুতিতে যথাসম্ভব সুন্দরভাবে ওযু করা। নামাযের আবশ্যক স্তম্ভ রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো, দুই সিজদাহর মাঝে বসা, সূরা ধীরে ধীরে পড়া ইত্যাদি বিনয়ের সাথে সম্পাদন করতে হয়। তা না হলে নামায আদায়ে অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে অথবা আল্লাহ তা’আলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ বিষয়টা নামাযীকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হয়। অনুরূপ রোযা এবং হজে¦র দাবী পূরণের জন্য সকল স্তম্ভ ইহসানের সাথে পালন করতে হয়। অধিকাংশ মুসলমানই নিয়্যাতকে সুন্দর করতে উদ্যোগী হয় না। নামায-রোযা আদায়ের সময় সুন্দরতম পন্থা অবলম্বন করেন না। তাড়াহুড়া করে নামায পড়া শেষ করেন। রাসূল (সঃ) যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন তা অনুসরণ করেন না। এ কারণেই ব্যক্তি জীবনে নামাযের যে প্রভাব থাকার কথা, তা অধিকাংশ মুসলিমের চরিত্রে দেখা যায় না। বর্তমান সার্বিক অবস্থা দৃষ্টে বলা যায়, ধর্ম-মত নির্বিশেষে সকল মানুষের সাথে এহসানের সাথে ব্যবহার করা মুসলিম উম্মাহর জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছে। তা নাহলে ইসলাম বিদ্বেষীগোষ্ঠী মুসলিম উম্মাহকে অপমান ও উপহাস করবে এবং সাম্প্রদায়িক হিসেবে অপবাদ দিতে পিছু পা হবে না।
আইওয়া।