এ যুগের নিরো ট্রাম্প মনের সুখে গল্ফ খেলছেন আর মানুষের মৃত্যু উপভোগ করছেন

মুহম্মদ ফজলুর রহমান

আমেরিকার ২০২০-এর নির্বাচনি ডামাডোল শেষ। নভেম্বরের ৩ তারিখে ভোট গ্রহণের পর ভোট গণনা, ফলাফল প্রকাশ শেষ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মত ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’-এর মতো আমেরিকার এবারের নির্বাচন শেষ হইয়াও শেষ হচ্ছে না। উত্তেজনা যাচ্ছে না। আমেরিকার সব মান-মর্যাদা-ভাবমূর্তি, সব ঐতিহ্য এবং নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির (জিওপি) সকল অহমিকা, গৌরবকে আটলান্টিক মহাসাগরে ছুঁড়ে ফেলে গো-হারা হেরেও পরাজয় স্বীকার না করে ট্রাম্প যে সার্কাস দেখাচ্ছেন, সেই সার্কাসের ডামাডোলে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম মহাঘাতক করোনা মহামারির কথা। আমেরিকার ২৪৪ বছরের ইতিহাসে এমন নির্বাচন কখনো কেউ দেখেনি। না আমেরিকার মানুষ, না বিশ্ববাসী। আমেরিকার নির্বাচন কেবল আমেরিকানদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছেও তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা বিশ্বজুড়ে আমেরিকার একটা প্রভাব এবং ভূমিকা রয়েছে।
আমেরিকাকে মনে করা হয় বিশ্বের অভিভাবক। শৌর্যে-বীর্যে-সম্পদে, সমর শক্তিতে বর্তমান সময়ে এক মেরুর বিশ্বে আমেরিকাই একমাত্র পরাশক্তি। সে কারণে নির্বাচনে আমেরিকার নাগরিকরা নিজেদের নেতা নির্বাচিত করছে, আর বিশ্ববাসী কেমন অভিভাবক পাচ্ছে, সেদিকে সবাই গভীর উৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এবার সেই নির্বাচন নিয়েও করোনার মতো দারুণ সংকট! নির্বাচনে হেরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে অস্বাভাবিক আচরণ করছেন, আর তার এই নজিরবিহীন ব্যবহারের জিওপি’র কতিপয় নেতা যেভাবে তাঁকে উৎসাহিত করছেন, তাতে মনে হচ্ছে দেশে এটাই শেষ নির্বাচন। আর জিওপি’ও ভবিষ্যতে ট্রাম্পের মতো কোন প্রার্থী পাবে না! তাই দেশ যেখানে যায় থাক, নীতি-আদর্শ, অহংকার-গৌরবের যা হয় হোক, জনগণ ভোট না দেয় না দিক, ট্রাম্পকে বিজয়ী ঘোষণা করতেই হবে। ২০১৬ সালে সাধারণ ভোটারদের ভোটে হেরে গিয়েও তিনি জয়ী হন। এবার সাধারণ ভোট, ইলেক্টোরাল ভোটে হারলে কী হবে, ট্রাম্পই জয়ী! জো বাইডেন-কমলা হ্যারিস পপুলার ভোট যত বেশিই পান, যতই বেশি পান ইলেক্টোরাল ভোট, মানি না, মানি না! আমেরিকার ইতিহাসই পাল্টে দিতে চান ট্রাম্প। আমেরিকার প্রেসিডেন্সি যেনো ট্রাম্প টাওয়ারের মতো ব্যক্তিগত সম্পদ, কিছুতেই তার দাবি ছাড়া যাবে না! ট্রাম্প যেনো একটা গোপন মিশনে নেমেছেন। উদ্দেশ্যÑ আমেরিকার ভাবমূর্তি-গৌরব, সব ইতিহাস, ঐতিহ্য মাটিতে মিশিয়ে দেয়া। এ মিশন তার নিজের স্বার্থে, নাকি অন্য কারো ক্রীড়নক হয়ে করছেন, তা অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনার মতো মহাঘাতককে পাত্তা না দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমেরিকাকে ‘গ্রেট এগেইন’ করে তোলার স্লোগান দিয়ে ২০১৬ সালের মতো এবারও বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন। আমেরিকার জনগণ সেই স্লোগানে এবার ভুলেনি। তাই তিনি ক্ষিপ্ত, বেসামাল। আমেরিকার ইতিহাসে কোন পরাজিত প্রেসিডেন্টকে এমন আরচণ করতে দেখা যায়নি। ঠিক রোমের রাজা নিরোর মতো। রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাতে মগ্ন ছিলেন। আমেরিকার মহারাজা ট্রাম্পও এখন মানুষের মৃত্যু উপভোগ করতে মনের সুখে গলফ খেলছেন আর রসিয়ে রসিয়ে অসহায় মানুষের মৃত্যু দেখছেন এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উপভোগ করে যাচ্ছেন। এইসব সংকটকে গভীর করে তুলতে তাতে আরো হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন। হায় কী বিচিত্র সেলুকাস!
এ রকম পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে করোনা যেনো আরো বেপরোয়া। মানুষ, সভ্যতা সবকিছু যেনো ধ্বংস করে দিতে দ্বিতীয় দফায় আরো রুদ্রমূর্তি নিয়ে এসেছে। কিন্তু ট্রাম্পের কাণ্ড কারখানায় যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে সেদিকে দৃষ্টি দেয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে বিজয় জো বাইডেন। এ ফাঁকে মানুষের জীবন হরণের মহোৎসবে মেতেছে কোভিড-১৯। দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত আমেরিকা। বেসামাল গোটা বিশ্ব। আমিেরকায় ট্রাম্প যখন ক্ষমতা নিয়ে নানা চক্রান্তে মত্ত, করোনা তখন প্রতিদিন আগেরদিনের রেকর্ড ভেঙে ভেঙে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এগিয়ে চলেছে। মাসের পর মাস ঘরবন্দি মানুষ। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু, ধনি-দরিদ্র সবাই অস্থির, বিষণ্ন। সুখহীন, শান্তিহীন, স্বস্তিহীন। কেবল ট্রাম্প বেপরোয়া। তিনি আমেরিকার ইতহাস-ঐতিহ্য গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেই ট্রাম্প ইতিহাস গড়তে চান। তাঁর ইতিহাস আইন লংঘন করার। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার। মানুষকে অসম্মান করার এবং রাষ্ট্রকে সংকটে ফেলে দেয়ার।
এমন বিপন্ন সময়ে কারো মনই ভালো রাখা সম্ভব নয়। কোথাও স্থির থাকে না মন। উরু উরু, পাগল পাগল, আউলা ঝাউলা। বুকের ভেতর দম নেই। ফাঁকা ফাঁকা। ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’। ঘরের বাইরে নিষিদ্ধ জগৎ। রাতদিন অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। কেঁপে কেঁপে ওঠে বুক। বন্দিজীবনে কখনো বই পড়ে মনটাকে শান্ত রাখার, একে ওকে ফোন করে একটু সময় পার করার চেষ্টা। কখনো বা দেশে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে খোঁজ-খবর নেয়া। কিন্তু মন শান্ত হয় না। অস্থিরতা কাটে না। মৃত্যু সংবাদ শুনতে শুনতে এখন ভয় বা অস্থিরতা নয়, বড় ক্লান্তি লাগে।
মৃত্যুর সামনে দাঁড়ালে কি এমনটা হয়? সুস্থ সময়ে মানুষ মৃত্যু নিয়েও কত হালকা কথা, হাসি-ঠাট্টা মস্করা করে। করোনাকালে সেটাও করতে ইচ্ছ হয় না। চারদিকে জীবন বিবর্ণ। মৃত্যুর হুইসেল। সবকিছু ধূসর, রঙহীন। মহামারি করোনা ভাইরাস সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। শহর-নগর-জনপদ কেমন যেনো সব অচেনা অচেনা। জীবনযাপন পাল্টে গেছে। কত চেনা, কত প্রিয় চারপাশ অচেনা লাগে। জ্যাকসন হাইটসের মত প্রিয় আড্ডা, হিলসাইডে কেনাকাটা হারিয়ে গেছে। নিজের বাড়ি চিনি না। স্বজন-পরিজন কিছুই যেনো আমার চেনা নয়। এখন মানুষে ভয়, অন্ধকারেও ভয়।
নিজে যে এখনও বেঁচে আছি, তা যেনো চিমটি কেটে অনুভব করতে হয়। করোনাকে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে বাঁচা! মৃত্যু অনিবার্য অলংঘনীয় সবাই জানি, সবাই মানি। এতদিন জীবন উপভোগ করতে করতেই বেঁচেছি। মনে হয়েছে জীবনই সত্য। এখন প্রতিদিনই মৃত্যু গায়ে নিঃশ্বাস ফেলে যায়। মনে হয় দরজার পাশেই মৃত্যুর ছায়া। দরজা খুললেই মৃত্যু হাতকড়া পরিয়ে দেবে। ঘাড় মটকে দেবে। করোনার ভয়ে ঘরে বন্দি থেকে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কারো হার্ট এ্যাটাক, কারো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ ট্রমাগ্রস্থ। বাচ্চারা বর্গির ভয় ভুলে গেছে। করোনার ভয়ে মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়। আত্মহত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে আগের চেয়ে বেশি বেশি। মানুষ হেরে যাচ্ছে করোনার কাছে। কী দারুণ দুঃসময়!
সবারই মুখে মুখে কেবল করোনা। ঘোর দুর্দিন। মিডিয়ায় করোনা। আড্ডাতো নেই। টেলিফোনে করোনা। শয়নে-স্বপনে, জাগরণে করোনা। মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, প্রেম-ভালোবাসা, মানবতা সব হরণ করে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। বিরহ-বিচ্ছেদেও মায়া নেই নিষ্ঠুর করোনার। মানুষের মহাশত্রু মহামারি করোনা। রাতদিন সর্বত্র একই খবর কেবল করোনা, করোনা আর করোনা। না শুনলেও মন ছটফট করে, না জানি কোন সুখবর মিস করলাম। শুনলেও মন বিক্ষিপ্ত। মাস যায়, বছর যায়Ñ কোন সুসংবাদ নেই। কী অসহনীয় পরিবেশ। মানুষকে কি এমন স-ময় আর কখনো পার করতে হয়েছে? ইতিহাস সন্ধান করেও এমন দুঃসময়ের খবর মেলে না। মানুষ দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। খরা-বন্যা মহামন্বন্তর দেখেছে। মানুষসৃষ্ট দাঙ্গাও দেখেছে। অর্থনীতিতে মহামন্দা পাড়ি দিয়েছে। কর্মহীন হয়েছে। লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু এ কেমন সময়, কেবলই অসহায় আত্মসমর্পণ মানুষের। তবে কি করোনার করুণাতেই মানুষের মুক্তি!
মানুষ সব সময় নিত্যনতুন কৌশল নিয়ে নতুন নতুন শত্রুর মোকাবিলা করে এসেছে। একেক শত্রুর বিরুদ্ধে একেক কৌশল। একেক পরিকল্পনা। কিন্তু এ কেমন শত্রু করোনা! দেখা যায় না। লড়াই চলে না। হাতিয়ার নেই। সকাল-বিকাল নাকি চরিত্র পাল্টায়! সব অস্ত্র ব্যর্থ। বিজ্ঞানীদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। অসহায় মানব জাতি। শুনতে পাওয়া যায়, বিজ্ঞানকে ভৃত্য বানিয়ে মানুষ নাকি অর্ধশতাব্দী পর মৃত্যুকে গুডবাই জানবে। দুর্ঘটনাব্যতিত কোন রোগে শোকে মানুষ আর মরবে না। সব মানুষ মরণশীল, এই শাশ্বত সত্য নাকি আর শাশ্বত থাকবে না! এ সংজ্ঞা পাল্টে যাবে। তা হয়তো সত্য হবে না। কিন্তু বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রা মানুষকে প্রেরণা জোগাবে।
মানুষ কেনো তবে মাত্র ৫০ বছর আগে এতোটা অসহায়! মৃত্যুকে ঠেকিয়ে দেয়া দূরে থাক, একটা অণুজীবের কাছে এ কেমন পরাজয়। তার বিরুদ্ধে বছর পরও সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববাসী এমন বিপদে আর কখনোও পড়েনি। একদিন হয়তো এ বিপদও পাড়ি দেবে, কিন্তু মৃত্যুর পায়ে জীবন নামের কত নৈবেদ্য দিতে হবে, কে জানে! মানুষের পরিণতিও কি করোনার কাছে হেরে গিয়ে ডাইনোসরের মতো লুপ্ত হবে? যে ইতিহাস পাঠ করার জন্য আর একটা মানুষও অবশিষ্ট থাকবে না! তবে কি এখন মানবসভ্যতা রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ করোনার করুণা?
বাঙালিরাতো ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে ৩০ লাখ জীবন আত্মহুতি দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। তারা যেমন মরেছে, শত্রুকেও মেরেছে এবং পরাজিতও করেছে অবশেষে। কতো উত্তেজনা। রাজনৈতিক উত্তেজনা, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। হানাহানি, কাটাকাটি, বোমাবাজি। আজকের মতো তবু এতোটা অসহায়বোধ করেনি মানুষ, যেমন করোনার কাছে হচ্ছে। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে অসহায়ভাবে মৃত্যুভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হয়নি। মানুষের হার মানে বিজ্ঞান ও সভ্যতার হার। মানুষ হয়েও এতদিন যারা নিজেদের অপরাজেয় ভেবে মানুষের বিরুদ্ধে চোখ রাঙিয়েছে, তাদের সবার আজ মাথা নত।
বিশ্বাস করি, সব দুর্যোগ শেষে মানুষই জয়ী হবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু যে সোস্যাল ডিস্ট্যান্স এবং মানুষে মানুষে যে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিলো করোনা, সেই দূরত্ব আর কখনো খুঁচবে কিনা। আমরা আগের মতো আবার পারবো না কাছাকাছি আসতে? বুকে বুক মেলাতে? আবার আগের মতো টেবিলে টেবিলে ঘন হয়ে বসে আড্ডা জমবে কিনা। করোনাকালে যে মানসিক বিষণ্নতা জন্ম নিলো মনে, সেই বিষন্নতা কাটিয়ে আবার আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা ফিরতে পারবো তো? জ্যাকসন হাইটস, হিলসাইড, ওজনপার্ক, ব্রুকলিন, ব্রংকস আবার বাঙালিদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠবেতো? এ রকম প্রশ্নে বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। সব প্রশ্ন ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়, তাহলোÑ আগামীর সেই আড্ডায়, সেই পথচলায় আমি থাকবো তো? আমার প্রবাসী স্বজনদের পাবো তো সেখানে? নাকি সব হারিয়ে যাবে। সব অচেনা হয়ে যাবে। মানুষ, আসর, আড্ডা, কোলাহল অচেনা। আনন্দ-বেদনা, সাহিত্য একাডেমির সাহিত্যের আসর, শহীদ কাদরী, সৈয়দ হক নিয়ে আলোচনা, অচেনা।
তবু প্রার্থনা, আমি থাকি না থাকি, আর সব যেনো থাকে। মানুষ যেনো না হেরে যায়। মানুষেরই যেনো জয় হয়। মানবতা ও সভ্যতার জয় হোক। আমি থাকি না থাকি, আমার উত্তর-প্রজন্ম থাকুক হাসি-গানে, জীবনের বিজয় উৎসবে। থাকুক দুধেভাতে বাংলার শ্যামল ছায়ায়। সভ্যতার বুকে যেনো লেখা থাকেÑ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা।
২৭ নভেম্বর ২০২০, নিউইয়র্ক