ওপারে নীল আকাশ

জাকিয়া শিমু :

শিখা সারাক্ষণ ভয়ে ত্রস্ত থাকে। বুকটা ধড়ফড় করে। হাত থেকে রান্নার খুন্তিটা কোনো কারণে মেঝেতে পড়ে গেলেও ভয়আতঙ্কে হরিণসাপদের মতো চারহাত উপরে লাফিয়ে উঠে। আজকের ঘটনাটা যেমন- দুপুরের খাওয়া শেষে বারান্দায় গামছার খোঁজে এসে সহসা চোখ পড়ে পাশের বাড়ির ঝুল বারান্দায়। সেই সাতসকালে দেখা লোকটাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত খরগোশের মতো কুঁকড়ে উঠে! হৃদপিণ্ডে ঢকঢক আওয়াজ শুরু হয়। চটজলদি সিঁধেলচোরের মতো চারপাশে সজাগদৃষ্টি মেলে দেখে নেয়, কেউ দেখে ফেলল কিনা! লোকটা ফ্যালফ্যাল চোখে তাঁর দিকে তখনো তাকিয়ে আছে! যা অতি তুচ্ছ-বিষয় কিন্তু শিখা যারপরনাই ভয় পায় এবং ভয়াবহ আতঙ্কে কেঁপে উঠে। আশপাশে কেউ নেই সেই সুযোগে কড়া-চোখে লোকটার দিকে কঠিন দৃষ্টিভস্ম ঢেলে, দ্রুত পায়ে ঘরে পালিয়ে বাঁচে।
গায়েগতরে এককথায় চোখে পড়ার মতো মেয়ে- শিখা। মানুষজন বিশেষ করে পুরুষমানুষের ত্যাক্তলোভী চোখের সাথে তাঁর চিনপরিচয় নতুন নয়। ‘মেয়েমানুষ ঘরের বাইর হলে পুরুষমানুষের চোখে লেহ্য হবে’ সমাজের অলিখিত এ নিয়মে সে অভ্যস্ত হয়ে আছে সেই ছোট্টবেলা থেকেই।

তবে মূল সমস্যা তাঁর মধ্যে নয়, অন্যখানে। তাদের বাড়িঘেঁষা সরু রাস্তার উল্টো ধারে লাগোয়া একসারি অগোছালো অট্টালিকা, আগাছার মতো মাথাগুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটাতে সিতারা ভাবি বসত করেন। ভাবির ছেলে শিখার ছেলের সহপাঠী এবং বন্ধু। সে সূত্রে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক বেশ আগে থেকে রয়ে গেছে। শিখারা এ বাসায় নতুন উঠেছে। বলতে দ্বিধা নেই- সিতারা ভাবির উছিলায় এই বাসাটা চড়তিবাজারে সাধ্যিমূল্যে পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনো এক অচিন কারণে ভাবি, শিখাকে অপছন্দ করেন। যদিও শিখার স্বামী শরীফ সাহেবের সাথে স্কুলগেটে তার বাড়তি মাখামাখি-সম্পর্ক অন্য ভাবিদের অশ্লীল আলাপের টসটসে রসদ যোগায় সহজেই।

শিখা দেখতে সুন্দর এবং স্বভাবতই বুদ্ধিশুদ্ধির ঘাটতি রয়ে গেছে। তবে ভাবির সৌন্দর্য-ঘাটতি তার কূটচাল- স্বভাব দ্বারা পুষিয়ে নিয়েছেন বলাই বাহুল্য। স্কুলের ভাবিগ্রুপ তাকে বিশেষ তোয়াজ করে চলে কারণ তার জালটোপে আটকা পড়তে কারও সাহস দেখানোর কথা নয়। ভাবির কাজ, সময়ে-অসময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চতুরপাশে শকুনের মতো চোখ বিছিয়ে রাখা। ভাবির বাসা থেকে শিখা এবং লোকটার বারান্দা স্পষ্টত চোখে পড়ে। লোকটার এমন ‘ফ্যালফ্যাল’ দৃষ্টি, ভাবির দৃষ্টিতে পড়লে রক্ষা নেই। তাছাড়া ঘরের মানুষ, শরীফ সাহেব নামক আতঙ্ক তো আছেই !

শরীফ সাহেবকে অবশ্য সমাজের আট-দশটা মধ্যবিত্ত পুরুষের সাথে এককাতারে খাড়া করিয়ে দেওয়া যেত নির্দ্বিধায়। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চলনসই বেতনে কাজ করতেন। মধ্যবিত্ত সংসারগুলো যেমন করে ঢিলেঢালা চলে, তদ্রুপ তার সংসারও চলছিল ভালো-মন্দে গলাগালি ধরে। মাঝখানে বাধ সাধলো করোনা। করোনা মহামারিকালে চতুর- কোম্পানি কর্তৃপক্ষ লোকবল ছাঁটাই করতে শুরু করে। ছাঁটাইয়ের বলয়ে আটকে যান শরীফ সাহেব।

গত দুবছর গরুখোঁজার আদলে একটা কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে দ্বারেদ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু তার সমমানের চাকরিবাজারে আগুন। তিনি স্বপ্নবাজ জমিদারের মতো আগের অবস্থানের অবস্থা ভুলতে পারেন না। কোনোমতে বেঁচেবর্তে চলার মতো কাজের খোঁজে তাকে রাজি করানো যায় না। ওদিকে শাড়ির ভাঁজ, রান্নাঘরের কৌটা, মানিব্যাগের জঠরসহ গোপনজমানো টাকা খরচ শেষে- এখন টেনেটুনে কোনোমতে সংসার চলছে, শিখার বিয়ের গহনা বেচা টাকায়। তিন কামরার গোছানো ছিমছাম ফ্ল্যাটবাসা রেখে উঠে এসেছেন, একঘরের এই ছোট্ট বাসায় এবং ঠাঁসাঠাসি করে কোনোমতে দিন পার করছেন।

অসময়ে মানুষের প্রকৃত রূপ সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে। চাকরি হারিয়ে বর্তমান-দশায় শরীফ সাহেবের বিচারবিবেকের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ক্ষয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়ির দিকের দূরসম্পর্কের লোকের কাছেও নির্দ্বিধায় নির্লজ্জের মতো হাত পাতছেন। যৌতুকের মতো লজ্জাজনক কাজকে এক লহমায় হালাল করছেন। শিখাকে যৌতুকের জন্যে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন সাবলীলভাবেই করতে শুরু করেছেন।
ওদিকে নিজের গাঁয়ে বাবার বেশকিছু জমিজিরত রয়েছে। শিখা এই দুর্দিনে শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে গিয়ে বাস করতে বহুবার তাকে অনুরোধ করেছে। কিন্তু সে প্রস্তাবে তাকে রাজি করানো যায় নাই।

সংসারে অভাবঅনটন তার মধ্যে শরীফ সাহেব নানান ছুঁতোছাতায় ক্রমাগত অশান্তি করে চলেছেন। পূর্বে ছিল কিনা জানা নেই ইদানিং তার সন্দেহবাতিক রোগও দেখা গেছে এবং তা মারাত্মক আকারে বলা যায় নির্দ্বিধায়।

একসময়ে শিখা বেশ সৌখিন ছিল। টিপটপ সাঁজগোঁজ তার স্বভাবের সাথে মানিয়েও ছিল। বাড়ির বাইর হলে, তার চোখেমুখে প্রসাধনের বেজায় আঁচ থাকত। শরীফ সাহেব নিজেও তা চাইতেন। কিন্তু গত দু’বছর ধরে শিখা নিজের সাধআহ্লাদ জীবন থেকে বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। প্রসাধন তো দূরে থাক, হাত-কান-গলার সাধারণ অলংকারের চিহ্নটুকু খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু মসুরদানার একটা নাকছাবি, টিকালো নাকের অগ্রভাগে স্বামীচিহ্নের সাক্ষী রাখতে পরে থাকা। তারপরও শরীফ সাহেবের সন্দেহ ঘোচে না। শিখার রূপ-সৌন্দর্য এখন তার কাছে একটা নষ্টরোগের মতো মনে হয়। ওদিকে শরীফ সাহেবের চোখ-কানে যদি এই লোকের ‘ফ্যালফ্যাল’ দৃষ্টির কথা চাউর হয় তাহলে ঢিলেঢালা এ সংসারও, বাঁশকাগজের ঘুড়ির মতো কোন অজানায় উড়ে যাবে বলা মুশকিল!

শিখার মা-বাবা গ্রামে থাকেন। তিন ভাইবোন নিয়ে সংসার। বাবা গাঁয়ের পোস্ট অফিসে কাজ করেন। পোস্ট অফিসের বর্তমানে যেমন বেহালদশা বাবার অর্থনৈতিক অবস্থাও তথৈবচ। দু’কানি দাদারকালের ধানীজমি ছিল বলে কোনোমতে ঝোলভাতে দিন পার করছেন। বাবার কাছে বাড়তি কিংবা জমানো টাকা থাকা অবাস্তব বটে! শিখা তাঁর সংসারের আসন্ন ঝড়তাণ্ডব ভালোমতো টের পায়। শেষমেশ দিশেহারা হয়ে শেষনির্ভর নিজের গয়নাবাক্সে হাত দিতে বাধ্য হয়।

ভরি পাঁচেক সে-গহনারও পারিবারিক বন্ধন-ঐতিহ্যের একপ্রস্থ ইতিহাস রয়ে গেছে। শিখার মা ছিলেন নানা-নানির একমাত্র মেয়ে। নানির চিহ্নস্বরূপ এ গহনাসেট মায়ের হাতে আসে। নানিকেও তার মা নিজের গায়ের গহনা খুলে দিয়েছিলেন তার মৃত-মায়ের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু লালন করতে। এবং সেটা ছিল তারও মায়ের কাছ থেকে পাওয়া গহনা। ভারী এবং পুরনোকাজের ওপর ধূসর-সোনাররঙের সেই অলংকার এসেছিল তার মায়ের কাছ থেকে। বংশ পরম্পরায় প্রায় সাত-নারীর ভালোবাসার স্মৃতিচিহ্ন শিখার কপালে জুটলেও শেষরক্ষা করা গেল না। এ গহনা শুধু সোনা দিয়ে গড়া কোনো অলংকারের নাম নয়, এযে বহু বছর ধরে রাখা সাত নারীর ভালোবাসার মুঠোবন্ধন। শিখা যেদিন হাতের বালাজোড়া বিক্রি করে ফিরছিল মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা নির্ভরতা এক ঝটকায় তাঁকে ছেড়েছুড়ে নির্বাসনে চলে গেল। খুব অসহায় লাগছিল, জুয়েলারি মার্কেটের উল্টোদিকের বাসঘাটে বসে অঝোরে কেঁদেছিল একচোট। কতোটা অসহায় দিশেহারা অবস্থায় পড়লে মেয়েরা বিয়ের অলংকার ছাড়তে বাধ্য হয় শরীফ সাহেবের মতো লোভীলম্পটদের সে ধারণা থাকে না।

মহামারি করোনা, শিখাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছে! কিন্তু সমস্তটা ভেঙেচুরে একছাড় করে দিয়ে গেছে। করোনার প্রথম ধাক্কায় তার পুরো পরিবার কঠিনভাবে ভোগে। নিজে মরি মরি করে পরিশেষে বেঁচে উঠলেও শরীর থেকে এ-রোগ বয়োঃবৃদ্ধদের শরীরের মতো নিংড়ে শুষে নিয়েছে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার শক্তি-সামর্থটুকু। শুধু শারীরিক নয় মানসিক অবস্থারও বিস্তর উলটপালট ঘটে গেল খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। আত্মশক্তিটা মোমের আলোর মতো উড়ে ফুরিয়ে গেছে। অল্পতেই ভয়ডর অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে থাকে। ঘরেবাইরে সর্বত্র চিত্র অভিন্ন। সম্পর্কগুলো নিজস্বার্থের গণ্ডিতে লটকে অচিন তো হয়েছেই বটে! নিজঘরের পরিবর্তনটাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। শিখার ঘরটাকে এখন ঘর নয়,-গাঢ় আঁধারে- দম বন্ধ করা কবর মনে হয়। কতদিন হয়ে গেল নির্ভয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসটা পর্যন্ত টেনে নেওয়া হয় নাই। করোনাকালের চেয়ে পরবর্তী সময়টা বড্ড কঠিন হয়ে গেলো!

লেখক : কথাশিল্পী। (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)