ওড়না পেঁচিয়ে বাংলাদেশি মহিলার আত্মহত্যা

ঠিকানা রিপোর্ট: ’বউ-এর আগে আমি কেন চলে গেলাম না, আল্লাহ কেন আমাকে আগে নিয়ে গেল না, আমাকে মেরে তুমি কেন চলে গেলে, আমার স্ত্রী চলে গেছে আমি এই দুনিয়াতে এখন বেঁচে থেকে কী করবো, এই বাড়ি দিয়ে আমি এখন কী করবো, এই বাড়িই আমার দুনিয়া শেষ করে দিয়েছে’- বার বার এই কথাগুলো বলছেন, আর বিলাপ করছেন। তার দুটো চোখ বেয়ে পানির স্্রোত যেন বইছে। বাংলাদেশে সাধারণত কেউ মারা গেলে মহিলাদের বিলাপ করতে দেখা যায়, কিন্তু এই আমেরিকায় স্বামী তার স্ত্রীর আত্মহত্যার পর এভাবে বিলাপ করছেন। তার বিলাপে বাকরুদ্ধ সবাই, প্রকৃতিও যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। যারা সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন, তারাও মোহাম্মদ ইউছুপের বিলাপে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। যাকেই পান তাকে ধরেই মোহাম্মদ ইউছুপ বিলাপ করেন। শান্ত¦না দেয়ার ভাষা যেন কারো জানা নেই।
মোহাম্মদ ইউছুপের স্ত্রী শামসুন নাহার গত ১৫ এপ্রিল সকাল ৮টা ১৫ মিনিটের সময় নিজ বাসার বেইসমেন্টে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মোহাম্মদ ইউছুপ তার স্ত্রী শামসুন নাহার এবং একমাত্র সন্তান সাইফ উদ্দিনকে নিয়ে ৬২৮ ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রুকলীনে নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। মোহাম্মদ ইউছুপ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ১৫ এপ্রিল আমরা এক সাথে তাহজ্জতের নামাজ, ফজরের নামাজ, ইশরাকের নামাজ ও কোরআন তেলওয়াত করি। নামাজ পড়ে আমি ঘুমিয়ে যাই। আমার সন্তান সাইফ উদ্দিন ঘুম থেকে ওঠার পর আমার স্ত্রী তার সন্তানকে রুটি বানিয়ে নাস্তা করান। নাস্তা করার পর সকাল ৮টা ৫ মিনিটের সময় সাইফ উদ্দিন কাজে চলে যান। সাইফ উদ্দিন ওভার চালাতেন। সাইফ উদ্দিন কাজে চলে যাবার পর মোহাম্মদ ইউছুপ ঘুম থেকে ওঠেন এবং দেখতে পান যে তার স্ত্রী বাসায় নেই। তিনি বাসার বিভিন্ন রুম খুঁজতে থাকেন। দৌড়ে বাসার ব্যাকইয়ার্ডে যান কিন্তু কোথাও তার স্ত্রী নেই। এক সময় তিনি দেখতে পান যে, তার বাসার বেইসমেন্টের দরজা খোলা। সেই দরজা দিয়ে তিনি বেইসমেন্টে গিয়ে দেখতে পান যে, তার স্ত্রী ওড়না পেঁচিয়ে একটি পাইপের সাথে ঝুলে রয়েছেন। তার পায়ের স্যান্ডেল দুটো ফ্লোরেই পড়ে রয়েছে, একটি মিল্ক র‌্যাক তার পায়ের নিচে। ধারণা করা হচ্ছে এই মিল্ক র‌্যাকের সহযোগিতায় তিনি আত্মহত্যা করেন। সাথে সাথেই পুলিশ কল করা হয়। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে আসে এবং শামসুন নাহারকে (৫৩) মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে কিং কাউন্টি হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঐ হাসপাতালেই তার পোস্ট মর্টেম করা হয়। শামসুন নাহারের নামাজে জানাজা গত ১৬ এপ্রিল বাদ মাগরিব ব্রুকলীনের বেলাল মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল গ্রেটার নোয়াখালি সমিতির ক্রয়কৃত ওয়াশিংটন মুসলিম গোরস্তানে দাফন করা হয়।
মোহাম্মদ ইউছুপ ১৯৮১ সালে আমেরিকায় এসেছিলেন। আমেরিকায় এসে ব্রুকলীনেই বসবাস শুরু করেন। দিন রাত পরিশ্রম করে ১৯৮৬ সালে সিদ্দিক মাস্টারের সাথে শেয়ার করে ৬২৮ ওয়েস্ট মিনিস্টার রোড়ে এই বাড়িটি ক্রয় করেন। বাড়ি ক্রয়ের পর সিদ্দিক মাস্টার বাড়িটি জনৈক এনামুলের হকের কাছে বিক্রি করে দেন। সব কিছু ভালভাবেই চলছিলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় মোহাম্মদ ইউছুপ যখন তার অংশটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। এ নিয়ে তিনি তার অংশিদারের সাথে আলাপ আলোচনাও করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার অংশটি অংশিদারকে ক্রয় করার জন্য। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। যে কারণে মোহাম্মদ ইউছুপ একটি রিয়েলএস্টেটকে দিয়ে দেন। সমস্যা তখনই তৈরি হয়। মোহাম্মদ ইউছুপ থাকেন বাড়ির নিচ তলায়, আর এনামুল হক তার পরিবার নিয়ে থাকেন দ্বিতীয় তলায়। সমস্যা তৈরি হবার পর নিচ তলায় মোহাম্মদ ইউছুপ কোনভাবেই তার বাড়ি মেরামত করতে পারছিলেন না। এখনো তার বাথ রুম এবং রান্না ঘর ভাঙ্গা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এখনো রয়েছে। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। মোহাম্মদ ইউছুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় নারী নির্যাতন সক্রান্ত। সেই মামলায় ২০১৬ সালে পুলিশ মোহাম্মদ ইউছুপকে ধরে নিয়ে যায়। জেলও খেটেছেন কয়েকদিন। জেল থেকে বের হলেও পুলিশ প্রটেকশনের কারণে নিজ বাড়িতে আসতে পারেননি মোহাম্মদ ইউছুপ। তার স্ত্রী কয়েক মাস ধরে স্বামীর জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যেতেন। মোহাম্মদ ইউছুপ জানান, ঐ ঘটনার পর থেকেই আমার স্ত্রী দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, কম্যুনিটির বহু লোকের কাছে গিয়েছি কিন্তু সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। উল্টো বাড়ির মর্টগেজ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে এনামুল হক। যে কারণে বাড়িটি ফোর ক্লোজারে চলে যায়। দিশেহারা হয়ে পড়েন মোহাম্মদ ইউছুপ এবং তার স্ত্রী শামসুন নাহার। মোহাম্মদ ইউছুপ আরো জানান, অসুস্থ হতে হতে আমার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তাকে নিয়মিত ডাক্তারও দেখানো হচ্ছে। তার ডাক্তার কুন্ড এবং বসু। ডাক্তার বলেছেন শামসুন নাহারকে সব সময় নজরে রাখার জন্য। কিন্তু কে নজর রাখবে? স্বামী মোহাম্মদ ইউছুপ নিজেই চরম অসুস্থ। তার কিডনীসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘ দিন কাজ করতে পারছেন না। সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী সন্তান সাইফ উদ্দিন। সে ওভার চালিয়ে সংসার চালাচ্ছিলো। সাইফ উদ্দিন জানান, আমি গত বছর ওমরা হজ্ব করেছিলাম। সেই সময় মা বলেছিলো- তুমি তো ওমরা করে এলে, আমাকে নিয়ে গেলে না। তখন আমি মাকে বলেছিলাম- মা এ বছর আমরা সবাই হজ্ব করতে যাবো কিন্তু আমি আমার মাকে হজ্ব করাতে পারলাম না। আমার এই দু:খ থেকেই যাবে।
এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ব্রুকলীনে পুরো বাংলাদেশী কম্যুনিটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। সাথে সাথেই দেখা করতে গিয়েছেন বৃহত্তর নোয়াখালি সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ রব মিয়া, সাধারণ সম্পাদক জাহিদ মিন্টু, প্রধান উপদেষ্টা হাজী মফিজুর রহমানসহ সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ। গত ১৫ এপ্রিল সারাদিন ব্যাপী মোহাম্মদ ইউছুপের বাড়িতে ছিলো সর্বস্তরের মানুষের ভীড়। পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের উপস্থিতিও ছিলো লক্ষ্যণীয়। অনেকেই বলেছেন, শামসুন নাহার একজন নামাজি মহিলা ছিলেন। তার এই আত্মহত্যা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। শোকে মুহ্যমান পুরো কম্যুনিটি।