কবিতার মিল, অন্ত্যমিল

কামাল চৌধুরী :

সাধারণ পাঠক মনে করেন কবিতার মিলই কবিতার ছন্দ, বিশেষ করে অন্ত্যমিল। মিল না থাকলে বলা হয় কবিতায় কোনো ছন্দ নেই। দুটি শব্দ যখন একই রকম ধ্বনি সৃষ্টি করে, তখনই কবিতার মিল ঘটে। জোসেফ ব্রডস্কি বলেছেন, যখন দুটি জিনিস একই শব্দের সৃষ্টি করে, কিন্তু তাদের অর্থ বদলে যায়, তখনই মিলের সৃষ্টি হয়। মিলের মাধ্যমে কবিতার শব্দ, লাইন, অনুভূতি ইত্যাদির মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। মিল ছন্দ-প্রকরণের অংশ হলেও কবিতার শরীরের অত্যাবশ্যক অঙ্গ নয়। ছন্দ ভেতরের ব্যাপারÑ কবিতার শরীরেই সেই ছন্দ জড়িয়ে থাকে। অমিল কবিতার ভেতরেও ছন্দের দোলা থাকে। মিল মূলত ছন্দের অলংকার। অনেকে মিলের প্রতিশব্দ হিসেবে মিত্রাক্ষর শব্দ ব্যবহার করেন।

মিলকে ইংরেজিতে বলা হয় Rhyme। সতেরো শতক পর্যন্ত Rhyme বানান লেখা হতো Rime। ইংরেজি কবিতার শুরুতে মিলের ব্যবহার তেমন ছিল না, প্রাচীন গ্রিক বা সংস্কৃত কিংবা চীনা কবিতায়ও মিল দেওয়ার দৃষ্টান্ত কম। মিলের ব্যবহার শুরু হয় মধ্যযুগে। বাংলা কবিতায় কবে থেকে মিলের ব্যবহার শুরু, সে রহস্যের সুরাহা হয়নি। তবে কারো কারো মতে, লোকগীতি বা ছড়াগান থেকে এর শুরু। বাংলা কবিতার শুরু থেকেই আমরা মিলের ব্যবহার দেখি- মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণবকাব্যে মিলের ছড়াছড়ি। সেকালের সেরা কবিরা, যেমন- বড়ু চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র, আলাওল সবার কবিতাই সমিল। রামায়ণ-মহাভারতের অমিল লাইনকেও বাংলায় সমিল অনুবাদ করা হয়েছে। ইংরেজ কবি জন মিল্টন ব্ল্যাঙ্ক ভার্স লিখেছিলেন, যা মূলত অমিল কবিতা। মিল্টনের অনুসরণে বাংলা কবিতায় প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রচলন করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যা ছিল অমিল পয়ার।

বিহারীলালের ছন্দ আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতায় মিলের দুটি গুণের উল্লেখ করেছেন। তা হলো মিল ‘কর্ণতৃপ্তিকর’ ও ‘অভাবিত পূর্ব’।

রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের এ কবিতায় ‘তালে তালে নূপুর ঝংকৃত হইয়া উঠে’ বলে উল্লেখ করেছেন, সেটি মিলের জন্যইÑ
সুঠাম শরীর পেলব লতিকা,
আনত সুষমা-কুসুম ভরে;
চাঁচর-চিকির নারদ মালিকা,
লুকাতে রয়েছে ধরণী ’পরে।

মিলের সুষমা ও ছন্দ মাধুর্যের কথা অনেকেই বলেছেন। অনেকে মিল থাকলে কবিতা সহজে স্মরণযোগ্য ও স্মৃতিসহায়ক হয় মনে করেন। তবে মিল ছাড়াও নিখুঁতভাবে স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখা যায়। মুক্তছন্দেও অনেকে পঙ্‌ক্তি শেষে মিল ব্যবহার করেন। কেউ কেউ গদ্য ছন্দেও মিল খুঁজতে যান, তবে আমি মনে করি গদ্য কবিতায় কবিতার ব্যঞ্জনা থাকে- কিন্তু মিল খোঁজা অবান্তর। এতে গদ্য কবিতার স্বরের ব্যত্যয় ঘটে। স্বরবৃত্ত যেহেতু ছড়ার ছন্দ, সেজন্য এতে অন্ত্যমিলের ব্যবহার বেশি। মাত্রবৃত্ত ছন্দেও অধিক গীতিময়তা আনতে মিলের ব্যবহার দেখা য়ায়। অক্ষরবৃত্ত বা মুক্তছন্দে বর্তমান সময়ে অন্ত্যমিল কম ব্যবহার করা হয়। তবে কবিতায় অন্ত্যমিলের ব্যবহার কবির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে সমিল, অমিল দুই ধরনের কবিতাই দেখা যায়।

মিল নানা রকমের হয়। ইংরেজিতে মিলের নানা পরিভাষা আছে। যেমন-end rhyme, near rhyme, half rhyme ইত্যাদি। বাংলায়ও এর নানা ধরণ আছে। যেমন- অন্ত্যমিল, পূর্ণমিল, প্রায়মিল বা কাছাকাছি মিল। মিল তৈরি হয় শব্দ বা ধ্বনি দিয়ে। এক লাইনের শেষের ধ্বনির সঙ্গে অন্য লাইনের শেষের ধ্বনির মিলকে বলা হয় অন্ত্যমিল। অন্ত্যানুপ্রাসও অন্ত্যমিল। পঙ্‌ক্তির মধ্যে বা ভেতরে যে মিল, তাকে মধ্যমিল বলা হয়। পর্ব বা পদের শেষেও মিলের ব্যবহার হয়Ñ দ্বিপদী ত্রিপদী কবিতা এর উদাহরণ। অনুপ্রাসকে ধ্বনির পুনরাবৃত্তি ধরা হলেও এটিও এক ধরনের মিল। যেমন :
আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারীর
আর ছুতোরের,
মুটে মুজুরের
(আমি কবি যত কামারের/ প্রেমেন্দ্র মিত্র)

পরপর দুই পঙ্‌ক্তির মিল, পরপর পঙ্‌ক্তির মিল, দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির সঙ্গে চতুর্থ পঙ্‌ক্তির বা আরো দূরের মিল এ ধরনের নানারকম মিল কবিতায় দেখা য়ায়। পরপর পঙ্‌ক্তির মিলকে পবিত্র সরকার বলেছেন একান্তর বা Alternate মিল। সনেটের স্তবকের মিল বিন্যাস একান্তর মিল যেমন- ক-খ ক-খ… অথবা দ্বিচরণ মিল যেমন- ক-খ-খ-ক… এবং শেষ দুই পঙ্‌ক্তিতে জ-জ মিল দেওয়া হয়।

কবিতায় মিল দেওয়া সহজ কাজ নয়। এ জন্য ছন্দ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকা প্রয়োজন। মিলের মাধ্যমে যে ধ্বনিসাম্য ঘটে, তার দোলা কবিতার শরীর থেকে উৎসারিত। ছন্দজ্ঞান না থাকলে মিলের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা থাকে। কবিতা যেমন ভাষার নতুনত্ব চায়, মিলের দাবিও তেমন। বহু ব্যবহারে জীর্ণ ও সাধারণ মিল পাঠককে আনন্দ দিতে পারে না। এতে বরং কবির কাব্যবোধ ও সক্ষমতায় দৈন্যের প্রকাশ ঘটে। কাব্যে উৎকৃষ্ট মিলকে পরিপূর্ণ, যথাযথ মিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অন্ত্যমিলের কয়েকটি উদাহরণ :
আজি এ প্রভাতের রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ’পর
(নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এ তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলে সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ কালের পাতায়।
(সোনালী কাবিন/ আল মাহমুদ)

শরতের সমারোহ প্রকাণ্ড প্রান্তরে
চক্রবালে শুভ্র মেষপাল
নিশ্চিন্তে বেড়াত চরে। কদাচিৎ খোঁড়ায় রাখাল
স্নিগ্ধ বনান্তরে
(নৌকাডুবি/ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)

মিল বেঝার জন্য স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির সম্পর্ক বোঝাও দরকার। কোথাও দেখা যায় স্বরধ্বনির মিল ঘটছে, কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনির মিল ঘটছে না। যেমন ‘হলো’ (হ্‌+অ+ল্‌+ও) সঙ্গে যদি মেলো’র (ম্‌+এ+ল্‌+ও) মিল দেওয়া হয়, ধ্বনি বিশ্নেষণ করলে দেখা যাচ্ছে শেষের স্বরধ্বনি (ও ধ্বনি) মিল থাকলেও শুরুর ব্যঞ্জনধ্বনিতে মিল নেই। অর্থাৎ শেষের স্বরধ্বনির মিল থাকলেও ব্যঞ্জনের স্বরান্তে (একটিতে অ ধ্বনি, অন্যটিতে এ ধ্বনি) মিল নেই। আবার কখনও দেখা যায় স্বরধ্বনির মিল নেই, কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনিতে আংশিক মিল আছে। যেমনÑ বন্ধুর (ব্‌+ও+ন্‌+ধ্‌+উ+র্ ) সঙ্গে বন্দর (ব্‌+অ+ন্‌+দ্‌+র্ ) এ ধরনের মিল প্রায়মিল বা অর্ধমিল। অনেকেই এ ধরনের মিল দিয়ে থাকেন। দেখা যায় যে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির দিকে লক্ষ্য না রেখেই শুধু কানকে নির্ভর করে কবিরা মিলের শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা ও স্বাধীনতা নিতে থাকেন। নিচের উদ্ধৃতি দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অরণ্য ও আসন্ন শব্দে মিল স্থাপন সম্ভব নয়। কিন্তু এ দুটি শব্দের শেষে অ ধ্বনি স্বরধ্বনি বিধায় এ দুটো শব্দে সৃষ্ট ধ্বনিগত পুনরাবর্তনও ঘটছে, যা অর্ধমিলের উদাহরণ :

সামনে তার যুদ্ধ। দূরে
আঁধার এক অরণ্য
ঝাপসা ধুলোর পর্দা ছিঁড়ে
আসন্ন।

(একটি রূপকথা/বুদ্ধদেব বসুকৃত বরিস পাস্টেরনাকের কবিতার অনুবাদ)

কবিতায় অন্ত্যমিল ব্যবহারে বৈচিত্র্যের চমৎকার উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের দুঃসময় কবিতাটি। এ কবিতাটি ৪০ লাইনের এবং পাঁচটি স্তবকে বিন্যস্ত। একে প্রতিটি স্তবকের প্রথম চার লাইনে দুই লাইন পরপর মিল। প্রতিটি স্তবকের পঞ্চম লাইনে ঢাকা, শাখা, বাঁকা, মাখা, আঁকা এভাবে অন্ত্যমিল দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিটি স্তবকের শেষে পঞ্চম লাইনের সঙ্গে ‘তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা’ এ দুটি পঙ্‌ক্তি ব্যবহার করে পুনরাবৃত্তিমূলক মিল দেওয়া হয়েছে।