কবি আজিজুর রহমান স্মৃতির পাতা থেকে

রওশন হাসান

আমার ছেলেবেলায় খুব কাছে থেকে দেখা আমাদের পারিবারিক আত্মীয় একজন কবির কথা মনে পড়ে । আমি তখন স্কুলের ছাত্রী। কবি আজিজুর রহমানের বাড়ির সংলগ্ন ভাড়া বাড়িতে আমরা থাকতাম। মায়ের কাছে জেনেছিলাম তাঁর আত্মীয় কুষ্টিয়ার একজন কবি আমাদের পাশের বাড়িতে বসবাস করছেন। কবিকে সে বছরই দেখতে গিয়েছিলাম আমার মায়ের সঙ্গে কবির বাড়ি ২/২ হুমায়ুন রোড, মহম্মদপুরে। তাঁকে দেখেছিলাম রোগাক্রান্ত, স্মৃতিভ্রষ্ট এবং শয্যাশায়ী। সে বছরই আমরা বরিশালের পিরোজপুর থেকে ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়েছিলাম। সরকারী চাকরিতে পদোন্নতির কারণে আমার বাবা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের উপসচিব পদে ঢাকায় সবে যোগদান করেছেন। কবির পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সখ্য গড়ে উঠেছিল আত্মীয়তার কারণে। আমার মায়ের পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন কবিপত্নী ফজিলাতুন্নেসা। আমাদের পরিবারের সঙ্গে যখন কবিপতœীর সাক্ষাৎ হয় তখন তিনি এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছিলেন। একটি চোখ দিয়েই দৈনন্দিন কাজ সমাধা করতেন। শুনেছিলাম অর্থাভাবে চোখের অপারেশন করতে পারেননি। আজও মনে পড়ে লিভিং রুমে ঢুকতেই পুরনো সেগুন কাঠের আলমারীতে অজস্র বই স্তুপাকারে সাজিয়ে রাখার স্মৃতি । বয়সগত কারণে কবির প্রতি ও তাঁর গ্রন্থের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কবিপত্নী, কবিকন্যা বেলী আপা, কবিপুত্র বাচ্চু ভাই, ঝন্টু ভাই আমাকে ও আমার ছোট ভাইবোনদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে যে বাড়িটিতে কবি আজিজুর রহমান বহু বছর ধরে ভাড়া থাকতেন কবির মৃত্যুর পর সে বাড়িটি বাংলাদেশ সরকার কবি পরিবারকে দান করেছিলেন। এই বাড়িটি পরবর্তীতে কবি পরিবার কর্তৃক কবির স্মৃতি সংরক্ষণস্বরূপ ‘কবি আজিজুর রহমান সাহিত্য পরিষদ’ নামে প্রাতিষ্ঠানিক নামাংকিত করা হয় । একুশে পদকপ্রাপ্ত এই মহান কবির সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরছি।
জন্ম ও পরিবার : ১৮ অক্টোবর , ১৯১৪ সালে খ্যাতনামা গীতিকার ও বেতার ব্যক্তিত্ব কবি আজিজুর রহমান কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম বশির উদ্দিন প্রামানিক ও মাতার নাম সবুরুন্নেছা। গড়াই নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাঁকে সব সময় মোহিত করে রাখত। ১৩ বছর বয়সে, ১৯২৭ সালে তিনি পিতাকে হারান। উচ্চশিক্ষা লাভের ভাগ্য না থাকলেও প্রবল ইচ্ছা ও অনুসন্ধিৎসার ফলে বহু বিষয়ক পুস্তকাদি স্বগৃহে পাঠ করে তিনি একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তিতে পরিণত হন।
বৈবাহিক জীবন: ১৯৩১ সালে ১৭ বছর বয়সে কবি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরি গ্রামের এজহার শিকদারের মেয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে বিয়ে করেন। তিনি ৩ ছেলে ৪ মেয়ের জনক ছিলেন।
কর্মজীবন: কবি আজিজুর রহমান ঢাকা বেতারের নিজস্ব শিল্পী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত এবং পরে নিয়মিতভাবে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বেতারে চাকরিতে বহাল ছিলেন। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত দৈনিক পয়গামের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি তাঁর পিতামহ চাঁদ প্রামানিকের নামে হরিপুর গ্রামে গড়ে তোলেন চাঁদ স্মৃতি পাঠাগার। এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বইয়ের খোঁজে আসতেন এই পাঠাগারে। তার সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল প্রবল। তিনি একাধারে কুষ্টিয়া হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া (নদীয়া) ফুড কমিটির সেক্রেটারি, বেঞ্চ অ্যান্ড কোর্ট ডিভিশনের চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া জেলা বোর্ড ও ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্যের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় মুসলিম ছাত্র আন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও আজিজুর রহমানের কিছু পরিচয় আছে। অধুনালুপ্ত দৈনিক পয়গম পত্রিকায় ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন তিনি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কিশোর মাসিক ‘আলপনী’রও সম্পাদক ছিলেন তিনি। কবি আজিজুর রহমানই প্রথম তার জন্মস্থান কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস রচনায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কুষ্টিয়া ইতিহাসের বহু মূল্যবান তথ্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় তিনি কুষ্টিয়ার ইতিহাস রচনা সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। গীতিকার হিসেবে কবি আজিজুর রহমান এদেশের এক বিরল প্রতিভা ছিলেন। ঢাকার প্রায় প্রখ্যাত সুরকাররা যেমন ঢীীঢআজিজুর রহমানের গানে সুর দিয়েছেন তেমন তাঁর গানও গেয়েছেন খ্যাতনামা বাংলাদেশের প্রায় সব শিল্পীই। চলচ্চিত্রের জন্য তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, আগন্তুক প্রভৃতি ছায়াছবিতে তিনি গান রচনা করেছেন। প্রধানত গানের ফসলেই তার শিল্পের গোলা ভরেছে।
সাহিত্যচর্চা: তিরিশের দশকে আজিজুর রহমান সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ধনাঢ্য পিতার সন্তান সাহিত্যের আকর্ষণে বিষয় সম্পত্তি পেছনে রেখে কলকাতা-ঢাকা নগরীতে উদ্বাস্তুর জীবন কাটিয়েছেন। কৈশোরে পারিবারিক পরিবেশেই সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটে। পুঁথিপাঠ, কবিগান, মরমিয়া গীতি, যাত্রাভিনয় ইত্যাদি উপভোগ করে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হন এবং প্রবলভাবে সাহিত্যচর্চায় আতœনিয়োগ করেন। সাহিত্যচর্চা শুরুর আগে নাটকে অভিনয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল বেশি। তিনি গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল। নাট্যদলটি নাটক মঞ্চস্থ করত শিলাইদহের ঠাকুর বাড়িতে। এ কাজের জন্য সে সময় কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সে কালের বিশিষ্ট অভিনেতা ধীরেন দত্ত, উপেশ ঠাকুরসহ বিভিন্ন নামিদামি অভিনেতারা অংশগ্রহণ করতেন তার নাট্যদলে। সমাজসেবায় কবি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ। ১৯৫৪ সালে কবি আজিজুর রহমান ঢাকা বেতারে গীতিকার হিসেবে অনুমোদন পান। বেতারের সাথে যোগাযোগ কবি আজিজুর রহমানের সাহিত্যিক জীবনেরএক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কবি আজিজুর রহমান কবিতা দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও গান রচনার মধ্যে তার প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। তিনি প্রায় ৩ হাজার গান লিখেছেন, যা আজও আমাদের দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ঢাকায় গিয়ে তিনি কবি ফররুখ আহমদের সহায়তায় বিভিন্ন শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকদের সাথে পরিচিত হন। এসময় কবি ফররুখ আহমদ তাকে ঢাকা বেতারে নিয়ে যান।
কবিতাসমূহ: তিনি ৩ শতাধিক কবিতা রচনা করেছেন। তার মধ্যে নৈশনগরী, মহানগরী, সান্ধ্যশহর, ফেরিওয়ালা, ফুটপাত, তেরশপঞ্চাশ, সোয়ারীঘাটের সন্ধ্যা, বুড়িগঙ্গার তীরে, পহেলা আষাঢ়, ঢাকাই রজনী, মোয়াজ্জিন, পরাণপিয়া, উল্লেখযোগ্য। এ কবিতাগুলো একসময় নবযুগ, নবশক্তি, আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবারের চিঠি, সওগাত, মোহাম্মাদী, আজাদ, বুলবুল পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো।
গান রচনা: কবি আজিজুর রহমান ৩ সহস্রাধিক গান লিখেছেন। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ভবের নাট্যশালায় মানুষ চেনা দায় রে/কারো মনে তুমি দিও না আঘাত, সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে / আকাশের ঐ মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা, নাই বা তুমি এলে,/ পৃথিবীর এই পান্থশালায়, হায় পথ ভোলা কবি,/ আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি,/ বুঝি না মন যে দোলে বাঁশিরও সুরে,/ দেখ ভেবে তুই মন, আপন চেয়ে পর ভালো,/ পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা আমারই দেশ ভাই রে প্রভৃতি।
গ্রন্থসমূহ: ডাইনোসরের রাজ্যে (১৯৬২) জীবজন্তুরকথা (১৯৬২) ছুটির দিনে (১৯৬৩)এই দেশ এই মাটি (১৯৭০) উপলক্ষের গান (১৯৭০)। ‘ডাইনোসরের রাজ্যে’ ‘জীবজন্তুর কথা’ ‘আবহাওয়ার পয়লা কেতাব’ তার উল্লেখযোগ্য অনুবাদগ্রন্থ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থপঞ্জির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘আজাদীর বীর সেনানী : কুমারখালীর কাজী মিয়াজান’, পাঁচমিশালী গানের সংকলন ‘উপলক্ষের গান’ দেশাত্মবোধক নিজস্ব গানের সংকলন ‘এই মাটি এই মন’, ‘ছুটির দিনে’। ব্যক্তিগত জীবনে সৌজন্য, ভদ্রতা ও আতিথেয়তায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী মানুষ। তার সান্নিধ্যে ও সংস্পর্শে যারা এসেছেন তারা একথা অকপটে স্বীকার করেন। বই পুস্তকাদি সংগ্রহ করা তাঁর জীবনের নেশা ছিল।
শেষ জীবন: অসুস্থতার কারণে ১৯৭৮ সালের পর কবির হাতে তেমন আর কলম ওঠেনি। একাকী বিছানায় শুয়ে দিন কেটেছে তাঁর। সে সময় তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখেছিলেন ‘পৃথিবীর এই পান্থশালায়, হায় পথ ভোলা কবি, জলের লেখায় বালুকাবেলায়, মিছে এঁকে গেলে ছবি’। এটাই ছিল কবির লেখা শেষ গান। অর্থাভাবে সুচিকিৎসা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। ১৯৭৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কবি আজিজুর রহমান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবিকে ভর্তি করা হয় তৎকালীন ঢাকার পিজি হাসপাতালে। মাত্র তিন দিন পর মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১২ই সেপ্টেম্বর তিরিশ দশকের বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, কুষ্টিয়ার গৌরব বহুমুখী প্রতিভাধারী কবি আজিজুর রহমান শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির ইচ্ছানুযায়ী তাঁর গ্রামের বাড়ি হাটস হরিশপুর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। বাংলা সাহিত্যে স্বনামধন্য অজস্র কবির পাশে চিরস্মরণীয় একটি নাম কবি আজিজুর রহমান।
লেখক, কবি নিউইয়র্ক।