কবি দিলওয়ার গণমানুষের কবি

আব্দুল কাইউম আনোয়ার :

বাংলাদেশে বাংলা কবিতার রাজ্যে দিলওয়ার একজনই, যিনি কবিতার ভান্ডারি। কবিতাপ্রেমিক সকল বাংলাদেশি জানেন এই নামটি। অর্ধশতাব্দীজুড়ে বাংলা কাব্যের উর্বর জমিতে যার কর্ষণ, সেই কাব্যচাষির পাঁচ অক্ষরের নামটি বাংলার কাব্য বাগানে রক্ত গোলাপের মতো ফুটে আছে বৈকি।

কবিদের জাত একই, তবে ধারা ভিন্ন। কবি দিলওয়ার কোন ধারার কবি-এ প্রশ্ন জাগতে পারে মনে। ২০০৭ সালে কবি একবার এসেছিলেন নিউইয়র্কে। একই সালের ৮ জুন ‘বাংলা পত্রিকা’ কবির আগমনের সংবাদ ছেপেছিল। শুধু আগমন-বার্তাই নয়, কবির সঙ্গে সাপ্তাহিকীর সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের সাক্ষাৎকারটিও ছাপা হয়েছিল।

কবির দেওয়া সেই ভাষ্যে বাংলাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতির দার্শনিক তত্ত্ব ও তথ্যের ইঙ্গিত ছিল। বহু বছর ধরে প্রবাসে আছি বলে স্বদেশের কবি ও কবিতার সংস্পর্শ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। একসময়কার ঘন সান্নিধ্যের এই প্রবীণ কবির মুখে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির কথা শুনে নিজের চিন্তাকে সংহত করার সুযোগ পেলাম। এর জন্য কবিকে এবং পত্রিকার সম্পাদককে অসংখ্য সাধুবাদ জানাই।

যে প্রসঙ্গে আজকে আমার এই লেখার অবতারণা তা হচ্ছে, সাংবাদিকদের দেওয়া ‘গণমানুষের কবি দিলওয়ার’, এই ‘গণমানুষ’ শব্দটির অর্থ ও প্রয়োগের তাৎপর্য কী, তার ব্যাখ্যা দেওয়া। গণ শব্দের আভিধানিক অর্থ সমূহ, সমষ্টি, শ্রেণি, দল, সম্প্রদায় ইত্যাদি। শৈলেন্দ্র বিশ্বাস সংকলিত ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’-এ গণ-আন্দোলনে ব্যবহৃত গণ শব্দের অর্থ জনসাধারণ বলে উল্লেখিত আছে। এর মানে গণ শব্দই সাধারণ মানুষের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

কিন্তু গণের সঙ্গে মানুষ শব্দের সমাস অভিধানে পাওয়া যায় না। কবি দিলওয়ারকে গণমানুষের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করার পেছনে যদি জনসাধারণের কবি বোঝানো হয়, তবে আপত্তির কিছু নেই। তবে সেখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্নটি হলো কবি দিলওয়ারের কাব্যকর্ম কি সমাজের ধনী-দরিদ্র সকল শ্রেণির মানুষের কথা নাকি বিশেষ কোনো শ্রেণির কথা বলে? কবিরা মূলত সমাজের সকল মানুষের জন্যই কবিতা লেখেন। তাদের বাসনা থাকে আকাশচুম্বী। তারা চান তাদের কবিতার মোহময় ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী। যত বেশি পাঠক তাদের কবিতার রস আস্বাদন করবে, কবিরা ততই তৃপ্ত হন। তাদের প্রেরণার উৎস পাঠকই।

কবি দিলওয়ারের কাব্য-প্রেরণার উৎস অন্য কবিদের থেকে খানিকটা স্বতন্ত্র। সমাজের ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু সকল সম্প্রদায়ের পাঠকের উপাদেয় কাব্য খোরাক যদিও তার কবিতায় আছে কিন্তু বিষয়বস্তু চয়নে নিচু সম্প্রদায় অর্থাৎ সমাজের নিতান্ত সাধারণ মানুষের কথাই মূলত প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতার ছত্রে ছত্রে। এখন কথা হলো কবি দিলওয়ারের উপযুক্ত আখ্যা বা উপাধি তাহলে কী হবে? তিনি কি অন্য কোনো কবির সঙ্গে তুলনীয়? নজরুল যেমন ‘বিদ্রোহী’, সুকান্ত যেমন ‘সমাজ বিপ্লবী’ কিংবা জীবনানন্দ ‘ষড় ইন্দ্রিয়ের’ কবি ইত্যাদি। না, তাকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করা সমীচীন নয়। কারণ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত কবি তার নিজস্ব সৃষ্টিতে স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য কবিকে স্বীকৃতি দেয় পাঠকসমাজে। তাদের চিন্তার ধারা ও ভাষাশৈলীই আলাদা করে অন্যের থেকে।

কবি দিলওয়ার ছিলেন বাংলাদেশের প্রবীণতম কবিদের একজন। যে কালে এই কবির কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল, বিশ্বব্যাপী তখন কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বের প্রচার ও প্রসার তুঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয় শিবিরের প্রবক্তারা জোর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে তাদের তন্ত্রের তাত্ত্বিক যৌক্তিকতা দৃঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সুমেরু থেকে কুমেরুর মধ্যকার উভয় গোলার্ধে তীক্ষèধার বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী মানবকুল নতুন সব তন্ত্রে-মন্ত্রে নিমজ্জিত রেখেছিলেন নিজেদের।

নতুন তন্ত্র হিসেবে সমাজতন্ত্রের জাদুকরি প্রভাববলয়কে উপেক্ষা করা কঠিন ছিল বৈকি। তাইতো সূক্ষ্ম দৃষ্টির সচেতন কবিরা অনেকেই প্রভাবিত হয়েছিলেন সেই আলোকিত তন্ত্রের মন্ত্রে। কবি দিলওয়ারের ওপরও সেই আলোর ছটা বিচ্ছুরিত হয়েছিল। তার কবিতায় তাই পাই সাম্যের জয়গান।

কবির চিন্তা-চেতনায় তখন কেবলই সাধারণ মানুষ ও মানুষের অসহায়ত্বের আকুতি। নিজে যদি একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম না নিয়ে রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাতেন, তবে হয়তো তার মস্তিষ্কের উর্বর ভূমিতে বায়রন-শেলি কিংবা রবি ঠাকুরের মতো ভিন্ন ধারার কাব্যকিটেরা বিচরণ করত। কিন্তু কবি দিলওয়ারের বেলায় তা হয়নি, হওয়ার নয়।

নিজের চারপাশের জরাজীর্ণতাকে, শোকের মাতমকে উপেক্ষা করতে পারেনি তার কাব্যমানস। তার সৃষ্টির সর্বত্র সাধারণ মানুষের কথা। সকাল-সন্ধ্যা তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, কর্ম ও বেকারত্ব কবির কবিত্বকে মাতিয়ে তুলেছে। কবির কবিতায় পাঠকেরা শুনতে পায় সেই সব মানুষের ঐকতান।

অনুজ অনুসারী কিংবা অকৃত্রিম ভক্ত হিসেবে কবিকে যতটুকু কাছে থেকে দেখেছি বা বোঝার চেষ্টা করেছি, মনে হয়েছে এই কবি তার স্বকীয়তায় তিনি নিজেই ভাস্বর। সেই স্বকীয়তা কবিতার আকালের কালেও কাব্যপুষ্টি জুগিয়েছে স্বদেশে।

গণমানুষের কবি দিলওয়ারের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি। মৃত্যুবরণ করেন ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর।