এম এস হক :
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গন ততই সরগরম হয়ে উঠছে। বিশেষত, ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলীয় সর্বস্তরের নেতাকর্মী-শুভানুধ্যায়ী এবং অত্যুৎসাহী ভোটারদের সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিজয়ী বাইডেন-হ্যারিসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার বিশদ খতিয়ান উপস্থাপন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে।
মূলত ২০২০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলতে গেলে এককভাবেই লড়েছিলেন আমেরিকার পুরো ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, অভিবাসী সম্প্রদায় এবং অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের পর থেকেই বিজিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একের পর মামলা-মোকদ্দমা, আইন-আদালতের গণ্ডি মাড়াতে হচ্ছে হরহামেশা। অন্যদিকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে খুব সাফল্য অর্জন করেছেন এহেন দাবি করার সুযোগও একেবারেই সীমিত।
সীমান্ত নিরাপত্তাপ্রাচীর নির্মাণের স্থলে সীমান্ত ব্রিজ নির্মাণ, অবৈধদের বৈধতা প্রদানের লক্ষ্যে বিদ্যমান অভিবাসন আইনের ঢালাও সংস্কার, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নির্মূল, সহিংসতার মূলোচ্ছেদ, শ্রেণিবৈষম্য বিলোপ, আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বাইডেন-হ্যারিসের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী বললে তেমন অতিশয়োক্তি হবে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি, ম্যাস শুটিং, বেকারত্ব ইত্যাদি বাইডেন প্রশাসনকে চরম বেকায়দার মুখে ঠেলে দিয়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনেও বাইডেন প্রশাসন হালে তেমন পানি পায়নি।
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানিও না কমে খানিকটা হলেও বেড়েছে। এমনতর বাস্তবতায় মমস ডিমান্ড অ্যাকশন লেখা সংবলিত লেবাসধারী সাম্প্রতিক স্কুল শুটিংয়ের শিকার ডেনভার হাইস্কুলের শিক্ষার্থী এবং ২০১২ সালে অরোরা থিয়েটারের ম্যাস কিলিংয়ে নিহত মহিলার অভিভাবকদের সরব উপস্থিতিতে কলোরাডোর গভর্নর জারেড পলিজ ২৮ এপ্রিল বন্দুক নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট চারটি বিলে স্বাক্ষর করেছেন। পক্ষান্তরে ডেমোক্র্যাটিক দলীয় গভর্নর পলিজের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট বিলগুলোতে স্বাক্ষরের কয়েক দিন আগেই ইউএস সুপ্রিম কোর্ট সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট রাইটস সম্প্রসারণের সপক্ষে রুলিং দিয়ে বাইডেন প্রশাসনের জন্য লেজে-গোবরে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ১৯-২০ নভেম্বর কলোরাডোর স্প্রিংসের ক্লাব কিউ নামক এলজিবিটিকিউ (লেসবিয়ান-গে-বাইসেক্সুয়াল-ট্রান্সজেন্ডার) নৈশ ক্লাবে এক বর্বরোচিত আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় পাঁচজন নিহত এবং ২৬ জন আহত হয়েছিল। এর আগে ১৯৯৯ সালের ২০ এপ্রিল কলোরাডোর কলম্বাইন হাইস্কুলে অপর এক আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় হামলাকারীসহ ১৫ জন নিহত এবং ২৪ জন গুরুতর আহত হয়েছিল। সম্প্রতি কলোরাডোসহ সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি, আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে নির্বিচারে মানুষ খুন বা ম্যাস শুটিং বেড়েই চলেছে।
তাই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং সুদীর্ঘকাল ধরে আইনগত সুরক্ষা পাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদনকারী কলকারখানার বিরুদ্ধে সহিংসতার শিকারদের ক্ষতিপূরণ মামলা রুজুর পন্থা উদ্ভাবনের লক্ষ্যেই গভর্নর পলিজ গান কন্ট্রোল বিলগুলোতে স্বাক্ষর করেছেন বলে জানা যায়। গভর্নর পলিজ স্বাক্ষরিত বিলের আওতায় আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতার বয়স সর্বনিম্ন ১৮ বছরের স্থলে ২১ বছর লাগবে এবং বন্দুক ক্রয়ের পর ক্রেতার অতীত ইতিহাস যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তিন দিন শেষে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করা হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতার সর্বনিম্ন বিষয় ১৮ বছরের স্থলে ২১ বছর করায় তিন বছর আগে কার্যকর হওয়া ক্যালিফোর্নিয়া, ডেলাওয়ার, নিউজার্সি ও নিউইয়র্ক এবং হাওয়াই ও রোড আইল্যান্ডসহ অপর কয়েকটি স্টেটের তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে কলোরাডো।
স্মর্তব্য, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই আইনটির প্রবক্তারা বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে যত টিনএজার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক প্রাণ হারিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায়। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ অ্যাক্টিভিস্ট, বিলগুলোর উদ্যোক্তা ডেমোক্র্যাটিক দলীয় সিনেট প্রেসিডেন্ট স্টিভ ফেনবার্গ এবং স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠানের উৎসুক জনতার উদ্দেশে গভর্নর পলিজ বলেন, আমাদের কমিউনিটি, বিদ্যালয়, গ্রোসারি স্টোর এবং নাইট ক্লাবসহ সর্বক্ষেত্রে এবং স্তরে কলোরাডোর জনগণ যাবতীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। এ সময় বিলের সমর্থক আইনপ্রণেতা, ভিকটিমদের স্বজন ও জনগণ অশ্রুসিক্ত নয়নে উদ্বাহু বাড়িয়ে গভর্নরের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে সিনেটর প্রেসিডেন্ট ফেনবার্গ বলেন, প্রতিটি ম্যাস শুটিংয়ের পরপরই রিপাবলিকান এবং গান কন্ট্রোল প্রতিপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের সপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। অথচ সময়ের অগ্রযাত্রায় তারা বোল পাল্টে আগ্নেয়াস্ত্রের সপক্ষে অবস্থান নেন। তিনি বলেন, আমরা যে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি তা নয়। মেঘে মেঘে বেলা বহুদূর গড়িয়ে গেছে। আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে নিহতদের আত্মা গুমরে গুমরে কাঁদছে। আগ্নেয়াস্ত্র হামলা প্রতিরোধের জন্য আমাদের আরও অনেক করণীয় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ফেনবার্গ।
গভর্নর স্বাক্ষরিত তৃতীয় বিলটি স্টেটের বিদ্যমান রেড ফ্ল্যাগ ল’কে (লাল পতাকা আইন) শক্তিশালী করবে। আত্মহত্যা কিংবা আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে অন্যের ওপর হামলা চালানোর আগেই আগ্নেয়াস্ত্রধারীর অস্ত্র জব্দ করার মুখ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রণয়ন করা হয়েছে রেড ফ্ল্যাগ ল’ তথা চরম ঝুঁকি প্রতিরক্ষা আদেশ (এক্সট্রিম রিস্ক প্রটেকশন অর্ডার)। কথিত আইনটি উঠতি বয়সী এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে কর্মসূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত চিকিৎসক, মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী এবং শিক্ষকগণকে কোনো আগ্নেয়াস্ত্রধারীর আগ্নেয়াস্ত্র সাময়িকভাবে অপসারণের লক্ষ্যে জজ বা বিচারকের নিকট আবেদন করার বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করবে। ইতিপূর্বে পরিবারের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা এ ধরনের আবেদন জানানোর ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন।
উল্লেখ্য, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২১ সালে জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যার তালিকার ষষ্ঠ স্থান দখল করেছিল কলোরাডো এবং এ বছর ওই স্টেটে ১ হাজার ৪০০ আত্মহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এদিকে চারটি আত্মহত্যার বিষয়াদি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ শেষে র্যান্ড করপোরেশন ওয়েটিং পিরিয়ডের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা হ্রাসের প্রবণতার যোগসূত্র দেখতে পেয়েছে। এর বিরোধিতাকারীরা বলেন, আত্মরক্ষার চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরাও ওই ব্যবস্থায় সময়মতো আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবেন না। এ ছাড়া রকি মাউন্টেন গান ওনারসের নির্বাহী পরিচালক টেয়লর রোডস বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেতারা বিশেষ বয়সীদের বৈষম্যের শিকারে পরিণত করেছেন।
রিপাবলিকানরা সংখ্যালঘু নেতা রিপ্রেজেনটেটিভ মাইক লিঞ্চ গভর্নর পলিজ স্বাক্ষরিত বিলগুলোকে সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট রাইটস (দ্বিতীয় সংশোধনী অধিকারের মুখে প্রচণ্ড চপেটাঘাত) হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরাও জাতীয় পর্যায়ে সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট পরিপন্থী স্টেটের তালিকাভুক্ত হচ্ছি। লিঞ্চ আরও বলেন, কলোরাডো অঙ্গরাজ্যজুড়ে অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধির পটভূমিতে গভর্নর স্বাক্ষরিত বিল এবং ডেমোক্র্যাটদের প্রণীত আইনগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের আত্মরক্ষার অধিকার ছিনিয়ে নেবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে সুইং ডিস্ট্রিক্টগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের অভিলাষ চরিতার্থের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
মাইক লিঞ্চ বলেন, স্বাক্ষরিত বিলটি সাময়িকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ হওয়ার আশঙ্কাবশে জনগণ, বিশেষত সামরিক ভেটারনদের মেডিক্যাল ডাক্তার কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের অকপটে কথা বলতে নিরুৎসাহিত করবে। স্মর্তব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয়ের তিন দিন পর তা সরবরাহের বিধান ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, হাওয়াইসহ অপর আটটি স্টেটে চালু রয়েছে এবং কলোরাডো এর তালিকাভুক্ত হতে চলেছে।
গভর্নর পলিজ স্বাক্ষরিত চতুর্থ বিলটি সুদীর্ঘকাল যাবৎ আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন কারখানাগুলোকে আইনি সুরক্ষাদাতা বিধিবিধানের ইতি ঘটাবে। ফলে স্মরণাতীতকাল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় নিহতদের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ মামলা রুজু বা আদায়ের দেনদরবারের ব্যর্থতার ইতি ঘটবে এবং তারা প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ পাবেন।
স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠানে কলোরাডোর অ্যাটর্নি জেনারেল ফিল উইজার নতুন আইনগুলোকে মাদারস অ্যাগেইনস্ট ড্রাঙ্ক ড্রাইভিং, মমস ডিমান্ড অ্যাকশন ইত্যাদি নিরাপদ যানবাহন নীতিমালার অনুপূরক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর গান রাইটস অ্যাডভোকেটরা বিলগুলো বাতিল প্রচেষ্টার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য আগ্নেয়াস্ত্রের পৃষ্ঠপোষকেরা অন্যান্য স্টেটে বয়স এবং তিন দিনের বিলম্ব সংশ্লিষ্ট দুটি বিলের বিরুদ্ধে আদালতে যথারীতি মামলা রুজু করেছেন। নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত অভিমত, কলোরাডোসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে গান কন্ট্রোল আইন সঠিকভাবে কার্যকর এবং ম্যাস শুটিং, সুইসাইডিং নিয়ন্ত্রণ করা গেলে তা বাইডেনের আগামী নির্বাচনী বৈতরণি উতরাতে যথেষ্ট সহায়ক হবে।