কষ্ট

গল্প

মোসাদ্দেক চৌধুরী আবেদ :

জীবন কত প্রকার ও কী কী? মাস্টার মশাইয়ের এমন প্রশ্নের উত্তর লিখতে হলে বোধ করি আমিই একশতে একশই পাব। জীবন যে কত কষ্টের, তা আমি হারে হারে দেখেছি। কষ্ট করতে করতে মরে বেঁচে আছি। কষ্ট করতে করতে কত যে কষ্ট পেয়েছি, সে কষ্ট আর কাউকে বোঝাতে পারিনি আমি। কষ্ট আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, তা আমি দেখছি। এখন পর্যন্ত কষ্ট আমাকে ছাড়ল না আর।
কষ্ট আমাকে কষ্ট দিয়ে বোধ করি আনন্দই পায়। কষ্ট আমাকে ছাড়তে চায় না আর। কষ্ট পেতে পেতে দেহটা সয়ে গেছে আমার। এখন কষ্ট পেয়ে আর কষ্ট মনে হয় না আমার। কষ্টটাকে আলিঙ্গন করতে পারি আমি। আমার কাছে মনে হয়, জীবনটাই তো এক কষ্টের। এ পৃথিবীতে এসে কষ্ট পেতে পেতে একসময় শেষ হয়ে যায়। এখন আর কষ্টের হিসাব-নিকাশ করে দেখি না কখনো। কষ্টের জ্বালা কষ্ট করতে করতে শেষ করে দিলাম। আপনজনেরা, কাজের মানুষেরা একটুও বুঝতে চাইল না আমি কষ্ট পাচ্ছি কি না। আমি যদি কষ্ট পাই, তাদের কী আসে-যায়। তাদের তো সেই মন নেই অন্যকে বোঝার। আপনজন ও বন্ধুরা এখন কে কোথায়, তাও জানি না তারা কোথায়।

কাজের বন্ধুরা এখন আর আমার নয়। আস্তে আস্তে তারা দূরে সরে রয়। আপন বলতে এখন আমার আর কিছুই নেই। কেউ নেই আর। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে কাঁদি। আমার কষ্ট আমার বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখি। এভাবেই আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কল্পনায় আমি দেখতে থাকি। আমি সবই বুঝি। বলি না কিছুই। কেউ বলে, কেউ বলে না। এটাই পার্থক্য শুধু। আমি তাদেরই দলে হয়তো। মানুষ অল্প দুঃখে কাঁদে, বেশি দুঃখে হাসে। এ পৃথিবীতে মানুষ কত একা, খুব কাছ থেকে দেখেছি। আহা! সুখের দরজার সব তালা যে বন্ধ আমার জন্য।

বিশ্বাস করুন, যা সত্যি তা-ই আমি বলছি। জীবনের স্মৃতি থেকে কত কিছু চলে গেছে। দিনে দিনে তা আবার স্মৃতিগর্ভে ভেসে ওঠে। কষ্ট পেলে বড় বোনের ছবিই ভেসে ওঠে। ওনার মুখে আমার মায়ের ছবি দেখতে পাই। কত দিন মায়ের আদর পাই না। ওনার আদর পেয়ে আমার চোখ ভিজে যায়। প্রবাসে বসে আমার সেই বোনটিকে দেখতে ইচ্ছে করে। আর মায়ের জন্য আমার মন গলতে থাকে। আহা! আমার মায়ের খোঁপায় কত বড় চুল। মায়ের মুখ হারিয়ে গেল কত যুগ।

আজকাল ভালোবাসা, মায়া-মমতা, বন্ধন যেন সব মুছে গেছে। জীবন কোনোমতে কাটছে। নিজের ভালোবাসার মায়া-মমতার পৃথিবীটা যেন ভেঙে যাচ্ছে। কীভাবে যে নির্ঘুম রাত কেটে যায় আমার, জানি না। নিজের জীবনের জমাখাতার হিসাব আর রাখতে পারলাম না।
সবাই যার যার মতো। জীবনের সব স্বাদ-আহ্লাদ, সুখ, প্রেম-ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝে আমার বুকটা ব্যথা করে ওঠে। শক্ত করে চেপে ধরি, আর পারি না।

এখন কারও সঙ্গে নিজেকে আর তুলনা করি না। কখন কী হয় নিজেও তা জানি না। নীরব বেদনা, কষ্ট আর অশ্রুর মুখোমুখি হয়েছি বারবার। এভাবেই নিজেকে বিসর্জন দিলাম। পরে দেখলাম, এভাবেই একসময় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করলাম। শরীর ও মনের ভেতর মস্ত বড় একটা চাপ।
ছোটবেলা থেকে তীব্র মানসিক চাপ নিয়ে বেড়ে উঠেছি আমি। মায়ের মৃত্যুর পর কষ্ট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এমন ধনী বাবার সন্তান হয়েও দারিদ্র্য ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। আর্থিক কষ্টে বেড়ে উঠেছি আমি। দারিদ্র্য আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে আমায়। ফলে আমি মানুষ ছিলাম না, হয়ে গেছি মেশিন। জীবন বলতে আমার এতটুকুও সময় ছিল না আর। কষ্ট, কষ্ট আর কষ্ট। কষ্টের চোটে জীবন আমার হাঁপিয়ে উঠেছে। আর কত কষ্ট। মনে হয়েছিল, এই বুঝি শেষ। একেক সময় কষ্টের চোটে বুকের কোণে যে ব্যথা, তা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়। কেউ আমাকে বুকে তুলে নেয়নি। আমি শুধু আমার ছিলাম। কেউ নেই আমার।

একটা কাজ শেষ হয়, যখন তার দম শেষ হয়ে যায়। মনটা যে মরে গেছে আমার। আমি পাথর হয়ে গেলাম। পাথরের আর কী থাকে বলুন। আমার মনটা পাথরের খোদাই করা নিরেট একটা বস্তু। অনেকের জীবনেই এমন হয়, আমারও তা-ই। কাজের বন্ধুদের বলি, আমার মরুভূমির মতো জীবনে কেন এত কষ্ট দেবে তোমরা। কাজে গেলে বন্ধুদের আপন করে নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পরক্ষণেই দেখি, সে তো কিছু নয়, সে তো সব ভুল। আমাকে আর বাঁচতে দিতে চায় না কেউ। স্মৃতির মণিকোঠায় সেগুলো অনবরত আসা-যাওয়া করে। আমার হৃদয়ের কাছাকাছি আর কেউ নেই। আমি এখন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি। নিজেকে দিয়েই নিজেকে দেখি। সবই মরীচিকা। এ পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। সবকিছুই মিথ্যে, মিছে মায়া। বড় নিঃসঙ্গ আমি। আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না তোমরা। আমি একা, একা পথ চলেছি সব সময়। আর পারি না।

একইভাবে দুজন মানুষ যদি কেউ কাউকে না ভালোবাসে, তাহলে ভালোবাসা কীভাবে জন্মাবে। জীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কখনোই বিচার করতে পারিনি। মনের শখ-আহ্লাদ কী, আমি জানি না কখনো। প্রতিটি মুহূর্তই আমার দুর্বিষহ কষ্টের মধ্যেই আমার আমিকে আবিষ্কার করেছি বারবার। এভাবেই কেটেছে আমার প্রতিটা মুহূর্ত। কষ্টের ভাবনাগুলো বাতাসে উড়ে বেড়ায়। তার পরও ধৈর্য ধরতে হয় পদে পদে। জীবনের সব স্বপ্ন কি পূরণ হয়! কী বিচিত্র জীবন। বিচিত্র মানুষ। এই কষ্টের মাঝেই আমার আমিকে আবিষ্কার করি।

একসময় ক্ষমতা, রাজত্ব, ঘর-সংসার সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। তিনি বলেছিলেন, জীবনে ব্যথা থাকবেই। তবে কষ্টকে ভালোবাসতে শেখো। অবশেষে কষ্টকেই আলিঙ্গন করলাম। ছোট্ট একটা জীবন চলে গেছে কষ্ট করতে করতে। জীবনের শেষ বেলায় এসে ভাবনাগুলো জমাট বেঁধে মস্ত বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ভর করেছে। বুকের মধ্যে মস্ত বড় এক হাহাকার।

জীবনের এই আসা-যাওয়া যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো হৃদয়টাকে ভেঙেচুরে দেয়। সেই বোবাকান্না বুকে নিয়ে এখনো বেঁচে রইলাম। বুকের ভেতরে কী যেন ডাক দেয় বারবার।

অবশেষে সাদা উড়ন্ত বকের ভেতর চেপে ধরে উড়াল দিলাম। স্বপ্নের দেশ নামক দেশটায় পা রাখলাম। নিউইয়র্কে এসে দেখি, সেই একই কষ্ট। মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল আমার। কষ্ট আমায় পিছু ছাড়ছে না আর। এ যেন এক বেদনার ছায়া। কী আর করি, কোথায় যাই। অবশেষে নিউইয়র্কে নোঙর গাড়লাম। বাকি জীবনটা এখানে কাটাতে হবে ধরে নিলাম। তবে আল্লাহর শুকরিয়া, নিউইয়র্কের এই ঝলমলে শহরের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। জীবনের সব স্বাদ, আহ্লাদ, সুখ, প্রেম, ভালোবাসা বিসর্জনের বিনিময়ে আমি কী পেলাম!

বড় কষ্ট, শুধু ক…ষ্ট
কী যে কষ্ট ভালোবাসায়।
বড় কষ্ট, শুধু ক…ষ্ট-
কী যে কষ্ট ভালোবাসায়।
জ্বলেপুড়ে বুক ছিঁড়ে
যেন প্রাণটা চলে যায়-
বড় কষ্ট শুধু কষ্ট-
কী যে কষ্ট ভালোবাসায়।