অধ্যাপক সিরাজুল হক
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী এক বিরল কবি। তাঁর গদ্য তথা উপন্যাস ও গল্প সাহিত্যের কথা বাদ দিলেও তিনি ছিলেন কাব্যে, গানে এবং শিশুতোষ ছড়া সাহিত্যে এক বিরল স্রষ্টা। এসব কিছুতেই একটা মৌলিকত্বের দাবি রাখে যা বলাই বাহুল্য। তিনি আমাদের প্রাণের কবি, গানের কবি ; শুধু কী তাই? তিনি ছিলেন বহুমাত্রিকতায় পরিপূর্ণ এক বিরল ব্যক্তিত্ব ও মহান কবি।
আমি তাঁর শিশু সাহিত্য নিয়ে স্বল্প পরিসরে আলোকপাত করতে চাই। তা এ জন্য যে, সাধারণত কবির এ ক্ষেত্রটি নিয়ে সচরাচর আমরা এগিয়ে আসি নাÑ আসলেও তা কোমলমতি শিশু-কিশোরদের অন্তর স্পর্শ করার মতো করে তুলে ধরতে পারি না, তবে তা পারা একান্তই আবশ্যক বলে মনে করি।
রবীন্দ্রনাথের যুগে এসে নজরুল ইসলাম এমন কিছু স্বতন্ত্রধারায় রচনা সৃষ্টি করে আমাদের শিশু-কিশোর মনে জায়গা সৃষ্টি করেছিলেন, তা যুগ যুগ ধরে দেদীপ্য থাকবে। এগুলো তাঁর অমর কীর্তি। আর যদি অকৃতজ্ঞ না হই, তবে তা প্রজন্ম পরম্পরায় বাঁচিয়ে রাখবো।
যাক, যে কথা বলতে চেয়েছিলাম, অর্থাৎ তাঁর শিশু এবং কিশোরদের জন্য রচিত কবিতা সমগ্র। এই অপূর্ব সৃষ্টি তুলনারহিত। নিচে কয়েকটি কবিতা বা ছড়া সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করতে প্রয়াস পাবো। যেমন, তিনি কচি কোমল শিশুদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছেন এভাবে আদর করেÑ
‘ভোর হলো
দোর খোল
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকী ছোট রে!’
তিনি আরও বলেন-
‘খুলি হাল
তুলি পাল
ঐ তরী চলল,
এইবার
এইবার
খুকু চোখ খুলল।’
লক্ষ্যণীয়, কবি কচি-কিশোর শিশু মনে এমন সুন্দর শব্দমালার ধারণা দিয়েছেন যে, শব্দগুলোর সাথে এ বয়সে পরিচিত না হলেও কণ্ঠস্থ করার মাধ্যমে সেগুলো তাদের মনে গেঁথে যেতো। যেমন- দোর, জুঁই, পাল, তরী প্রভৃতি শব্দ। কবি অতি কোমল শিশু মনে এসব শব্দ গেঁথে দিয়েছেন নিপুণভাবে।
কবি শিশু-কিশোরদেরকে চার দেয়ালের মাঝে সে বদ্ধ ঘরে না থেকে চক্ষু উন্মিলিত করে বাইরের ‘জগত’ পরিভ্রমণের জন্য উদ্দীপনা যুগিয়েছেন। এই উৎসাহ-উদ্দীপনা জ্ঞান অন্বেষণের জন্যে, শিল্পকলা প্রভৃতি আয়ত্ত্ব করে দেশ ও দশের উন্নতির জন্যে। যেমন কবি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মন ও মননকে চাঙ্গা করার জন্য বলেন-
‘থাকব না কো বন্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে-
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।’
কবি এখানে শিশু-কিশোরদেরকে জগতের আলো দেখাতে চেয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন যা পুরো কবিতাটি পাঠ করলেই আমরা দেখতে পাব। শৈশবেই শিশু-কিশোর মনে কবি একটি জাগরণ এনেছেন, এটা সত্যিই বিস্ময়কর বিষয়!
আজ বাঙালি মানুষ পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। কবি যখন এই কবিতা রচনা করে বাঙালি শিশু-কিশোর তথা তাবৎ জনমানুষের মনে ভবিষ্যতে বিশ্ব চষে বেড়ানোর যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, এটা সেই ফসলেরই বাস্তব রূপ।
আজকে আমরা বিশ্বের যে প্রান্তেই যাব, বাঙালি নারী-পুরুষের সমাগম দেখতে পাব। কিন্তু কবির সে যুগে কি তা কেউ ভাবতে পারতো? কাজেই কবি যে ভবিষ্যতের দ্রষ্টা, তা এই শিশুতোষ কবিতাটি দ্বারা বুঝা যায় অনায়াসেই।
এমন একটা সময় ছিল, মানুষ লন্ডন ঘুরে আসলেই বলা হতো ‘বিলেত ফেরৎ।’ এটা আর এখন বলাবলি হয় না খুব বেশি। কারণ, তা এখন ডাল-ভাতের মতোই সহজ ব্যাপার। আজকাল একজন কৃষিজীবী কৃষিপণ্য নিয়ে এবং একজন মৎস্যজীবী মৎস্যপণ্য নিয়ে লন্ডন-আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে সহজেই যাতায়াত করে, যেমন করে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন আরব দেশে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও বাঙালিরা বাজার গড়ে তুলেছে।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, পবিত্র কুরআনেও জগত ভ্রমণে উৎসাহ যুগিয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে- ‘সিরু ফিল আরদে…।’ অর্থাৎ, তোমরা বিশ্বভ্রমণ করো। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) তাঁর কবিতায় বলেছেন- বিদেশ ভ্রমণের মধ্যে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য নিহিত; ভয়ভীতি নিরসন, অর্থোপার্জন, বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন, শিষ্টাচার অর্জন এবং বিশিষ্ট ও গুণীজনদের সাহচর্য লাভ। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ও এ কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সকাল বেলার পাখি কবিতায় কবি বলেনÑ
“আমি হব সকাল বেলার পাখি।
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।
সূয্যি মামা জাগার আগে ঊঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে!
বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে! ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে না ক’!
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে।”
আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাব যে, পাখিরা সকলের আগে জেগে উঠে কিচির-মিচির শব্দ করতে থাকে, মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। কবি তাই শিশুদেরকে জেগে উঠার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছেন এই শিশুতোষ কবিতাটির মাধ্যমে। সকালে ঘুম থেকে উঠবে, বাইরে খোলা জায়গায় বিচরণ করলে মন প্রফুল্ল হয়, স্বাস্থ্য ভালো হয়, শরীরে জড়ত্ব আসে না ইত্যাদি।
ইংরেজিতে প্রবাদ আছে : ঊধৎষু ঃড় নবফ, বধৎষু ঃড় ৎরংব সধশবং ধ সধহ যবধষঃযু, বিধষঃযু ধহফ রিংব. কবি তাই শিশুমনে প্রত্যূষে উঠার অনুভূতি জাগ্রত করেছেন এ কবিতাটির দ্বারা। পাখিরা যেভাবে রাত না পোহাতেই উঠে ডাকতে থাকে, (যেমন আমরা কাক-ভোরের কথা বলে থাকি) শিশুরাও কবির ভাষায় তা-ই করুক।
কবির আরকটি কবিতা ‘ঝিঙে ফুল’-
‘ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল-
ঝিঙে ফুল।
গুল্ম পর্ণ
লতিকার কর্ণে
ঢল ঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল-
ঝিঙে ফুল।
পাতার দেশের পাখি বাঁধা হিয়া বোঁটাতে,
গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে।
পউষের বেলা শেষ
পরি’ জাফরানি বেশ
মরা মাচানের দেশ
ক’রে তোল মশগুল-
ঝিঙে ফুল।’
ঝিঙে এবং ঝিঙে ফুল, যা অতি সাধারণ বিষয়। এটি বনজ লতানো গাছ। ঝিঙে তরকারি হিসাবে আমাদের খাদ্য কিন্তু এর ফুলের প্রতি সাধারণত কেউ দৃষ্টি ফেরায় না। সূক্ষ্মদর্শী কবির চোখ তা এড়াতে পারেনি, তাই ঝিঙে ফুলের বিচিত্র শোভাকে শিশু-কিশোরদের জন্য লোভনীয় করে তুলেছেন যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কবির আরেকটি রসাত্মক ছড়া কবিতা হচ্ছে ‘লিচুচোর’-
‘বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছ গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াৎ করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।’
এ ছড়াটি কৌতূহলোদ্দীপক এবং রসাত্মক। বাচ্চাদের হাসির খোরাক যোগায়। এটি কবির অদ্ভূত সৃষ্টি। সাথে সাথে এর মধ্যে নৈতিক শিক্ষাও রয়েছে। তা হলো চোরের শাস্তি। চোর অবশেষে কানে ধরে তোবা করতে বাধ্য হয়। এটি দ্বারা একটি ভালো একাঙ্কিকা নাটক হতে পারে।
কবির আরেকটি ছড়া হলো ‘ খুকী ও কাঠবিড়ালি’-
‘কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি লেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকল্পুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভাড়ি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!’
কাঠবিড়ালি একটি দুষ্ট প্রাণী, গাছ গাছ বিচরণশীল। তাই ওর নাম কাঠবিড়ালি। সে মানুষের ক্ষেত-খামারের শাক-সবজি কেটে খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। গাছের ফল-ফলাদিও খেয়ে ফেলে। এসব ব্যাপারে কবির প্রখর দৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই অত্যন্ত রসাত্মকভাবে শিশু-কিশোরদের জন্য এই ছড়া কবিতাটি রচনা করেছেন।
শিশু যাদুকর-
‘পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর
এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর!
কোন্ রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই,
রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই।
নবনীত সুকোমল লাবণী লয়ে
এলি কে রে অবণীতে দিগ্বিজয়ে।
কত সে তিমির-নদী পারায়ে এলি-
নির্মল নভে তুই চাঁদ পহেলি।
অমরার প্রজাপতি অন্যমনে
উড়ে এলি দূর কান্তার-কাননে।
পাখা ভরা মাখা তোর ফুল-ধরা ফাঁদ,
ঠোঁটে আলো চোখে কালো-কলঙ্কী চাঁদ!
কালো দিয়ে করি তোর আলো উজ্জ্বল-
কপালেতে টিপ দিয়ে নয়নে কাজল।’
এটি কবি নজরুল ইসলামের বিস্ময়কর প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ। শিশুতোষ কবিতা বটে; কিন্তু শব্দ চয়ন, এর ভাবমাধুর্য যেন আমাদেরকে এক আনন্দ-ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়। এর শব্দমালার বিশ্লেষণ করলে তা একটি নিবন্ধ হতে পারে, যার অবকাশ এখানে নেই।
এই কবিতার পিছনে একটি ছোট্ট ইতিহাস রয়েছে, যার সংক্ষেপ হলো এই: নজরুল ইসলাম কিছুদিন চট্টগ্রামে তাঁর বন্ধু ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের বাসায় অবস্থান করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে অবস্থানকালে নজরুল ইসলাম একটি শিশুকে কোলে নিয়ে এই কবিতাটি রচনা করেন।
উপসংহার : আমরা নজরুল ইসলামকে ভালোবাসি বটে; কিন্তু তাঁকে সার্বিকভাবে গ্রহণ করি কি? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নজরুল ইসলামের আবেদন রেখে যেতে পারছি কি? তাঁর এই শিশুতোষ কবিতার কথাই বলবÑ যা শিশু-কিশোরদের আত্মার খোরাক হতে পারে। আমরা বাঙালি-বাংলাদেশি। তাই যেসব পরিবার বিদেশে অবস্থান করছে, তাদের শিশু-কিশোরদের বাংলা ভাষা, বিশেষ করে নজরুল ইসলামের শিশুতোষ কবিতাগুলোর সাথে পরিচিতি ঘটানো প্রয়োজন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য, নিউ ইয়র্ক।