লাবলু কাজী
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেল । ঝলমলে সূর্য যখন মধ্যাকাশে পরাক্রমে বেরিয়ে এলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁচেছে ঠিক আমার বয়সের মতো । জীবনের নিত্য বলয়ে ঘুরতে ঘুরতে দুর্যোগের ঘনঘটায় কখন যে যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য এসে গেছে বুঝতেই পারিনি । ফেলে আসা জীবন পেছনে টানে, জীবন চাহিদা সামনে টানে । যশ-খ্যাতি, মান- সম্মান জীবন টেনে তোলে, দাঁড় করায় বলে ” তোমার জীবন এখনও শেষ হয়ে যায়নি, পৃথিবীকে দেয়ার এখনও অনেক কিছু বাকী আছে তোমার “। মন বান্ধা , শরীর না চাইলেও উঠতে হয় , কারণ আমি চেতনা জাগ্রতের পুরোধারের পুরুষ । সবাই আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকে , আমায় আলোর দিশারী ভাবে , অপেক্ষায় থাকে হুকুম তামিল করার । জীবনে বিজয় কেতনের ঝান্ডা উড়িয়ে আমি অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি , আমাকে তারা ছাড়বে কেন , আমি যে বিজয়ের চূড়ান্ত ঘন্টার আওয়াজ শুনছি ! তাদের স্বার্থও যে আমাতে লুক্কায়িত ।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন । ধানমন্ডির লেক ভিউ এপার্টমেন্টে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবছি আমার জীবন আমার জীবনের দিনগুলো । সন্ধ্যা নামলো বলে , দখিনা হাওয়া , আমার শীত শীত করতেছিল । কাজের মেয়েটা আমার প্রিয় বেইজ কালারের শালটা দিয়ে গেল, আমি গায়ে জড়িয়ে নিলাম । ইদানিং রাতে রাতে জ্বর জ্বর লাগে , এ কিসের নূতন আলামত বুঝা যাচ্ছে না । অনেক কিছু পুরানো ডুবা তারার মতো কাদম্বিনীর বেড়া পেড়িয়ে মনের আকাশে ভাসে । সেই বান্দুরা স্কুলের কথা, নটর ডেমে ভাল কিছু হলো না । অনকে বলতো তোর কিছু হবে না । বাপের ব্যবসাই ধর , তার গুড উইল ছিল , ধরে রাখতে পারলে উন্নতি করতে পারবি । সেই নারায়ণগঞ্জেই চলে গেলাম সূতার ব্যবসায় । আস্তে আস্তে পসার বাড়লো , গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী দিলাম সেখান থেকে ব্যাংকে ইনভেস্ট করলাম , বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস হলাম , পালাক্রমে চেয়ারম্যান। আমায় আর থেমে দাঁড়াতে হয়নি , আমি চলছি তো চলছিই । নাম , যশ, খ্যাতি কোন কিছুই আর পাওয়ার কমতি নেই!
জীবন সম্ভবত ব্যবসা নয় , জীবনের আলাদা ধার গতি আছে । এ গতি নিয়ন্ত্রিত নয় , সৃষ্টিকর্তা লিখে রাখেন আমাদের তামিল করতে হয় । আমি বিবাহিত, তিনটি বাচ্চার জনক , সুখী পরিবার । কোথায় থেকে কি হলো , আমার নূতন সেক্রেটারী , বন্যা ইন্টারভিউর দিন থেকে মনে বসিয়ে নিলো। জীবন চলে প্রতিদিনের কাজে, বিদেশে ট্যুরে , তার বিয়ে , দুটো বাচ্চা হলো সব জানা , অজানা নয় । ভাল আন্ডারষ্টান্ডিংয়ে ভালই তো চলছিল । বস এবং কর্মচারির যে সম্পর্ক থাকা দরকার আমি তার আগে বাড়িনি , বুঝতে দেইনি নিজের দুর্বলতা। পাছে নীচু ভাবে , যদি বলে আপনাকে আমি অন্যভাবে দেখি। আমি কি ভাবি আর আপনি কি ভাবেন । আমি আপনার মতো বিবাহিতা , সংসার আছে, বাচ্চা আছে , আমি আমার স্বামীকে ভালবাসি । আপনারা পয়সাওয়ালা লোকেরা সবাইকে খুব চীপ ভাবেন । চিন্তা করলেই আমি আঁতকে উঠতাম একদম দমে যেতাম । মনের পাগলামি মনেই থাকলো , আমি কাউকে জানতেও দিলাম না মন কি চায়। মন রং বদলায় , মন খুশীর নাচন নাচতে চায় !
একদিন চৈত্রের দুপুরে টেলিফোন এলো বন্যার স্বামীর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের। তার আহাজারি আজও আমার মনের মন্দিরে ঠগঠগ করে বাজছে, গির্জার ঘন্টার বেলের মতো । ডাক্তার -হসপিটাল সব চেষ্টা করা সত্ত্বেও সে বাঁচলো না । সে স্বামীহারা , দুটো বাচ্চা এতিম হয়ে গেল । তার মুখের দিকে তাকানো যায়না , চেহারার কি হাল করে রেখেছে , ভাললাগার মানুষকে ওভাবে দেখা যায়না । কাজের পর অফিসে সে আমার জন্য অপেক্ষা করতো। তাকে আদর করতাম, বুঝাতাম , আমি তো আছি জীবন চলে যাবে , ভয় কি ! আমি তার বাসায় যাওয়া শুরু করলাম , তার ছোট বাচ্চারা আমায় বড় আপন করে নিল । একদিন না গেলে বলতো আঙ্কেল গতকাল আসোনি কেন ? আমি আস্তে আস্তে আরো দুর্বল হয়ে পড়লাম । এক প্রচন্ড ঝড়ের রাতে আমার আর বাসায় ফেরা হলো না । কখন যে ওর বেডে ক্লান্ত গা এলিয়ে দিয়েছি খেয়াল নেই । তার তপ্ত স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমরা আদিম খেলোয়ারের খেলায় মত্ত হয়ে গেলাম । আমি তখন খেলারাম , খেলে যাচ্ছি পরোয়ানা নাই । একদিকে আমার সংসার , স্ত্রী , ছেলে মেয়ে অন্য দিকে সে । কাকে ধরি , কাকে ছাড়ি ? এ কি কঠিন জীবন পরীক্ষায় ফেললে আল্লাহ !
আমার স্ত্রী সব বুঝতে পারলো , আমাকে সাবধান করে দিলো এ হওয়ার নয় । আমাদের পরিবরের মান সম্মান আছে , বাচ্চারা বড় হয়েছে তুমি যা খুশি তা করতে পারো না । সত্যিই তো আমি আর যা খুশি তাই আর করতে পারিনা । আমি রাতের পর রাত দিনের পর দিন ভেবেছি কোন কূল কিনারা পাইনি । সব চেয়ে বড় সমস্যা আমার মন , যার থেকে ছাড়া পাচ্ছি না । তাছাড়া আমি তাকে কথা দিয়েছি তার কি হবে ? যখনই কোন খারাপ সিদ্ধান্ত নেই তার অসহায় মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমি আর পারিনা । আমি আমার স্ত্রীকে জীবনের ক্রস রোডে আমার সিদ্বান্তের কথা জানিয়ে দিলাম। তাকে ছাড়া সম্ভব নয় , সে কি ত্যাগ করতে পারে । আমি বাসা ছেড়ে চলে গেলাম , অন্যত্র যেয়ে উঠলাম । অনেক দেন দরবারের পর আমার স্ত্রী বিয়েতে রাজি হলো । একটি মাত্র কন্ডিশন তাকে ধানমন্ডির বাসায় কখনও আনা যাবে না । আমি সে প্রতিশ্রুতি রেখেছি । বাংলায় একটা কথা অছে “স্বামীকে বাঘের কাছে ছেড়ে দেওয়া যায় , সতীনের হাতে নয় ” আমি তার এ ত্যাগের জন্য চিরকৃতজ্ঞ ।
আমাদের বিয়ে হয়ে গেল , বন্যা আমার বনানীর বাসায় এসে উঠলো । কাজ ছেড়ে দিলো বাসা তার বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । চলার নাম গাড়ি জীবন চলতে লাগলো । দু সংসার , দু পৃথিবী , এক করে আমায় পরিক্রম করতে হবে এবং করছি । সব চেয়ে কঠিন কাজ জীবনে , অন্যের বাচ্চাকে নিজের ভাবা , নিজের করে নেওয়া এবং আমি চেষ্টা করছি । জীবন কখন মোড় নেয় আচমকা বলা যায় না । তার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়লো , লাস্ট স্টেজ , হৃদ পিন্ডে যেয়ে ঠেকেছে । কিমো দিয়ে মাস খানেক রাখা গেল , সে আমায় রেখে সারা জীবনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেল ! জীবন কেন বার বার পরীক্ষায় ফেলে , উত্তরণ সহজ নয় । দরদ কা এ রিস্তার করুণ উপাখ্যান আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি , কেউ কি তার খবর রাখে , পরোয়া করে ? সৃষ্ট আমার নিজের , কষ্টও আমার একার সহচর কারো সাথে ভাগাভাগির রাস্তা নেই ! বন্যার বাচ্চা দুটোকে আমি নিজে মানুষ করেছি , বিয়ে দিয়েছি , ওরাতো ভালই আছে ! আমি কি পেলাম , চোখ বুঝলেই সে কাছে আসে, জিজ্ঞেস করে আমি কেন ওকে দূর করে দিলাম …! আমার স্ত্রীর ডাকে চৈতন্যে ফিরে এলাম । সে মাথায় হাত রাখলো বললো শরীর গরম, জ্বর এসেছে, বাইরে ঠান্ডা ঘরে এসো ! আমি অন্ধকার লেকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলাম মনে হলো বন্যা যেন হাত নেড়ে আমায় ডাকছে , বলছে আমি তোমায় নিতে এসেছি , তুমি এসো , এইতো আমার হাত ধরো শক্ত করে ……………!
নিউইয়র্ক।