কানাডার আদিবাসীদের ভাষা ও মর্মস্পশী অশ্রুকণা

সোনা কান্তি বড়ুয়া

কানাডার নির্যাতিত আদিবাসী মানুষের ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, অন্তর্লোকের অজানা ইতিহাস দূরের না কাছের আয়না? সভ্য মানুষের জগতে আদিবাদীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে কানাডার ভাবমূর্তি কোথায় হারিয়ে গেল? ১৯৭১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর আমেরিকার নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘে সাধারণ পরিষদের ৭২ তম অধিবেশনে কানাডার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মর্মস্পশী র্ আন্তর্জাতিক ভাষণ তিনি তাঁর দেশ কানাডার আদিবাসীদের নিকট ক্ষমা চেয়েছেন এবং বিভিন্ন নিপীড়ন ও জীবন সমূহ দুঃখের দহনে করুন রোদনে তিলে তিলে ক্ষয় হবার বর্ণনা জনতার সামনে তুলে ধরেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীর সত্য কথায়” এই সব মূঢ় ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা / এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্নবুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।” আদিবাসীদের ভাষ া ও হৃদয় বিদারক ছবি , সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনধারা ভুলে যাবার জন্যে ১৯৫০ সালে আইনের শাসনে কানাডার চার্চ কর্তৃপক্ষ ছয় / সাত বছরের ছেলে মেয়েদেরকে জোর করে রেসিডেন্টসিয়াল স্বুলে আবদ্ধ করে রেখেছিল কানাডার ইউরোপীয়ান জীবন ধারায় গড়ে তুলতে। এই অপরাধের জন্যেও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আদিবাসীদের কাছ থেকে সরকারি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
হিংসা বিদ্বেষের রাজনীতিতে সব ঝ্যুট হ্যায় এবং টোকাই ও কেষ্টা বেটাই চোর।
শ্বেতকায় বা অভিজাত গোষ্ঠি ও ধনীরা কি সবাই ধোয়া তুলসী পাতা? একবিংশ শতাব্দীর বর্ণবিদ্বেষের অপ্রত্যাশিত মডেল বা প্যারাডাইম কানাডার সাদা পুলিশের প্রশাসনিক শক্তির অপব্যবহার। ক্ষুধিত বর্ণবিদ্ধেষের সবকিছু বৈজ্ঞানিক ও টেকনোলোজি শক্তির জোরে একদা কতিপয় ইউরোপীয়ান রাষ্ঠ্রসমূহ “সুপারম্যান হয়ে” বিভিন্ন মহাদেশে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে কলোনীয়ান রাজ্য গড়ে তোলে। জোর যার মুল্লুক তার নয়। ধন্য আশা কুহীকিনীর ইহলোকে হিংসা – বিদ্বেষের নানা চেহারা। মানুষের এই অনিত্য সংসারে ধর্ম, রাজনীতি, আঞ্চলিকতা, ভাষা, জাতি, গোষ্ঠি, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও গায়ের রং নিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করে চলেছে দিনের পর দিন। প্রধানমন্ত্রীর উক্ত ভাষণকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘পলিটিক্স অব হেটরেড বা ঘৃণার রাজনীতি।”কানাডার আদিবাসীগণ আজ ‘গো ভাগাড়ে পড়া চিল শকুনের দল’ বলতে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার রঙ্গ ব্যঙ্গ (সজনীকান্তের) ভাষায়, ”আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই / আমি বুক দিয়া হাঁটি / ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই। / আমি ভীম ভুজঙ্গ / ফণিনী দলিত ফণী ।”
কানাডায় কত শত দেশের মানুষ আসে যায় কিন্তু কানাডার আদিবাসীগণের দুঃখ যন্ত্রনার কথা বিশ্ববাসী আজও জানেন না। আদিবাসী যে মানব, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ও সে মানব হলেও বাস্তবতার আলোকে আকাশ পাতাল তফাৎ কেন? কানাডার বুকে দৈনন্দিন জীবনে মানুষ মানুষকে অপমান করে চলেছে। বিগত ১৫০ বছরে কানাডার জনৈক আদিবাসী ঘরের সন্তান আজও কানাডার প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত হলেন না কেন? বর্ণবাদ ও ধর্মের কারণে মানুষ মানুষের দুশমন হয়েছে! সাধারণত: আমরা কোন দেশের সরকারি নেতা থেকে এমনতরো সত্য ঘটনা শুনতে পাই না !
কানাডার বিশ্ব বিখ্যাত মানবাধিকারের ঝর্ণা তলার নির্জন অন্ধকারে আবৃত আদিভুক্ত ভোগীরাই জানেন যে, কানাডায় বর্ণবাদের শিকার দুর্ধর্ষ ডাকাত থেকে খোঁড়া ভিখিরি এবং প্রধানমন্ত্রীর উক্ত ভাষণে জনতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, সরকারি এবং ধর্মীয় (চার্চ) কতিপয় প্রশাসনিক শক্তির অহংকারের বিভিন্ন স্তরের ঘূর্ণাবর্তের ঘোমটা সরিয়ে গোটা পৃথিবীকে দেখাল কানাডার বর্ণবাদের কুৎসিত চেহারা ! কানাডার দুঃখী আদিবাসীদের জন্যে দু’টো কথা বলার কারো সময় নেই।
কানাডার নির্যাতিত আদিবাসীদের মনে আমার কানাডা আমার দেশের প্রতিধ্বনি :
কানাডা আমার, মাতা আমার চির বিজয়ী কানাডা দেশ,
জগৎ জুড়িয়া কানাডা জাতি জয় কানাডা গাইছে বেশ!
হাজার বছর আগের আদিবাসীদের ইতিহাস কি কথা কয়?
আদিবাসীদের নাম না জানা কত বীর অমর অক্ষয়।
আমার স্বপ্ন কানাডা মহাজাতক শান্তির কানাডা দেশ
স্বপ্নের অমোঘ বানী মহাপ্রেমের কানাডা অশেষ।
জন্ম লগনে কানাডা দেশ, কান্নায় আমার কানাডা দেশ
মন্ত্র আমার কানাডাদেশ হাসিতে আমার কানাডা দেশ।
কথায় কথায় কানাডা দেশ, রক্তে আমার কানাডা দেশ।
তীর্থ আমার কানাডা দেশ, বিত্ত কানাডা দেশ,
আমার আমি কানাডা দেশ, পরিচয় আমার কানাডা দেশ।
প্রেমিকা আমার কানাডা দেশ, সেবিকা আমার কানাডা দেশ,
পিতা আমার কানাডা দেশ, ভাই বোন আমার কানাডা দেশ।
অস্তিত্ব আমার কানাডা দেশ, রাজত্ব আমার কানাডা দেশ ।
জীবন আমার কানাডা দেশ, মরণ আমার কানাডা দেশ,
সুখ আমার কানাডা দেশ, দুঃখ আমার কানাডা দেশ।
অনুভূতি আমার কানাডা দেশ, দর্শন আমার কানাডা দেশ,
কবিতা আমার কানাডা দেশ, রক্ষক আমার কানাডা দেশ ।
কানাডার অনেক বছরের নির্যাতিত আদিবসীবৃন্দের পুঞ্জীভ’ত অপমান ও বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। সম্প্রতি সরকারিভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ভবের হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। কানাডার আদিবাসীর ভাষায় ’টরন্টো’ শব্দের অর্থ ‘মিলন মেলা’ ! দৈনিক টরন্টো মেট্রো (সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৭) পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন ছিল, ” কানাডার আদিবাসীদের উন্নতির জন্যে ক্ষমতাশালী মহল কিছুই করছেন না ” শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদ টরন্টোর সিটি কাউন্সিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ করেছেন।
ক্ষমতার বেআইনি আস্ফালনে কানাডার (কুইবেকে) কতিপয় ফালতু পুলিশ আদিবাসী ১৬ জন মেয়েকে ধর্ষণ করার পরে হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। “ছিঃ ! কানাডার কতিপয় জঘন্য পুলিশ ছিঃ । ছিঃ পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পুলিশ অ্যাক্টেড স্টুপিডলি।” দিন বদলের যে মডেল বা প্যারাডাইমে বর্ণবিদ্বেষের ভাইরাস কানাডার গণতান্ত্রিক দেহে প্রবেশ নিষেধ। আদিবাসীগণ দুঃখ সমুদ্রে ভাসমান এবং কানাডার নিউজ মিডিয়ায় অহরহ আদিবাসীদের পুলিশ নির্যাতন নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হয়েছে। কলম্বাস আমেরিকা এবং কানাডা আবিষ্কারের পূর্বে আদিবাসীগণই এই কানাডার একমাত্র মালিক ছিলেন।
(২)
ইউরোপীয়ান সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির পরদেশ লুন্ঠন নিয়ে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আর বেশী কথা বলেননি। তবে জনতা তাঁর ভাষণের আসল কথা বুঝে নিতে ফেলে আসা ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্রান্স বৃটিশ ও ইউরোপীয়ান সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিদ্ধয় অমানবিক পন্থায় কানাডার আদিবাসীদের পুরানো এই দেশ ও ধন লুট করার ফে ল আজ কানাডার আদিবাসীদের জীবন যাপন করার জন্যে পরিশুদ্ধ জল নেই, স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে ভাল বাসস্থান নেই এবং দেশের সত্যিকারের মানুষ হবার স্বপ্ন পর্যন্ত আর অবশিষ্ট র’লো না। কানাডার আদিবাসীগণ পরাজয়ের মনস্তাত্বিক রোগে শোকে ও বেদনায় মুহ্যমান। কারণ বিভিন্ন দেশের শরনার্থী কানাডায় বসবাস করছেন কিন্তু কানাডার আদিবাসীগনের এমন ভগ্ন দশা কেন? এই জন্যে দিনের পর দিন আদিবাসীদের আপাপবিদ্ধ বালক বালিকাগণ পর্যন্ত আত্মগ্লানিতে আহত হয়ে আত্মহত্যা করছে। কানাডার মানব সমাজই এই অপরাধের জন্য দায়ী। মরে গেলে ও মানব মন কোন শক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে না। তাই অহিংসার মাধমে মানব সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মানুষ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে আমার কানাডা কবিতা !
নয়া দিন নয়া রাতের দিন বদলের যুগে ও আদিবাসীগণ, কালো এবং ল্যাটিনোদের “দুঃখের তপস্যা আজও হয়নি সমাপন ! ডারউনের বিবর্তনবাদ, ও ফ্রয়েডের মনসমীক্ষণ কানাডার বর্ণবিদ্বেষের রাজনীতির বাজার সরগরম হয়ে ওঠলো। সমাজে মানবমন অহিংসায় আলোকিত না হলে বর্ণবিদ্ধেষের আগুন জ্বলে। কানাডার সাদা পুলিশের অমানবিক আচরণ এবং বর্ণবিদ্বেষের এই বিষময় ক্যান্সার রোগ ছড়িয়ে পড়েছে কানাডার সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। জোর যার মুল্লুক তার। মানুষকে অপমান করার ফল খুবই কানাডার আদিবাসীদের ভাষা ও মর্মস্পশী অশ্রুকণা
(৮ পাতার পর)
ভয়াবহ। ফেসেস অব কানাডায় আদিবাসীগণ ইউরোপীয়ানদেরকে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাঁদের নিশ্বাসে কি বিষ ছিল?
“তোমার নিশ্বাসে বিষ ছিল
আমি বিশ্বাস করিনি।
ওরা বলেছিল বহুবার
কারো কথা কানে ধরিনি।
রূপ সুন্দর যার,
ভাবিনি এমন কালো হবে অন্তর তার।
তোমারই তো মালা পড়েছি
আর কারো মালা পড়িনি।
বাইরে তো সুনাম,
এতো খাদ ভিতরে যাচাই না হলে আমি কি করি?
গান এতো সুমধুর যার,
ভাবিনি মুখের কথা এতো নিষ্ঠুর তার।
আমি জেনে মরেছি,
কিছু না জেনে তো মরিনি।
তোমার নিশ্বাসে বিষ ছিল
আমি বিশ্বাস করিনি। ( মান্না দে’র একটা বিখ্যাত গান)!”
গানটা শেষ হতে না হতেই প্রবাসীদের নানা স্বপ্নভঙ্গের কথা নানাদিক দিক থেকে কানে আসছে। মহাকালের স্রোতে মানুষের চন্দ্রবিজয়ের পরও মানুষ জাতি সহ কানাডার সরকারি শক্তিবান কর্তৃপক্ষ বর্ণবিদ্বেষ জয় করতে পারেনি।
আমরা অনেকে কানাডার আদিবাসীদের চোখের কোনে জমানো অশ্রুবিন্দুতে আত্মপ্রক্ষেপের আগুন দেখেছি । অহিংসার আয়নায় দেখলে মানুষ মানুষের ভাই। হিংসার আয়নায় দেখলে ভাই ভাইয়ের শত্রু। অহিংসা মানবতার পথ এবং হিংসা মানুষজাতির সর্বনাশের পথ। সেবা, ভালবাসা বা বিশ্বমৈত্রী দিয়ে মানুষের মনের অন্ধকার ধ্বংস করে প্রতিটি মানব মনে মানবতার আলোই আলোকিত বিশ্ব গড়ে তুলবে। শেষ পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিশ্বরাজনীতির জাতিসঙ্ঘ মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশায়ে দেশের আদিবাসীদের দুঃখ যন্ত্রণার অব্যক্ত কাহিনী বর্ণনা করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মানসে আমরা কানাডার আদিবাসীদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি।
লেখক : বিবিধ গ্রন্থ প্রণেতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো।