কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ

সেতারা কবির সেতু : কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ৭২ তম জন্মদিন ছিল ১৩ নভেম্বর। ১৯৪৮ সালের এই দিনে লেখক, কবি, সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নেত্রকোনার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। ডাক নাম কাজল। পরবর্তীতে তিনি নিজেই নাম পরিবর্তন করে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে ভুগে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে কিংবদন্তি এই কথাসাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন। নুহাশ পল্লিতে তাকে সমাহিত করা হয়।

হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। হুমায়ূন আহমেদ রচিত অন্যতম উপন্যাসগুলো হলো মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।

হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো সর্বসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। ১৯৯৪-এ তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি লাভ করে। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আটটি পুরস্কার লাভ করে। তার নির্মিত অন্যান্য সমাদৃত চলচ্চিত্র হলো : শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), দুই দুয়ারী (২০০০), শ্যামল ছায়া (২০০৪) ও ঘেটু পুত্র কমলা (২০১২)। শ্যামল ছায়া ও ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র দুটি বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের জন্য দাখিল করা হয়েছিল। এছাড়া ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য একদিকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে পাঠককে। অন্য দিকে তিনি নির্মাণ করেছেন অনন্য সব নাটক, চলচ্চিত্র ও গান। হুমায়ূন আহমেদের একটি অন্যতম উপন্যাস বাদশাহ নামদার। যে উপন্যাসটি পড়ে আমি মুগ্ধ। আজ এই উপন্যাসটি নিয়ে বলবো।

কাহিনী বর্ণনা :

‘রাজ্য হলো এমন এক রূপবতী তরুণী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে
সুতীক্ষ্ণ তরবারির প্রয়োজন হয়।’
কবিতার এই চরণটি পছন্দের তাই এটি দিয়ে শুরু করলাম। এবার আসি মূল কাহিনীতে। বাবর পানি পথের ১ম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবরের ১ম পুত্র হুমায়ূন মীর্জা। লেখক মূলত বাদশাহ হুমায়ূনকে কেন্দ্র করেই এই উপন্যাসটি রচনা করেছেন।
সম্রাট বাবর চান তাঁর পুত্র হুমায়ূন সিংহাসনের দায়িত্ব নিবেন। কিন্তু হুমায়ূন ছবি আঁকতে, বই পড়তে, শের রচনা করতে ভালোবাসেন। প্রকৃতিপ্রেমী হুমায়ূনের প্রকৃতির মাঝেই ছিল প্রকৃত সুখ। হুমায়ূন একবার খুব অসুস্থ হলেন। সকল চিকিৎসক তাঁর বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেন। সম্রাট বাবর নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন আল্লাহর কাছে। ৫০ বছর বয়সে সম্রাট বাবর মারা যান। তাঁর মৃত্যুর ৩ দিন পর সিংহাসনের দায়িত্ব নেন হুমায়ূন মীর্জা।
হুমায়ূনের দুই ভাই কামরান মীর্জা আর হিন্দাল মীর্জা শুরু থেকেই তাঁর বিরোধিতা করে আসছে। হুমায়ূনের কাছে চিতোরের রানী কর্ণাবতী সাহায্য চেয়ে একটি পত্র পাঠান। দরবারের সকল আমীররা সম্রাটকে নিষেধ করেন সাহায্য করতে। কারণ মোঘল সম্রাজ্য এখন মহাবিপদে। আমীররা বলেন শাহানশাহ রাজনীতিতে আবেগের কোনো স্থান নাই। উওরে বাদশাহ বলেন, আমার রাজনীতিতে আছে। একজনের চরম বিপদে আমি যখন তাঁর পাশে দাঁড়াব, আমার বিপদেও কেউ না কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে।

বাদশাহ দায়িত্ব পালনের সময় সাথে পান সাহসী সেনাপতি বৈরাম খাঁকে। মোঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে মোঘল সাম্রাজ্যের শত্রু শেরশাহ শক্তি সংগ্রহ করছে মোঘল সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য। শেরশাহ খুব ভালোভাবে জানতেন শক্তিতে তিনি কখনই হুমায়ূনকে পরাজিত করতে পারবেন না। তাই তিনি হুমায়ূনের দুর্বল দিককে কাজে লাগিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত সৈনিকদের ওপর হামলা চালান।
বাদশাহ জীবন রক্ষার জন্য নদীতে ঝাঁপ দেন। সেখানে ভিসতিওয়ালা নাজিম তাঁর জীবন বাঁচান। শুরু হলো হুমায়ূনের কষ্টের জীবন। হুমায়ূন আশ্রয় নেন বীরভূমে। সেখানেও শেরশাহের লোকেরা আক্রমণ চালায়। বাদশাহ নদীপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় বৈরাম খাঁর সাথে দেখা হয়। ভগ্ন হৃদয় নিয়ে হুমায়ূন আগ্রায় পৌঁছান।
তাঁর দুইভাই মোঘল সাম্রাজ্য ফিরে পেতে সকল ধরনের সাহায্যের ওয়াদা করেন। ফলে বাদশাহ শেরশাহের সাথে কনৌজের যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু এই যুদ্ধেও বাদশাহর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। পরাজয়ের কারণ ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতা। শুরু হয় হুমায়ূনের যাযাবর জীবন।
একদিন মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য লুকিয়ে রাজদরবারে আসেন। সেখানে দেখা হয় হামিদা বানুর সাথে। হুমায়ূন যেকোনো মূল্যে হামিদা বানুকে বিবাহ করতে চান। এই হামিদা বানুই হয় বাদশাহর ৫ম স্ত্রী এবং দুঃসময়ের সঙ্গী। আর হামিদা বানুর গর্ভেই জন্মায় পৃথিবীর সেরা নৃপতি সম্রাট আকবর। স্ত্রী হামিদা বানুর সাথে শুরু হয় সম্রাটের পথেপ্রান্তরের জীবন। হুমায়ূন বিভিন্ন দুর্গে আশ্রয় নেন। সকলেই আশ্রয় দিলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে কোহিনূর হিরা নেওয়া এবং সম্রাটকে শেরশাহের হাতে তুলে দেওয়া। সেনাপতি বৈরাম খাঁ নিজের জীবনের বিনিময়ে সম্রাটের জীবন বাঁচান।

১৫৪২ সালে জন্ম হয় আকবরের। শিশুপুত্রকে নিয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকেন তাঁর পিতা-মাতা। বাদশাহ হুমায়ূন আজ বড়ই ক্লান্ত। তিনি এভাবে আর পারছেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পারস্য হয়ে মক্কা চলে যাবেন। তাই তিনি পারস্যের সম্রাট শাহ তামাস্পের কাছে আশ্রয় নেন। এদিকে পারস্যের সম্রাটের কাছে মীর্জা কামরান পত্র পাঠান হুমায়ূনকে জীবিত বা মৃত তাঁর হাতে তুলে দিতে; বিনিময়ে তিনি কান্দাহার পারস্য সম্রাটকে উপহার দিবেন।
কিন্তু শাহ তামাস্প তা করলেন না। তিনি হুমায়ূনকে সকল প্রকার সাহায্য করলেন মোঘল সম্রাজ্য ফিরে পেতে। হুমায়ূন প্রথমে কান্দাহার জয় করলেন, এরপর কাবুল। হুমায়ূন আবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলেন। এর মধ্যে সেনাপতি বৈরাম খাঁ সিকান্দার শাহকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। বাদশাহ হুমায়ূন সুস্থ হলে ১৫৫৫ সালের ২৩ জুলাই দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

আমার উপলব্ধি : বইটি পড়তে গিয়ে কিছু ঘটনা পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো-
বাদশাহ প্রজাদের দুঃখ কষ্ট দেখার জন্য ছদ্মবেশে রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন। নদীর ঘাটে দেখেন একটি অল্প বয়সী মেয়েকে সতীদাহ করা হচ্ছে। বাদশাহ মেয়েটিকে উদ্ধার করে দরবারে নিয়ে আসেন। মেয়েটি বাদশাহ কন্যার সঙ্গী হিসেবে তার সাথে থাকে। এখানে জাতি, ধর্মের মধ্যে বাদশাহ কোনো পার্থক্য করেননি।
বাদশাহর দক্ষ কামানচি রুমী খাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তিনি চুনার দূর্গ দখলের সময় ৩৫০ জনের হাত কেটে নেওয়ার আদেশ দেন। রুমী খাঁ বলেন, অভিযোগ সত্য। আমি যা করেছি সম্রাটের নিরাপত্তার জন্য করেছি। কারণ তারা সবাই দক্ষ কামানচি। হুমায়ূন এতে ভীষণভাবে অখুশি হন। তিনি বলেন, আপনি ভয়াবহ অন্যায় করেছেন। তার শাস্তি আপনার দুই হাত কেটে নেওয়া। এখানে বাদশাহ হুমায়ূন ন্যায়বিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
বাদশাহ যখন দিল্লির সিংহাসনে বসেন তখন গরীব ভিসতিওয়ালা তার সাথে দেখা করেন। হুমায়ূন তাঁর ওয়াদা রক্ষায় একদিনের জন্য তাকে সিংহাসনে বসান। এতে দরবারের সবাই হাসাহাসি করেন। হুমায়ূনের ভাইয়েরা এটি মেনে নিতে পারেননি। সকলেই যুক্তি দিয়ে বাদশাহকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। উত্তরে বাদশাহ বলেন যুক্তি দিয়ে সবকিছু হয় না। যুক্তির উপরে অবস্থান করে মানুষের হৃদয়। দুঃসময়ে আমরা অনেক কথা দিলেও পরে তা ভুলে যাই। বাদশাহ কিভাবে কথা রেখেছেন তা সত্যিই শিক্ষণীয়।

মীর্জা কামরান বাদশাহকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু তা প্রকাশ পেলে তার শাস্তি হয় মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু বাদশাহ হুমায়ূন তাকে ক্ষমা করে দিয়ে তার সাথে আলিঙ্গন করেন। বাদশাহ বলেন আমার মহান পিতা মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন, তুমি সবসময় ভাইদের দেখবে ক্ষমাসুন্দর চোখে। তারা তোমার প্রতি নির্দয় হতে পারে কিন্তু তুমি হয়ো না। সময়ের সাথে সাথে আমরা কতোকিছু ভুলে যাই। দিল্লির সম্রাট পিতার আদেশ ভুলে যাননি।
বাদশাহ হুমায়ূন যখন হামিদা বানুকে বিবাহের প্রস্তাব দেন তখন হামিদা বানু বলেন, আমি এমন একজনকে বিবাহ করিব চাইলেই যেন তার হাত ধরতে পারি, তার পাশাপাশি বসে জোসনা দেখতে পারি। এমন কাউকে বিবাহ করিব না যার সামনে যেতে তিনবেলা আমাকে কুর্নিশ করতে হবে। এখানে হামিদা বানুর কতো সরল উত্তর। কতো সুন্দর জীবনবোধ। যেখানে অর্থ, যশ, খ্যাতির প্রতি তার কোনো লোভ নেই।

সাহসী এবং বিশ^স্ত সেনাপতি বৈরাম খাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি- ‘যুদ্ধ এবং প্রেমে কোনো কিছুই পরিকল্পনা মতো হয় না।’ পাঠকরা জানেন মোঘল সাম্রাজ্যে বৈরাম খাঁর অবদান কতটুকু। কিন্তু হুমায়ূনপুত্র আকবর যখন সিংহাসনে বসেন তখন বাধ্য করেন বৈরাম খাঁকে মক্কা যেতে। আবার পথে আকবরের গুপ্ত ঘাতকরা বৈরাম খাঁকে হত্যা করে। এই ঘটনা পাঠক হৃদয়কে ব্যথিত করেছে। মোঘল শাসকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে পাঠক মনে।
সর্বশেষে বলি, অমর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শেষজীবনে এসে ইতিহাস আশ্রিত একটি অসাধারণ উপন্যাস রচনা করেছেন। মনে হয় উপন্যাসটি বার বার পড়ি। পড়া শেষ হলেও ঘোর কাটতে সময় লাগে অনেক দিন। সুখপাঠ্য একটি উপন্যাস। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, পাঠক উপন্যাসটি পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না।

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।