কি লিখবেন, কেন লিখবেন

হাসান ফেরদৌস
উত্তর আমেরিকায় অভিবাসী বাঙ্গালির সাহিত্য চর্চা নিয়ে যেকোনো আলোচনায় ‘ডায়াসপোরা’র শব্দটি ফ্যাশনদুরস্ত হলেও অনাবাসী শব্দটি আমার অধিক অর্থপূর্ণ মনে হয়। ইহুদীরা একসময় নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই উন্মূল ইহুদীদের প্রসঙ্গেই ডায়াসপোরা ধারণাটি ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। তারা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত কিন্তু বুকের মধ্যে নিরন্তর স্বদেশ। যতদিন আগেই মূলচ্যুত হোক অথবা যতদূরেই তারা আশ্রয় পাক, নিজের দেশকে তারা ভোলেনি। নিজের ভাষাকেও নয়। আজ অথবা আগামী কোনো একদিন তারা স্বদেশে ফিরে যাবে, যে স্বদেশভূমি ঈশ্বর তাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন। এই গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের নিত্যদিনের সকল কর্মকাণ্ডে।
বাঙালি- অধিকাংশ বাঙালি- বিতাড়িত হয়ে স্বদেশ ছাড়েনি। স্বেচ্ছায়, ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছেড়েছে। অল্প-স্বল্প রাজনৈতিক উদ্বাস্তু ছাড়া অধিকাংশের নিজ দেশে ফিরে যাবার পথটাও খোলা। বাঙ্গালি-মার্কিন লেখক অমিতাভ ঘোষ নিজেকে ‘ভারতীয় ডায়াসপোরা’র একজন সদস্য ভাবেন, যদিও বছরের একটা বড় সময় তিনি কলকাতায় কাটান। এই ভারতীয়-আমেরিকান লেখক একসময় আমাকে বলেছিলেন, তিনি অনেকটা সেই কম্পাসের মতো যার বড় কাঁটাটা কলকাতার মাটিতে, বাকি কাঁটাটা সারা বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছে। এই বক্তব্য অনুসারে অমিতাভ ঘোষকে- এবং স্বদেশত্যাগী বাঙ্গালিকে – ‘ডায়াস্পোরিক’ না বলে অনাবাসী বললেই বোধহয় অধিক সঙ্গত হবে। তাদেরও একটি কাঁটা দেশে, একটি কাঁটা বিদেশে।
এই অনাবাসী বাঙালি, তা সে যেখানে ও যতদূরেই যাক, সঙ্গে করে নিয়ে যায় নিজ ভাষা, সাহিত্য, সংগীত ও রন্ধনকলা। দলাদলি ও কোন্দলের সংস্কৃতিও। একশ বছর আগেও উত্তর ভারতে বসবাসরত ‘অনাবাসী’ বাঙ্গালিরা সাড়ম্বরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করত। একবার লখনৌতে প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে এসে রবীন্দ্রনাথ অনাবাসী বাঙ্গালির বাংলা সাহিত্য প্রীতি দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন। পরে, তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ’ শীর্ষক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, নদী যেমন স্রোতের পথে নানা আপন নানাদিকগামী তটকে এক করে নেয়, আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তেমনি নানা দেশ ও প্রদেশের বাঙ্গালির হৃদয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাকে একই প্রাণধারায় মিলিয়েছে।
‘সাহিত্যে বাঙালি আপনাকে প্রকাশ করেছে বলেই, আপনার কাছে আপনি সে আর অগোচর নেই বলেই, যেখানে যাক আপনাকে আর সে ভুলতে পারে না। এই আত্মানুভূতিতে তার গভীর আনন্দ বৎসরে বৎসরে নানা স্থানে নানা সম্মিলনীতে বারম্বার উচ্ছসিত হচ্ছে।’
প্রবাসী বা অনাবাসী হলেও বাঙালি কীভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আঁকড়ে থাকে তার এক সেরা উদাহরণ অতুলপ্রসাদ সেন। সেই একই প্রবন্ধে কবিগুরু তাঁর যশস্বী সে বন্ধুর নাম নিয়ে বলেছিলেন, অন্য প্রদেশবাসীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বাঙালি-হৃদয়ের মিলন অসম্ভব নয় তার অতি সুন্দর দৃষ্টান্ত অতুলপ্রসাদ সেন।
কবিগুরুর এই কথা আজকের মার্কিন প্রবাসী অনাবাসী বাঙালি সাহিত্যরসিক সম্বন্ধেও। তবে এখানে একটি ‘কিন্তু’ যোগের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলা সাহিত্যপ্রেমী যে বাঙালির কথা বলা হচ্ছে, সে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। তার চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রে এখনো ফেলে আসা স্বদেশ ও শৈশব। এক বা দুই প্রজন্মের ব্যবধানে এই পিছুটান অনেকটাই বদলে যায়। প্রথম প্রজন্ম পড়ে থাকে রবি ঠাকুরের গান নিয়ে, দ্বিতীয় প্রজন্ম মজে ডুয়া লুপায়।
প্রথম প্রজন্মের বাঙ্গালির অনাবাস যতই দীর্ঘ হোক, অথবা ফিকে হয়ে আসুক স্মৃতি, তবুও জাবর কাটার মতো সেই একই জীবনে সে বারবার প্রত্যাবর্তন করে। এই প্রত্যাবর্তনের একটি কারণ বোধ করি এই যে মানসিক ভাবে সে কখনোই দেশত্যাগ করেনি। যত দীর্ঘই তার অভিবাসন হোক না কেন, নতুন যে বাসভূমিকে সে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে, তার সাথে কোনো প্রকৃত আত্মিক যোগাযোগ (ঝ ৩-এর পাতার পর)
কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে শূন্যতা সে মনের মধ্যে বহন করছে, সময় ও অবস্থানগত বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও তা পূরণ হয় না। মনের মধ্যে যে স্বদেশ, সাহিত্যে তাকে সে পুনঃপুন নির্মাণ করে। মিলান কুন্ডেরা এই মানসিকতাকে ‘ঁহধঢ়ঢ়বধংবফ ষড়হমরহম ঃড় ৎবঃঁৎহ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
রবি ঠাকুর এই স্বদেশপ্রবণতাকে উদ্যাপন করেছেন। আরেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক সালমান রুশদী সেই প্রবণতাকে অনিবার্য মেনে নিয়ে তার একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। অভিবাসী লেখক যে জীবনাভিজ্ঞতার কথা লেখেন, রুশদীর ভাষায় তা এক কাল্পনিক বাসভূমি, ইমাজিনারি হোমল্যান্ড। একটি রঙ ওঠা পুরোনো ফটোগ্রাফের উদাহরণ দিয়ে কথাটা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।
‘আমি যে ঘরে বসে কাজ করি তার দেয়ালে একটি পুরোনো ফটোগ্রাফ রয়েছে। ১৯৪৬ সালে তোলা ছবি, তখনো আমার জন্ম হয়নি। বাড়িটা বিচিত্র, তিনতলা, টালির ছাদ, মাথাটা চৌকো, দুই ধারে গোলাকার দুই টাওয়ার, উভয়ের মাথায় চৌকো টোপর পরা। ‘অতীত একটি ভিন্ন দেশ,’ এল পি হেনলি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস গো-বিটুইন- এ লিখেছেন। ‘সেখানে (অর্থাৎ বিদেশে) সবকিছু ভিন্নভাবে করা হয়।’ কিন্তু দেয়ালের ছবিটা দেখে আমার উলটো কথা মনে হয়। মনে হয়, অতীত নয়, আমার বর্তমানই হলো ভিন্ন দেশ এবং অতীতই হলো স্বভূমি, যদিও হৃত সময়ের কুয়াশায় তা এক হৃত শহর – হৃত বাসভূমি।’
ডায়াস্পরিক সাহিত্য এই হৃত সময়ের হৃত বাসগৃহ ও হৃত বাসভূমি পুনর্নির্মাণে ব্যস্ত। হোক না ছবিটা অসম্পূর্ণ, হোক না তা আবছায়া। যেহেতু ছবিটা অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট, তাকে পুনর্নির্মাণ করতে প্রয়োজন পড়ে রূপকের। বাস্তব বদলে যায়, মুখ্য হয়ে পড়ে রূপক।
‘উত্তর লন্ডনে বসে আমার উপন্যাস (মিডনাইটস চিলড্রেন) লিখতে গিয়ে জানালার বাইরে যে শহর আমার চোখে পড়েছে এবং খাতার পাতায় যে শহরের কল্পনা আমি প্রকাশের চেষ্টায় ছিলাম, তা একে অপর থেকে একদমই আলাদা। শেষ পর্যন্ত আমাকে এই সত্যের মুখোমুখি হতে হল যে অবিকৃত অবস্থায় হারানো সময়ের খিড়কি খোলার আমার এই চেষ্টার ফলাফল আসলে স্মৃতি-ভিত্তিক একটি উপন্যাস ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। যে ভারতের কথা আমি লিখছিলাম, তা আর কিছু নয়, সে আমার নিজস্ব ভারত, আরও অসংখ্য ব্যক্তিগত ভারতের মতো আরেকটি সংস্করণ মাত্র।’
রুশদীর ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ আমি সচতন ভাবেই ডায়াস্পরিক হিসেবে বর্ণনা করেছি। একদিকে সময় তাঁর কাছে স্থির-অনড়, তিনি চান এই স্থৈতিক সময়, যা তার স্মৃতির কবন্ধে বন্দী, তার নবায়ন। কিন্তু একথাও তিনি জানেন কিছুতেই সে নবায়ন সম্ভব নয়। ‘আমার আশা ছিল, আমি যদি যথেষ্ট প্রাণবন্তভাবে সেই সময় কল্পনায় ধরতে পারি, তাহলে এমন চিত্র নির্মাণ সম্ভব যেন মনে হবে আমি কখনোই ভারত ত্যাগ করিনি। কিন্তু তা অসম্ভব, কারণ আমার সকল চরিত্র বদলে গেছে। ফলে গতকালকে আমি কেবল আমার আজকের প্রয়োজনকে সিদ্ধ করতেই ব্যবহার করতে পারি, যে অভিযাত্রায় স্মৃতি একটি হাতিয়ার মাত্র।’
রুশদীর এই কথা ভেঙ্গে দেখলে এই দাঁড়ায় যে, ডায়াস্পরিক লেখক গতকালকে অনুসরণ করে বটে, কিন্তু তা কেবল তার যাপিত বর্তমানকে পরিপূর্ণভাবে অনুধাবনের জন্য। উভয় অনুসন্ধানের লক্ষ্য একটাই, কোথায় নিজের স্থানÑ গতকালের গৃহে অথবা আজকের দিনযাপনে, তার নির্ণয়। একই অনুসন্ধান দেখি বাঙালি আমেরিকান লেখক তণ্বী নন্দিনী ইসলামের উপন্যাস ‘ব্রাইট লাইন্স’-এ। এর শুরু গতকালে নয়, আজকের নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে। রুশদীর উপন্যাসে দেশ (‘হোম’ এই অর্থে) মানে মানচিত্রে চিহ্নিত করা যায় এমন একটি সত্য। তণ্বীর কাছে দেশ মানে গৃহ অথবা অনেক সময় কেবলই একটি কক্ষ, তা ব্রুকলিন, ঢাকা অথবা সিলেট যেখানেই হোক। তার এই উপন্যাসে বাংলাদেশ ও নিউইয়র্ককে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে ঝুলিয়ে রাখা স্থৈতিক অভিজ্ঞতা নয়, তারা প্রতিনিয়ত একে অপরের স্থান পরিবর্তন করে। যা গতকাল তা আজ এবং যা আজ তা গতকাল। গ্রন্থের প্রতিটি চরিত্র, যারা প্রত্যেকের অতি নিকটবর্তী অথচ প্রত্যেকে একে অপরের অপরিচিত, একই সম্ভাবনার অপেক্ষায়, আর তা হলো কখন কীভাবে তারা নিজ গৃহ খুঁজে পাবে। অভিবাসীর এই নিয়তি যে সে অনুসন্ধান কখনোই শেষ হয়না, কখনোই সে গৃহ ধরা দেয় না।
অমিতাভ ঘোষ, যাকে ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যের বলিষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে ভাবা হয়, তিনিও ঘর ও বাহিরের নৈকট্য ও দূরত্বকে সমার্থবোধক অর্থে দেখেছেন। তিনি নিজের ঘরই খুঁজছেন, কিন্তু তা খুঁজে পেতে তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে বিশ্বে। ভারতীয়-ক্যারিবীয় লেখক ভি এস নাইপলের সঙ্গে নিজের প্রতি তুলনায় সম্মতি জানিয়ে তিনি একসময় মন্তব্য করেছিলেন, নাইপল শুধু ত্রিনিদাদে আটকে থাকতে চাননি, তিনি বিশ্বকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। ঠিক তিনি নিজে যেমন মিসর, বার্মা অথবা কম্বোডিয়ায় নোঙর ফেলেছেন। অমিতাভের বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রে আগত অভিবাসী- ডায়াস্পরিক- লেখকের অভিজ্ঞতাও তাই। কোনো একটি আত্ম-পরিচয়ের মোড়কে তাকে আটকে রাখা কঠিন। এমনকি এই সময়ের অভিবাসী লেখকের কথা বলতে গিয়ে ডায়াসপোরা কথাটা ব্যবহার করাও যথোপযুক্ত নয়। ‘কারণ, লেখক আসলে ডায়াসপোরা নামক সতত সঞ্চরণশীল অস্তিত্বের একজন নাগরিক।’
২।
ঠিক যে অর্থে রুশদী, অমিতাভ বা তণ্বী সমকালীন ভারতীয় ডায়াসপোরার প্রতিনিধি, অভিবাসে এই মুহুর্তে যারা বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন, তারাও কি সেই একই ধারার প্রতিনিধি? হয়ত। শুধু ভাষাগত ভিন্নতার কারণে তাদের সাহিত্য চরিত্র ভিন্ন হবে, একথা বলা অবান্তর। তবে প্রভেদ যে নেই তা নয়।
প্রথমত, অভিবাসী বাংলা সাহিত্য চর্চার ধারাটি এখনো যথেষ্ট বেগবান নয়। পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত হাতে গোণা কয়েকজন বাদ দিলে এখন যারা সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত, তাদের উৎসাহ যতটা লক্ষণীয়, নির্মাণ সাফল্য ততটা নয়। এখনো কোনো রুশদী, অমিতাভ বা তণ্বীকে আমরা খুঁজে পাইনি।
দ্বিতীয়ত, এই ধারার অধিকাংশ লেখকই এমন যাদের সৌখিন বলা অন্যায় নয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথম যখন বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে লখনৌ আসেন, প্রবাসীদের বাংলা ভাষার প্রতি দরদ এবং বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃত সাহিত্যগুণ সম্পন্ন লেখকের উদাহরণ দিতে গিয়ে সেই এক অতুলপ্রসাদ সেনের কথাই বলেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে এখন যারা বাংলা সাহিত্যচর্চা করেন, তাদের বাংলা ভাষার প্রতি দরদ ও আগ্রহ কোনো অংশেই কম নয়। কিন্তু সাহিত্য গুণসম্পন্ন রচনার জন্য যে শ্রম ও মেধা প্রয়োজন, তার লক্ষণীয় খামতি তাদের মধ্যে রয়েছে। তদুপরি, এই চর্চা কার্যত শুধু প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যেই সীমিত। নিজেদের বাঙালিত্ব ধরে রাখতে এরা ঐকান্তিক, ফলে বছরজুড়ে সংগীত সম্মেলন, কাব্য সম্মেলন এবং বই মেলার আয়োজন চলে। যারা এই কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন তারা শুধু যে প্রথম প্রজন্মের সদস্য তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই নবাগত অভিবাসী। প্রবাসে বৈরী সাংস্কৃতিক আবহে এরা আত্ম-পরিচয়ের সংকটে ভোগেন। এই সংকট কাটাতে গঠিত হয় ‘আঞ্চলিক’ তকমা আঁটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। নিজেদের গুণগতভাবে স্বতন্ত্র প্রমাণে আগ্রহী অনেক বাঙালি আঞ্চলিক সংগঠনের বদলে নিয়মিত সাহিত্য আসর করেন, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন, প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যার অধিকাংশই কবিতা। মুজতবা আলীর ভাষা ধার করে বলা যায়, এই সাহিত্যচর্চার কনজ্যুমার ও প্রডিউসার উভয়েই অভিন্ন। অর্থাৎ এরা নিজেরাই লেখেন, নিজেরাই পড়েন। আমার এক বন্ধু এই প্রবণতাকে নার্সিসিজম বলেছেন, আমি বলি স্বমেহন।
তৃতীয়ত, মোটের ওপর যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো, এরা সবাই নিজেদের বাঙালি চরিত্র নির্মাণ ও পুনরুদ্ধারে আগ্রহী। জীবন যাপনে অভিবাসী হলেও সাহিত্য রচনার সময় এরা সবচেয়ে সরবে নিজের বাঙালি অভিজ্ঞতার কথা বলতেই উৎসাহী। ডায়াসপোরা সাহিত্যের একটি অনিবার্য উপাদান এলিয়েনেশন- বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু যে অভিবাসী লেখকের কথা বলছি, তাদের অধিকাংশ প্রাত্যহিক দিন যাপনে যে বৈকল্যের সম্মুখীনই হোন না কেন, সাহিত্যে তার প্রকাশ কার্যত শূন্য। এর একটি কারণ, আমার মনে হয়, এদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত জীবনচারিতায় চতুর্পাশ্বস্থ প্রবহমান বাস্তবতার ব্যাপারে অনাগ্রহী ও অংশগ্রহণবিমুখ। জীবনচারিতায় যেমন, মনোজগতেও এরা এমন একটি দুর্ভেদ্য বর্ম গড়ে তোলেন যে মূলধারার সংস্কৃতি এদের অগম্যই থেকে যায়। রাজনৈতিকভাবে সচেতন এমন অভিবাসী লেখক রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন পূর্বে স্বদেশ ত্যাগ করা সত্ত্বেও সেই ফেলে আসা স্বদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনায় আন্দোলিত হন এবং সাহিত্যে- বিশেষত কবিতায়- তার প্রকাশ ঘটান। রুশদী চেয়েছিলেন নিজের ফেলে আসা স্বদেশে ফিরতে, পারেননি। এরা ঠিকই নির্বিঘ্নে প্রতিদিন সেখানে পৌঁছে যান, অথবা ভাবেন যে তারা ফিরে গেছেন।
অনাবাসী সাহিত্যচর্চার আরও একটি লক্ষণীয় প্রবণতা, শ্রম বিমুখতা। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে অন্য অনেক কিছুর মতোই সাহিত্যচর্চাও সুলভ ও সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। ফেসবুকের কল্যাণে এখন যেকেউ লেখক হতে পারেন। সম্পাদকের শ্যেন দৃষ্টির ভয় নেই, বাছ-বিচারের বালাই নেই, এমনকি বানান শুদ্ধিকরণেরও প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয়, সাহিত্যের জন্য এই নয়া তথ্যপ্রযুক্তি আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ।
অথচ এই বেনো জলের ভেতরেও চোখে পড়ার মতো বই প্রকাশিত হচ্ছে, মননশীল রচনা তৈরি হচ্ছে। এর কোনোটাই পরিকল্পিত উদ্যোগ বা সাংগঠনিক চেষ্টার ফল নয়, ব্যক্তিগত শ্রম ও মেধার ফল। এদের সংখ্যা এখনো এত সামান্য যে কোনো ট্রেন্ড বা ধারা নির্মিত হয়নি, চিহ্নিতযোগ্য বৈশিষ্ট্য সংজ্ঞায়িত করাও কঠিন। নজর পড়েছে এমন তালিকায় গদ্য-পদ্য তো রয়েছেই, মৌলিক অনুসন্ধানী ও গবেষণা গ্রন্থও রয়েছে। সবচেয়ে উজ্জ্বল না হলেও প্রাসঙ্গিক এই বিবেচনায় আমি তিনটি সাম্প্রতিক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করছি।
এক, মনিজা রহমানের ছোটগল্প সংকলন ‘হৃদয়বোধক চিহ্ন’ (পেনসিল পাবলিকেশন্স, ঢাকা ২০২১)। মোট তেরোটি গল্পের সংকলন, অধিকাংশ গল্পই প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতার সাংবাদিকসুলভ বিবরণ। তারা কিছুটা নিরাভরণ, অহেতুক অলঙ্কার-বিবর্জিত ও মোটের ওপর একরৈখিক। শুধু বাঙালি নয়, অন্য দেশীয় অনাবাসী নারী-পুরুষ তারাও মনিজার গল্পের পাত্র-পাত্রী। ভিন্ন জাতি, ভিন্ন সংস্কৃতি, অথচ অভিজ্ঞতার নিক্তিতে তারা সবাই একই গোত্রভূক্ত, সবাই বহু বর্ণিল একটি মোজাইকের রেখাচিত্র। এই অভিন্নতা গল্প সমূহকে মানবিক ও সার্বজনীন করে তোলে। মনিজা নিজে সাম্প্রতিক অভিবাসী, প্রবাস জীবন সম্বন্ধে তার স্বাভাবিক ঔৎসুক্য ও অনুসন্ধিৎসা দিয়ে অনাবাসী নয় এমন বাঙালি পাঠককে আকৃষ্ট করবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিও এই গল্পগ্রন্থে অবহেলিত হয়নি। যেমন, একটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-ভিত্তিক গল্প রয়েছে, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের হাতে বিদেশি পুরোহিত ফাদার উইলিয়ামস ইভান্সের হত্যার সে কাহিনি আন্তরিক, কিন্তু প্রবাসী অভিজ্ঞতার মোড়কে তার বয়ান চেষ্টা কিছুটা কৃত্রিম।
শুধু মনিজা নয়, অন্য অনেক সাম্প্রতিক বাঙালি অভিবাসীর লেখায় একই সঙ্গে দেশ ও বিদেশের সহাবস্থান লক্ষণীয়, যেখানে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা উভয়ই সহজে ইন্টারচেঞ্জেবল বা স্থানান্তরযোগ্য। সকল অনাবাসী লেখকের মতো মনিজার কন্ঠস্বরেও অপহৃত শৈশবের জন্য স্মৃতিকাতর বিষণ্নতা রয়েছে, তবে ভাবালুতা পরিহারে সচেতন প্রয়াস থেকে এমন বোধ জাগে যে এই লেখক এখন তার অভিবাসী জীবনকে চুড়ান্ত নিয়তি হিসেবে গ্রহণে প্রস্তুত।
দুই, আদনান সৈয়দের ‘শিপ জাম্পার: বাঙ্গালির আমেরিকা যাত্রা’ (মুক্তধারা, নিউইয়র্ক ২০২০)। মোট আট অধ্যায়ে বিভক্ত ২১৫ পাতার এই গ্রন্থ পূর্ব বাংলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের তথ্যভিত্তিক মানবিক ইতিহাস। এই অভিবাসন প্রক্রিয়ার শুরু উনিশ শতকের শেষ মাথায়। ভারত তখন পরাধীন। কালাপানি পেরিয়ে বিদেশ যাত্রা প্রায় অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। ঔপ্যনিবেশিক প্রভুদের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণে ইংল্যান্ডে যাওয়ার ঘটনা হয়ত অস্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু সেই ইংল্যান্ড থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ও অজ্ঞাত সভ্যতার আমেরিকায় আগমন কেবল অস্বাভাবিক নয়, অভাবিতও বটে। আদনানের বই পড়ে জানা গেল, এই অভাবিত কাজটি পূর্ব বাংলার একদম সাধারণ মানুষ, যাদের অনেকে প্রান্তিক মানুষ – কৃষিজীবী অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী – একদম প্রত্যন্ত বাংলা থেকে বিপুল বাঁধা এড়িয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন। কেউ সিলেটের, কেউ সন্দ্বীপের।
আদনান একে বাঙ্গালির অভিযাত্রা বলেছেন। অধিকাংশই জাহাজের খালাসি অথবা নিম্নবর্গের জাহাজি শ্রমিক। পকেটে পয়সা নেই, ইংরেজি জ্ঞান সামান্য, কিন্তু বুকে অপরিসীম সাহস। লোকমুখে এদের পরিচয় শিপ জাম্পার, জাহাজ সমুদ্র বন্দরে ভিড়লে অভিবাসন পুলিশের নজর এড়িয়ে শহরের জনারণ্যে তারা হারিয়ে যেতেন। এই বইটি তাদেরই গল্প, অথবা আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, সেই প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী পাইওনিয়রদের উত্তরসূরীদের গল্প।
এই গল্প আদনানই যে প্রথম করলেন তা নয়। মুজতবা আলীর লেখায় আমরা এদের পরিচয় পেয়েছি। ২০১৫ সালে মার্কিন গবেষক ভিভেক বল্ড তাঁর ‘বেঙ্গলি হার্লেম’ গ্রন্থে প্রথম বাঙালি জাহাজিদের প্রামাণিক কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন। আদনানের বইটির স্বাতন্ত্র্য এই যে, একশ’ বছরেরও আগে সমুদ্র ডিঙ্গিয়ে আমেরিকায় যারা পা রাখেন তাদের জীবিত বংশধরদের খুঁজে বের করে তাদেরই বয়ানিতে তিনি সে অভিযাত্রার গল্পটি পুনর্নির্মাণ করেছেন। আদনান জানাচ্ছেন, ১৮৯৭ সালে মোট ১২ জন পূর্ব বাংলার নাবিক নিউইয়র্কে পা রাখেন, তাদের একদল আশ্রয় পান নিউইয়র্কের কৃষ্ণকায় অধ্যুষিত হার্লেমে, বাকিরা আমেরিকার দক্ষিণে নিউ অরলিন্স অঙ্গরাজ্যে, মুখ্যত স্থানীয় আফ্রিকান-আমেরিকানদের আতিথেয়তায়। এক ব্রাত্য মানুষ অন্য আরেক ব্রাত্য মানুষের আশ্রয়ে। প্রেম-প্রণয়, তাও এদের সঙ্গেই। তিন প্রজন্ম পর এদের অনেকেই পুরোদস্তুর কালো মানুষ, অনেকে এক বর্ণ বাংলাও জানেন না, অথচ প্রয়াত পিতৃপুরুষের স্মৃতি তারা সাগ্রহে বহন করছেন।
আদনান তার এই গ্রন্থের জন্য ভিভেক বল্ডের কাছে গভীরভাবে ঋণী, সে ঋণের স্বীকৃতি আদনানের গ্রন্থে সর্বত্র রয়েছে। বলতে পারি, ভিভেকের গল্প যেখানে শেষ, আদনানের গল্প সেখান থেকে শুরু। আমেরিকায় প্রথম বাঙালি শিপ জাম্পারদের বংশধরেরা, যাদের খুঁজে বের করে তাদের জীবনঘনিষ্ঠ বিবরণ উপস্থিত করা হয়েছে এই গ্রন্থে, তারা সবাই আমাদের আশপাশেই বাস করেন, অথচ তারা আমাদের অপরিচিত। বলতে পারি, আদনান আমাদের উভয়ের আত্মীয়তার পুরানো বন্ধনটি নতুন করে জুড়ে দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেন।
৩।
লায়লা ফারজানার ‘ঝরাপাতার র‌্যাপসোডি (মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০২২)। পেশায় স্থপতি, কিন্তু মেজাজে ফারজানা জাত কবি। মোট ৫৫টি কবিতার এই কাব্যগ্রন্থ আগাগোড়া বিষণ্ন, আশ্চর্য রকম নির্জন, অথচ তা কেবলই হতাশার পুনঃপুন উচ্চারণ নয়। প্রতিটি কবিতাই বৈপরীত্যময়, কন্ট্রারিয়ান। গ্রন্থের নামকরণ বিবেচনা করুন। মৃত্যু অথবা প্রস্থানের প্রতীক ঝরাপাতা। সেই বিবর্ণ ঝরাপাতার কান্না নয়, তাদের আবেগঘন মহাকাব্য -র‌্যাপসোডি – শোনাতে চান ফারজানা। একদম নতুন এক কাব্যভাষায় রচিত হয়েছে এই গ্রন্থ, যার সুর অনুচ্চ ও ব্যক্তিগত, যার রেখাচিত্র ছায়াময় অথচ আবেগঘন। ব্যক্তিগত উচ্চারণে অথবা শব্দহীন দীর্ঘশ্বাসে ফারজানা আমাদের জানান, আজ- অথবা এই মুহুর্ত যতই ঘন তমসাময় মনে হোক, আসন্ন একদিন তা কেটে সকাল হবে, আলো ফুটবে। ‘ফিনিক্স’ এই নামের কবিতাটির কথা ধরুন। পৌরাণিক পাখি ফিনিক্স, আগুনে পুড়ে বারবার সে ছাই হয়, বারবার সে ছাই থেকে জেগে ওঠে নবজীবনে।
চুলার আঁচ বাড়িয়ে দাও
জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে যাক
ক্যালিফোর্নিয়ার গোলাপি সানসেটগুলো।
কবিতাটি এই যন্ত্রণাময় আত্মসমর্পনে শেষ হয় না, মৃত্যুর পরেও যে জীবন থাকে ফারজানা নির্দ্বিধায় তার অপেক্ষার কথা বলে। তাই কবিটাটি শেষ হয় এইভাবে :
আর আমি- পোড়া ছাইয়ের অতলান্ত থেকে উত্থিত
স্ফুলিঙ্গে ডানা ছড়ানো পৌরাণিক পাখি।
অভিবাসে বেড়ে ওঠে তরুণী ফারজানা, স্বদেশ তার স্মৃতি ও অন্তর্চেতনায় এখনো ধুসর নয়। সম্ভবত সে কারণেই স্বদেশ তার জন্য কেবল নস্টালজিয়া নয়, সে নিকট-অতীত এক অতিক্রান্ত সময়ের চিহ্নহীন যোগসূত্র, তার ছায়াহীন সাঁকো। এই দুই জগত- গতকাল ও আজ, ঘর ও বাহির, ভিন্ন ভিন্ন অথচ সমান্তরাল গবাক্ষ পথে তার কাছে ধরা দেয়। সে একই সঙ্গে বাঙালি ও দেশান্তরী এক অভিবাসী। ব্রুকলিন মিউজিয়ামের দেয়ালগুলো তার কাছে অনায়াসে লালবাগের ইটের প্রাচির হয়ে যায়, সে দেখে ইস্ট রিভারে নাও ভাসিয়েছে কেতুপুরের কুবের মাঝি, তার চোখে ভাসে সেন্ট্রাল পার্কের স্ট্রবেরি ফিল্ডে দুরন্ত স্পাইডারম্যান হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে সত্যজিতের অপু। অথবা ব্যাটারি টানেলের পাশঘেষা কোনো স্টারবাকসে সে নির্দ্বিধায় চুমুক দেয় এলাচভেজা সুঘ্রাণী দুধচায়ে।
সুন্দর, ভারী সুন্দর!
আমার বিশ্বাস, বিশ্ব বাংলার নাগরিক এই রকম অভিবাসী প্রতিনিধিদের হাত দিয়েই রচিত হবে নতুন মহাকাব্য যা বাংলা সাহিত্যের মূলধারা থেকে ভিন্ন অথচ তার বাইরে নয়।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক