কুইন্স প্যালেসে আন্তর্জাতিক লোক সঙ্গীত সম্মেলন

সময়ানুবর্তিতার এক অনুপম নিদর্শন

ঠিকানা রিপোর্ট : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করে ১০ম আন্তর্জাতিক লোক সঙ্গীত সম্মেলন ও নজরুল মেলা-২০১৮ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ২১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার উডসাইডের কুইন্স প্যালেসে এক ব্যতিক্রমী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন হলো প্রকৃত উদ্বোধক এবং প্রধান অতিথি ছাড়াই। তারা উপস্থিত হতে পারেননি সময়মতো হয়তো পূর্ব অভিজ্ঞতায় তারা সমৃদ্ধ যে ‘প্রবাসে বাঙালিদের কোনো অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে শুরু হয় না।’
লোক সঙ্গীত সম্মেলন এক্ষেত্রে দারুণ এক ব্যতিক্রম। উদ্বোধনের সময় ছিল বিকাল ৪টা-২০ মিনিট। দর্শক খরা অগ্রাহ্য করে লোক সঙ্গীতের আয়োজকরা কোনো অজুহাতের আশ্রয় না নিয়ে আধুনিক সব অনুষ্ঠানের আয়োজকদের লজ্জা দিয়ে সময়ানুবর্তিতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ঠিক ৪-১৫ মিনিটে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করলেন নানা রঙের বেলুন উড়িয়ে। উদ্বোধক আসেফ বারী টুটুল এবং প্রধান অতিথি এটর্নি মঈন চৌধুরীর জন্য অপেক্ষা না করেই। এই দৃষ্টান্ত যদি দু-চারটি সংগঠনও অনুসরণ করে তবে এই প্রবাসে আমাদের সুনাম অনেক বৃদ্ধি পাবে। আয়োজকদের এই সাহস এবং উদ্যোগ কম দর্শক উপস্থিতির আফসোস সত্ত্বেও সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করলেন পল্লী গানের স¤্রাট কাজী নজরুলের বন্ধু আব্বাস উদ্দিনের পরম্পরা নজরুল সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ড. নাশিদ কামাল।
উদ্বোধনের পর শুভেচ্ছা বক্তব্য এবং সাধারণ আলোচনা শুরু করার আগে মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ এবং লোক সঙ্গীত সম্মেলনের অকৃত্রিম পৃষ্ঠপোষক মাহবুব আলী বুলুর প্রতি দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ইতিমধ্যে আসন গ্রহণ করেন আলোচনা সভার সভাপতি মোহাম্মদ আমানুল্লাহ, গেস্ট অব অনার নার্গিস আহমেদ, উদ্বোধক ড. নাশিদ কামাল, মমতাজ বেগম সুমি, আন্তর্জাতিক লোক সঙ্গীত সম্মেলনের প্রতিষ্ঠা নূর ইসলাম বর্মণ, নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, এমদাদুল হক। সেলিম ইব্রাহিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। রেকর্ডে পরিবেশন করা হয় আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত।

শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রধান সমন্বয়কারী সেলিম ইব্রাহিম, সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক হাজী আবদুর রহমান, সাংস্কৃতিক পর্ব সমন্বয়কারী এমদাদুল হক, আবু তালেব, বাবলী চৌধুরী, চান্দু হক, মোহর খান সেলিম মোরশেদ। মূল আলোচকরা আলোচনা করেন সামগ্রিকভাবে নজরুলকে নিয়ে। সবাই লোক সঙ্গীত সম্মেলনের এই প্রয়াস ভবিষ্যতেও ধরে রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, এর মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের সামনে বাংলাদেশের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব হবে। নজরুল এবং মাটির গানকে আমরা যত বেশি বুকের ওমে লালন করতে পারব, তত বেশি আমরা দেশকেও বুকের মধ্যে রাখতে পারবো।
ড. নাশিদ কামাল তার দাদু লোক সঙ্গীত স¤্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমেদের সঙ্গীত জীবন, নজরুলের সঙ্গে তার দাদুর সম্পর্ক, সেই সময়ের পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং মুসলমানদের জন্য সেই সময়ে সঙ্গীতচর্চার পরিপন্থি পরিবেশ নিয়ে কথা বলেন।
ঐ আলোচনায় নজরুল সম্পর্কে মূলত কিছু মৌলিক কথা বলেন নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সিরাজুল হক। তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দুর কবি বা মুসলমানের কবি ছিলেন না। সাম্প্রদায়িক কবিও ছিলেন না। তিনি ছিলেন সম্পূূর্ণ অসাম্প্রদায়িক কবি, মানবতার কবি। তাকে ভালো করে জানার জন্য বেশি বেশি পড়াশোনা, গবেষণা করা দরকার।
অনুষ্ঠানে ড. নাশিদ কামালকে আয়োজকদের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক কিছু উপহার তুলে দেয়া হয়। এরপর সেমিনার হয় ‘সার্বজনীন নজরুল’ এই শিরোনামে। সভাপতিত্ব করেন সেমিনার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম সুমি। আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিক মঈন উদ্দিন নাসের, প্রধান অতিথি এটর্নি মঈন চৌধুরী, লেখক খন্দকার আনোয়ার এবং মুহম্মদ ফজলুর রহমান সেমিনারের প্রসঙ্গটিকে নিয়ে আলোচকবৃন্দ নজরুলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে কথা বলেন। এবং কাজী নজরুল যে আজও কতটা প্রাসঙ্গিক সেই সত্য তার কবিতা, সঙ্গীত, গজল, শ্যামা সঙ্গীত, গল্প, উপন্যাসের বিষয়বস্তুর আলোচনা থেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ পর্যন্ত সব কিছুই চমৎকারভাবে উপস্থাপনা করেন লেখক সংগঠন উপস্থাপক এবিএম সালেহ উদ্দিন।

এরপর শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিজয়ী যারা তাদের পুরস্কার বিতরণ করেন এটর্নি মঈন চৌধুরী, নূর ইসলাম বর্ষণ, ফাহাদ সোলায়মান প্রমুখ। এরপর রাত ১১টা পর্যন্ত সবটাই ছিল সাংস্কৃতিক। মঞ্জুর কাদেরের সঞ্চালনায় কবিতা পর্বে অংশ নেন লুবনা কাইজার, নজরুল ইসলাম এবং কবি ও আবৃত্তি শিল্পী মুমু আনসারীর তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত মুগ জেবিন হাই, নূহা কাওসার এবং নাহরীন ইসলাম। এই ৩ জনের বিভিন্ন মেজাজের কবিতা আবৃত্তি সবাই প্রাণভরে উপভোগ করেন। নৃত্য পরিবেশনায় ছিল নীলা ড্যান্সের শিল্পীবৃন্দ। সঙ্গীতে বিদেশি শিল্পী, ভারতের বীনা বর্মণ, নেপালের সুমন বুদ্ধ এবং পাকিস্তানের জাফর ইকবাল। স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শাহনাজ পারুল, ডা. মেছের আহমেদ, সেলিম মোরশেদ, রোজী কবির, মোহর খান, মৌসুমী রহমান, ইত্তেহাদ মঞ্জু, জহির টিপু, রুবিনা শিল্পী, সুলতানা খানম, ফেরদৌসী ইকরাম, নিপা জামান, মিলন কুমার রায়, রিয়া রহমান, সেলিম ইব্রাহিম, ডানা ইসলাম, বাবলী হক, ডা. নার্গিস রহমান, ইসমাত আরা হক ইমা। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে ছিল শ্রাবণী সরকার, সুববহা গিয়াস, তাসফিয়া রুবায়েত কৌশী, সুমাইয়া অন্ত, সাদিয়া মোহন, ইনা হক, জয়া।
এই পর্ব উপস্থাপনায় ছিলেন সেলিম ইব্রাহিম ও লিসা রহমান। রাত ১০টায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন ড. নাশিদ কামাল ডানা ইসলামের উপস্থাপনায়। বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে সঙ্গীত পরিবেশন করেন অনুপ বড়–য়া, গোলাম সোহরাব, ফটিক চৌধুরী, শারমিন মহসিন, কান্তা আলমগীর, ইমদাদুল হক। আবৃত্তি শফুরুজ্জামান মুকুল। বিশেষ পরিবেশনা ছিল যদি বাঁশি আর না বাজে এবং গীতিনাট্য মেহের নিগার। সুর নামে একটি চমৎকার ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন ফাহাদ সোলায়মান।