কুকুরের কান্না

মুনিয়া মাহমুদ :

শীতের রাত। লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছি। উয়ু উয়ু করে কয়েকটা কুকুরের কান্নার শব্দে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়িতে দেখি রাত দুইটা। বুকের ভেতর ঢিবঢিব শব্দ শুনতে পাই। কুকুরগুলো একটানা মনের দুঃখে কাঁদছে। আমি উঠে পর্দা ফাঁক করে রাস্তার দিকে তাকাই। দেখি তিন-চারটা কুকুর আমাদের বাড়ির দিকে মুখ উঁচু করে কাঁদছে। ভয়ে আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। আমি বিছানায় গিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমার স্বামীকে ধাক্কা মেরে বলি, এই শোনো, কুকুর কাঁদছে। ও ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে, বাইরে অনেক ঠান্ডা, তাই কাঁদছে, বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ও আমার কথার কোনো পাত্তাই দেয় না। ইচ্ছা হচ্ছে কুকুরগুলোর গায়ে পানি ঢেলে দিই। একটানা এখনো কেঁদে চলছে। কী মহা যন্ত্রণায় পড়ি আমি! আতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে যায়। পানি খেয়ে গলা ভেজাই আর মনে মনে ভাবি, আম্মার কিছু হলো নাকি? দোয়া-দরুদ পড়তে থাকি। কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকার পর ওরা চুপ হয়। এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন অনেক কাজ। এক সপ্তাহ পর ছোট বোন মেলীকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস যাব। সে সবেমাত্র বিকম পাস করেছে লালমাটিয়া কলেজ থেকে। আমেরিকায় পড়াশোনা করার ইচ্ছা, তাই বিভিন্ন কোর্স করছে। আম্মা বড় ভাইয়ের কাছে আছেন। ওখানে ওনার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। আমাদের দুজনের মূলত আম্মাকে দেখতে যাওয়া। আমি যাওয়া-আসা মিলে ১০ দিন থাকব। কারণ, আমার অফিস করতে হবে। এদিকে দুই মাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। স্বামীকে ছেড়ে বেশি দিন থাকতেও ভালো লাগবে না। আম্মার অসুস্থতার কারণে বিয়ের রিসেপশন করা হয়নি। তাই আম্মার সুস্থতার অপেক্ষা করছি।

আম্মা এবং আমার তিন নম্বর বড় বোন মিনাপা বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর মেলীর মন খুবই খারাপ। আমি প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরলেই বলে, আমাকে কবে ভিসার জন্য নিয়ে যাবে। আমি ওকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব বুঝি না। কারণ ওর স্টুডেন্ট পাসপোর্ট। ভিসা ওকে দেবে না। আমি যখন তখন ভিসা পাই আমার অফিসের কারণে। যা-ই হোক, একদিন ওকে নিয়ে ভিসার জন্য গেলাম। আমি মেলীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নিয়ে আসি। কারণ, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ও ভিসা পাবে না। সে সময় এক দিনেই ইন্টারভিও ও ভিসা দিত। সৌভাগ্যক্রমে মেলী ভিসা পেয়ে যায়। ভিসা অফিসার যখন ওর হাতে ছোট্ট লাল কাগজ ধরিয়ে দেয়, তখন আমাদের অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়। আমি আর ও দৌড়ে এমবাসির বাইরে চলে আসি। এসে দেখি, আমার কাঁধে ব্যাগ নেই। আবার দৌড়ে ভেতরে ঢুকে ২ নং দরজায় টোকা না দিয়ে দ্রুত ঢুকে ব্যাগ নিয়ে বের হই। বাইরে দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। অসম্ভব একটা কাজ কীভাবে সম্ভব হলো, সেটা আমি ভাবতে থাকি এবং আল্লাহকে ধন্যবাদ দিই। তখন আমেরিকায় গভীর রাত। সুসংবাদ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করি না।
আমাদের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। প্রতিদিন অফিসের পরে মেলীকে নিয়ে নিউ মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোগ, গুলশান মার্কেট ঘুরি আর কেনাকাটা করি। দুজনের ভীষণ আনন্দ। আম্মাকে অনেক দিন দেখি না। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আম্মাকে দেখার। যাওয়ার এক দিন আগে আমরা সব ভাইবোন একত্রে ময়মনসিংহে বেড়াতে যাই। নৌকায় করে ঘুরি। মেলী অনেক ছবি তোলে। আর সারাক্ষণ একটুতেই হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে ওর ফরসা মুখ লাল হয়ে যায়। আমি তাকিয়ে দেখি আর ভাবি, কয়েক দিন আগেও ওকে এত আনন্দে দেখিনি। কত চেষ্টা করেছি ওকে আনন্দ দেওয়ার কিন্তু পারিনি। আজ ওর চেহারা দিয়ে আনন্দের আলোর বিচ্ছুরণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

এদিকে রাত হলেই আমার ভয় লাগে। কারণ রাতদুপুরে কুকুরদের একযোগে কান্না শুরু হয়। কুকুরগুলো এমনভাবে কাঁদে যে ওদের কান্না আমার বুকের ভেতর ঢুকে যায়। স্বামী শুধু বলে, ও কিছু না। শীতকালে কুকুর কাঁদে। ওর কথা বিশ্বাস করে ঘুমাই আর সকালে অফিসে গিয়ে প্রথমে ফোন করে আম্মার খোঁজ নিই। শুনলাম অপারেশন হয়ে গেছে, তবে অপারেশন-পরবর্তী জটিলতায় আম্মা রিকভারি রুমে আছেন। অবস্থা উন্নতির দিকে। শুনে অনেক স্বস্তি পাই।

আমাদের ফ্লাইটের দিন ঘনিয়ে আসে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে সিঙ্গাপুরে এক রাত থেকে পরদিন সকালে রওনা হয়ে যখন লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছাই, তখন দুপুর হয়ে গেছে। রোদে ঝলমল ঝকঝকে বড় বড় পাহাড়ের সারি দেখতে দেখতে টুপ করে প্লেন ল্যান্ড করে। একটুখানি ঝাঁকি খায়। মেলী পুরো ফ্লাইটে একটুও ঘুমায়নি। জিম ক্যারির মাস্ক মুভি দেখে খিকখিক করে হাসে এবং এটা-ওটা করে। আমি শুধু ওর আনন্দ দেখি। ২২ বছরের একটা মেয়ের বাচ্চাদের মতো আনন্দ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।

আমাদের নিতে ভাইবোনেরা আসে। আমরা সরাসরি এয়ারপোর্ট থেকে হাসপাতালে আম্মাকে দেখতে যাই। হলুদ রঙের কাগজের মতো ড্রেস পরে সবাইকে আম্মার রুমে ঢুকতে হয়। কারণ, আম্মার অপারেশন-পরবর্তী নিউমোনিয়া হয়েছিল। সে সময় হাসপাতালে ভিজিটরদের জন্য এত নিয়ম ছিল না। আমরা পাঁচজন আম্মার রুমে ঢুকি। নার্স একসঙ্গে এতজনকে দেখে আম্মাকে বলে, তুমি একজন ভাগ্যবতী মা, কারণ এখানে ভিজিটর অনেক কম। আর তোমার এতগুলো ছেলেমেয়ে। আমি তখন বলি, আরও আছে। মোট ১১ জন। ফিলিপিনো নার্স অবাক হয়ে তাকায়।

পরবর্তী সাত দিন আমার খুবই দ্রুত কাটে। প্রতিদিন এদিক-ওদিক বেড়াতে যাই। সবচেয়ে অবাক হয়ে যাই রাস্তায় গাড়ি দেখে। এত গাড়ি চলছে অথচ কোনো শব্দ নেই, শুধু শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া। ভাইবোনেরা একসঙ্গে ডিজনিল্যান্ড ঘুরি। মেলী খুব খুশি হয় ব্যাক টু দ্য ফিউচার শো দেখে। ইউনিভার্সাল স্টুডিও, সি ওয়ার্ল্ডÑএই কদিনে সব দেখা হয়ে যায়। আমি চলে আসার এক দিন আগে মলে যাই দেশের লোকজনের জন্য কেনাকাটা করতে। আমি নিজের জন্য কসমেটিকস কিনি। আমি লক্ষ করি, মেলী যা-ই হাতে নেয়, আমার কাছে দৌড়ে আসে পেমেন্টের জন্য। ও যা চায়, সবই আমি কিনে দিই। কারণ, ভাবি কবে আবার ওর সঙ্গে দেখা হবে। আমার এত আদরের ছোট বোন! ঢাকার সবার জন্য কিছু না কিছু কেনা হয়। কিছু ফরমায়েশি কেনাও হয়।

ঢাকায় রওনা দেওয়ার দিন খুবই মন খারাপ হয়, বিশেষ করে আম্মাকে রেখে যাওয়ার জন্য। আম্মা হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়েছেন, তার পরও অনেক দুর্বল। পুরো সুস্থ হতে আরও সময় লাগবে। যাওয়ার সময় মেলী ও বড় ভাই আমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করতে যায়। গাড়িতে উঠে বড় ভাই গানের সুইচ অন করতেই জগজিৎ সিংয়ের গান, ‘এ সাফার হ্যা বাড়ি কাঠিন সাফার” মানে ‘এ যাত্রা বড়ই কঠিন যাত্রা’ বেজে উঠতেই আমরা তিনজনই উচ্চস্বরে হেসে উঠি। আসলেই আমার এই মেলী ছাড়া একা ঢাকাযাত্রা বড়ই কঠিন ছিল। আম্মার জন্যও মন খুবই খারাপ ছিল।

এয়ারপোর্টে বিদায় নেওয়ার পর আমি টার্মিনালে ঢুকে যাওয়ার আগে পেছন ফিরে তাকাই। দেখি, মেলী আমার দিকে করুণ ছলছল চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যাই। পুরো ফ্লাইট বলতে গেলে ঘুমিয়ে কাটাই আর যখন জাগি তখন মেলীর চেহারা মনে ভাসে। আম্মাকে মনে পড়ে। আমি অপরিচিত লোকদের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসি, তবে এবার কাউকে সহ্য হয় না। সময় যেন আটকে রয়েছে।

ঢাকায় এসে বড়ই ব্যস্ততায় আমার সময় কাটে। এদিকে ধরা পড়ে আমি এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সে সময় ফোনের দাম অনেক বেশি ছিল, তাই আমার সঙ্গে মেলীর কথাবার্তা হতো ফ্যাক্সে। আমার বাচ্চা হওয়ার কথা শুনে মেলী ভীষণ খুশি হয় এবং জানায় বাচ্চার নাম সে রাখবে। আমি যেন সাবধানে থাকি, এ রকম হাজারো কথা লিখে। এক মাস পর আমার বড় বোন মেলীকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে মায়ামিতে স্বামীর কাছে চলে যায়। মেলী মায়ামিতে গিয়ে ভীষণ আনন্দিত হয়। কারণ, সে লেখে, এখানকার চাঁদ অনেক বড় এবং পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যায়। আপনি থাকলে খুব ভালো লাগত। ওর হাতের সুন্দর লেখা ফ্যাক্স চিঠি পড়তে খুব ভালো লাগত। প্রথম প্রথম ওর চিঠিগুলো পড়লে মনে হতো, মেলীর আনন্দ চিঠির অক্ষরে ঝরে ঝরে পড়ছে। ক্রমে ক্রমে কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে উঠতে লাগে ওর চিঠি। একটা চিঠিতে জানায়, এখানে আমার পড়াশোনা হবে না, কারণ অনেক টাকা লাগবে। আর আম্মা সামনের মাসে ঢাকা যাবে। আমিও আম্মার সঙ্গে চলে যাব। আপনি আমার জন্য আগের মতো রুম সাজিয়ে দেবেন। আমাদের আদাবরে দুই বেডরুমের বাসা ছিল। আমি ওকে এক রুম সাজিয়ে দিয়েছিলাম। এদিকে অফিসের ব্যস্ততা, অন্তঃসত্ত্বা ও শ্বশুরবাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে তখন আমার নাভিশ্বাস উঠছিল। সে সময় আমার স্বামী প্রায় প্রতিদিন অনেক রাত করে বাড়ি ফিরত। আমার জন্য দিনগুলো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমি বুঝতে পারি, মায়ামিতে ওর জীবন সহজ ছিল না। ঢাকায় ওকে কোনো কাজ করতে হতো না। ওখানে ওর কাজের চাপ বেড়েছে। আর যেহেতু পড়াশোনা করতে পারবে না, তাই ওর থাকার ইচ্ছাও চলে গিয়েছিল। আমি ওর সব কথায় সায় দিই। ও নাই দেখে আমারও খারাপ লাগে। ও ঢাকায় চলে এলে আমারও অনেক ভালো সময় কাটবে।

এক রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে আমার স্বামীর অনেক দেরি হচ্ছিল। আমি গ্রিলঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। রাস্তার কুকুরগুলো টানা কাঁদছিল। আমি তখন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। আজ কিছু একটা হয়েছে, আমি যেন নিশ্চিত। বুক ধকধক করছে। যাক, একটু পরই নিচে গাড়ি এসে থামে। দেখি ও নামছে। বুক থেকে যেন পাথর নেমে যায়। তবে তখনো আমি জানি না, তখন মায়ামিতে এক ঘণ্টা আগে ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

পরদিন ৪ এপ্রিল আমি সকাল আটটায় অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হই। গাড়ি আসে সাড়ে আটটায়। বনানী যেতে লাগে আধঘণ্টা। হঠাৎ শুনি ল্যান্ড ফোন বাজে। আমার স্বামী দ্রুত ফোন ধরে। ওপাশের কথা শুনেই ওর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী ফোন করেছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই ও জানায়, আমার দুলাভাইয়ের স্টোরে কে জানি মারা গেছে, আমি জানি না। আমি কোনো কিছু না ভেবে অফিসে চলে আসি। প্রতিদিন অফিসে ঢুকে প্রথমে অ্যাডমিন অফিসারের রুমে ঢুঁ মেরে তারপর আমার রুমে ঢুকি। সেদিন দেখি, তিনি ও অফিস পিয়ন সামাদ আমার দিকে কেমন করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ওদের দেখে বলি, কী ব্যাপার, এভাবে চেহারা করে আছেন কেন? আপনাদের কি কেউ মারা গেছে? বলে আমি হাসতে হাসতে আমার রুমে ঢুকি।

আমি অফিসে ঢোকার আগে আমার স্বামী অফিসে ফোন করে ঘটনা জানিয়ে দেয় এবং ওদের জানায়, আমি যেন কোনোভাবেই খবরটা না জানি। আমি একটা ফ্যাক্স করি মায়ামিতে দুলাভাইয়ের দোকানে এবং সামাদকে পাঠাই হোমবাউন্ডে। তখন ওখান থেকে ফ্যাক্স পাঠাতাম। বারবার হোমবাউন্ডে ফোন করি কোনো ফ্যাক্স এসেছে কি না। কী খবর, কে মারা গেছে?

দুপুরের দিকে কীভাবে জানি আমার ফোনে সরাসরি ফোন চলে আসে। তুমি জানো না, মেলী মারা গেছে! আমার ঢাকার বড় দুলাভাইয়ের গলা। আমার সামনে তখন ফ্লোরে ফোন ভেঙে কয়েক টুকরা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক।