কূট লড়াই’র হটস্পটে বাংলাদেশ

ওয়াশিংটন-মস্কো যুদ্ধে ঢাকাকে নাজুক করে তুলছে কারা?

বিশেষ প্রতিনিধি : বিশ্বের দুই পরাশক্তির চিপায় বাংলাদেশের চ্যাপ্টা হওয়ার গুঞ্জন-শঙ্কা অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার স্নায়ুতে সরাসরি মাথা দিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। সমান্তরালে সুপার পাওয়ার দেশ দুটিও বাংলাদেশে মাথা ঢুকিয়েছে যার যার মতো। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিয়াকর্ম অনেকটা খোলাসা হলেও রাশিয়ারটি ছিল ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। এখন তা-ও পরিষ্কার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সমালোচনার মধ্য দিয়ে পুতিনের রাশিয়াও ঢুকে গেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে। এতে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ প্রবাদের দশায় পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উলুখাগড়ার মতো বাংলাদেশকে প্রক্সি ও বাফার রাষ্ট্রের পরিণতিতে নিতে নেমে পড়েছে একাধিক পক্ষ। তারা যে মাত্রায় ও পরিমাণে এগিয়েছে, সেখান থেকে ব্যাকপুটের পথ হারিয়ে গেছে।
ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে সরকারের অবিরাম ধমকাধমকির মাঝে অপেক্ষা ছিল অন্য রাষ্ট্রগুলোর মতিগতি বোঝার। প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, সরকারই-বা কোন সাহসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন রুক্ষতায় নেমেছে? এ প্রশ্নের মাঝেই কড়া প্রতিক্রিয়া রাশিয়ার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের চেষ্টা শিরোনামে বিবৃতি। ঢাকায় মার্কিন দূতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয়ে মস্কোয় বসে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই মুখপাত্র ঢাকার শাহীনভাগে বিএনপির নিখোঁজ নেতার বাসায় গিয়ে পিটার হাসের নাজেহাল হওয়াকে বলেছেন ঘটনাটি মার্কিন কূটনীতিকের তৎপরতার প্রত্যাশিত ফল। যিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষার নামে ক্রমাগত দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। বাংলাদেশে ব্রিটিশ ও জার্মান কূটনৈতিক মিশনে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সহকর্মীরাও একই ধরনের কাজ করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মারিয়ার এ ধরনের সরাসরি মন্তব্যের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও প্রকাশ্যে ঢুকে গেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটিশ-জার্মানের নাম নিয়ে প্রতিপক্ষও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে রাশিয়া। রুশ ভাষায় মারিয়ার ওই ব্রিফিংয়ের ইংরেজি ট্রান্সক্রিপ্টের বাংলা বড় মারাত্মক। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়ার অজুহাতে ক্রমাগতভাবে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে প্রভাব বিস্তার করছে যুক্তরাষ্ট্র। খবরটি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গতানুগতিক কূটনীতির বাইরে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে নিজের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে আখিম ট্র্যোস্টার, রুশ মুখপাত্রের বক্তব্য নিয়ে করা একটি বাংলা দৈনিকের ইংরেজি ভার্সনের রিপোর্টের লিংক শেয়ার করেছেন। সঙ্গে ক্যাপশনে জার্মান রাষ্ট্রদূত ‘যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগ সফর’ এর দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত করে তার সঙ্গে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলার তুলনা করে লিখেছেন, পিটার হাসের শাহীনবাগে যাওয়া ক্ষমার অযোগ্য! একটি গণতান্ত্রিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর নৃশংস বেআইনি আক্রমণ, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা এবং অপহরণ, অতিপ্রয়োজনীয় বেসামরিক ইউক্রেনীয় অবকাঠামো ধ্বংস করা, পুরো বিশ্বকে কষ্ট দেওয়ার চেয়েও অনেক বেশি মারাত্মক।
বাংলাদেশকে নিয়ে রুশ-মার্কিন দূতাবাসের মধ্যে এ রকম কূটনৈতিক বচসার ঘটনা বিগত স্নায়ুযুদ্ধ (১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর) শেষ হ‌ওয়ার পর দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র সচরাচর খোঁচা সহ্য করে অভ্যস্ত নয়। দম নেয়, হাল ছাড়ে না। পরে সময়-সুযোগে যাকে দিয়েই হোক সব উশুল করে। তার ওপর স্নায়ুযুদ্ধের এ রকমফের এগোচ্ছে নিজস্ব গতিতে। কোথাও নরমে, কোথাও গরমে। কোথাও পুরোনো সমীকরণে। কোথাও নতুন মেলবন্ধনে। এবারের এই বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের কিছু ছাপ বা জের বাংলাদেশে পড়ার সমূহ শঙ্কা থাকলেও সরাসরি তাপ পড়ার লক্ষণ ছিল না। এখন কেবল ছাপ নয়, তাপও পড়ে যাচ্ছে। দুই শীর্ষ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছে সাবজেক্ট হয়ে গেছে বাংলাদেশ। তা-ও কিছুটা ৫০ বছর আগের মোড়কে। এবার যুক্তরাষ্ট্র‌ তার মিত্র এবং রাশিয়ার পাশে অবস্থিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে পুরোনো ধাঁচে। সময়টাও ঘটনা। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিযোগিতা আগামী বছরের শুরুতে উত্তপ্ত হবে নিশ্চিত। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো এরই মধ্যে এখন পাল্টাপাল্টি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অপারেশনে নামছে। এর জের কী হতে পারে? কোথায় গড়াতে পারে পরিস্থিতি? এ প্রশ্নের কিঞ্চিৎ জবাব মিলছে রোহিঙ্গা বিষয়ে চীন ও রাশিয়ার মতিগতিতে।
রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের পর থেকে মিয়ানমারের জান্তাকে সমর্থন দেওয়া ভারতসহ এই শক্তিগুলো রোহিঙ্গা নিয়ে জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো গৃহীত প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এ নিয়ে টান টান উত্তেজনা। মাঝেমধ্যে সহিংসতাও হচ্ছে। আর ভেতরে ভেতরে নানা পথে বিদেশ চম্পট দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। তা কানাঘুষা বা কথার কথা থাকলেও ঘটনাচক্রে চলে এসেছে বিশ্ব গণমাধ্যমে। এক মাস সাগরে ভেসে থাকার পর ইন্দোনেশিয়া উপকূলে নেমে প্রাণে বেঁচেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ১৮০ জনের বেশি সদস্যের একটি দল। খাবার ও পানির অভাবে নারী-শিশুসহ বহু যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ইন্দোনেশিয়ার কোস্টগার্ড। নামকরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর হচ্ছে, গেল ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ উপকূল থেকে চার শতাধিক যাত্রী নিয়ে রওনা হওয়া দুটি নৌযানের দ্বিতীয়টি এটি। ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় বেশ কিছুদিন উদ্দেশ্যহীন যাত্রা করে নৌযানটি। ১৮০ যাত্রী নিয়ে প্রথমে নৌযানটি সাগরে ডুবে যায়। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদের খাদ্য ও পানি দিয়ে সাহায্য করলেও তীরে ভেড়ার অনুমতি দেয়নি।
টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাওয়ায় নৌযানে করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে, গেল দুই মাসে বাংলাদেশ উপকূল থেকে এ রকম উদ্দেশ্যহীন যাত্রা করেছে আরো বেশ কটি নৌযান। কেবল রোহিঙ্গা নয়, কূটনৈতিক এই ফেরে হটস্পটে পড়ে উলুখাগড়ার দশার প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ। এর ডানে-বামে রুশ-চীন, ভারত, মার্কিনসহ বিভিন্ন দেশই নয়; দেশের বড় দুটি দলও আচ্ছা রকমের প্রভাবকের ভূমিকায়। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশে বিবদমান রাজনৈতিক বিরোধের ফয়সালা। নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের নিশানাও সেখানে।