শিতাংশু গুহ : প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জানিয়েছেন, আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। রাজনৈতিক মহলে কিছুটা উৎসাহ থাকলেও জনগণের মধ্যে এ নির্বাচন নিয়ে তেমন চাঞ্চল্য থাকে না, কারণ নির্বাচনটি পরোক্ষ ভোটে। বাংলাদেশে একদা রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা ছিল, তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে সবার উৎসাহ থাকত, কারণ ভোট ছিল প্রত্যক্ষ। দেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হলে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী ড. কামাল হোসেনের মধ্যকার নির্বাচনটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাত্তার জিতলেন, কদিন পর এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করলেন! পরবর্তী সময়ে পল্টনে এক জনসভায় প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি ভাষণ আমার মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন হলো ড. কামাল ও সাত্তারের মধ্যে। জনগণ ভোট দিল ড. কামালকে, জিতলেন সাত্তার। আর ক্ষমতায় বসলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।’ ঘটনা তা-ই ছিল।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাঁরা কারা এবং তাঁদের ভূমিকা জনগণের জানা দরকার। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সৌভাগ্যবান, পুরো দুই টার্ম নির্ঝঞ্ঝাট কাটিয়েছেন, কোনো বিতর্কে জড়িয়ে যাননি। প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সকল আলোচনার ঊর্ধ্বে। উইকিপিডিয়া বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ১২ জানুয়ারি ১৯৭২, মোট ২৭০ দিন (আওয়ামী লীগ) রাষ্ট্রপতি ছিলেন। দ্বিতীয় দফায় ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ (বাকশাল) ২০২ দিন, ক্যু ডেটা-য় নিহত হন। উইকিপিডিয়া সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-১২ জানুয়ারি ১৯৭২, মোট ২৭০ দিন (আওয়ামী লীগ) রাষ্ট্রপতি দেখিয়েছে। ঠিক একই সময়ে দুজন রাষ্ট্রপতি, বিষয়টি বেমানান। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধকালে ‘অস্থায়ী’ রাষ্ট্রপতি ছিলেন। উইকিপিডিয়া সংশোধনযোগ্য, ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সংশোধনী আনতে পারেন। আমরা যখন ঢাকায় সাংবাদিকতা করতাম, তখন আমাদের জীবনের অনেকটা সময় কারফিউর মধ্যে কেটেছে। কারণ, তখন দেশে ঘন ঘন সরকার বদল হতো। দৈনিক সংবাদের নিউজ ডেস্কে স্বপন দত্ত সব সময় ওয়ালেটে ৫০০ টাকা গচ্ছিত রাখতেন, বলতেন, ‘ক্যু ফান্ড’। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঠিক কতটি ক্যু হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু কারফিউ ও প্রায়ই সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় স্বপন দত্তের মতো অনেকেই ‘আপৎকালীন’ কিছু টাকা রেখে দিতেন। ওই সময়টায়, বিশেষত বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হত্যার পর মনে হতো বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন কি শুধু ‘হত্যাকাণ্ডের’ মধ্য দিয়েই ঘটবে? এরশাদ বিনা রক্তপাতে ক্ষমতাসীন হয়ে তা পাল্টে দেন। জিয়ার সন্তান বিএনপি, এরশাদের সন্তান জাতীয় পার্টি। উভয়ের জন্ম ক্যান্টনমেন্টে। এরশাদ গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর দেশে মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকার চালু হয়। অন্তত হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের ধারা বন্ধ হয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দফায় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ (আওয়ামী লীগ), ১ বছর ৩৪৬ দিন, তিনি ভালো সময় কাটিয়েছেন। এরপর আসেন মোহাম্মদ মোহাম্মদুল্ল্যাহ (আওয়ামী লীগ), ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৪ এবং ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৪ থেকে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫, মোট ১ বছর ৩২ দিন। তিনি হাসির পাত্র ছিলেন, তাঁকে রাষ্ট্রপতি নয়, বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারি মনে হতো।
বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মুশতাক আহমদ, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫, মোট ৮৩ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাকেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হিসেবে বলা হয়েছে, তবে তিনি শান্তিতে ছিলেন না! এরপর আসেন ‘ঠুঁঠো জগন্নাথ’ আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ২১ এপ্রিল ১৯৭৭, মোট ১ বছর ১৬৬ দিন। জিয়াউর রহমান এ সময়টায় নিজেকে গুছিয়ে আনেন এবং সায়েমকে বিতাড়িত করে ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ থেকে ৩০ মে ১৯৮১, মোট ৪ বছর ৩৯ দিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। তিনি নিহত হন, উইকিপিডিয়া তাঁকে মিলিটারি/বিএনপি বলে বর্ণনা করেছে।
জিয়া হত্যার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কপাল খোলে। তিনি ৩০ মে ১৯৮১ থেকে ২০ নভেম্বর ১৯৮১ এবং পুনরায় ২০ নভেম্বর ১৯৮১ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২, মোট ২৯৮ দিন (বিএনপি) ক্ষমতায় ছিলেন এবং তিনি অপসারিত হন, এরশাদ তাঁকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। তিনি নীরবে প্রস্থান করেন। আহসানউদ্দিন চৌধুরী নামে অপর একজন অথর্ব নির্দলীয় হিসেবে ২৭ মার্চ ১৯৮২-১০ ডিসেম্বর ১৯৮৩, মোট ১ বছর ২৫৮ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তিনিও অপসারিত হন।
জিয়া ও এরশাদ দুজনই বেছে বেছে বিচারপতিদের ধরে এনে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছেন এবং প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বিদায় করে দিয়েছেন। এ কারণে ওই সময়টায় বিচারপতিদের প্রতি মানুষের একধরনের বিরক্তি ছিল। এরপর রাষ্ট্রপতি হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, তিনি ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০, মোট ৬ বছর ৩৬০ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। উইকিপিডিয়া তাঁকে মিলিটারি/জাতীয় পার্টি হিসেবে বর্ণনা করে। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্যে সাহাবুদ্দীন আহমদ ৮ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১০ অক্টোবর ১৯৯১, মোট ৩০৮ দিন নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এ সময় তাঁর ভূমিকা ভালো ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবদুর রহমান বিশ্বাস ১০ অক্টোবর ১৯৯১ থেকে ৯ অক্টোবর ১৯৯৬, মোট ৫ বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু ছিল। তিনি অন্যায়ভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে বিএনপিকে ক্ষমতায় রাখতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন, যদিও সেনাবাহিনীর চমৎকার ভূমিকায় তাঁর সেই প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হয়ে যায়। এ সময় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা কারও ভোলার কথা নয়! রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস এ অপকর্মে জড়িত ছিলেন। ১২ দিনের মাথায় এই সরকারের পতন ঘটে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং জুন মাসে নির্বাচনে এদের পতন ঘটে, আওয়ামী লীগ ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে।
শেখ হাসিনা বিশ্বাস করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। তিনি ৯ অক্টোবর ১৯৯৬ থেকে ১৪ নভেম্বর ২০০১, নির্দলীয় হিসেবে মোট ৫ বছর ৩৬ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েই তিনি স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে সবকিছু করেন। শেখ হাসিনা তাঁর ভুল বুঝতে পারেন এবং নির্বাচনে পরাজিত হন। বিএনপির বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৪ নভেম্বর ২০০১ থেকে ২১ জুন ২০০২, মোট ২১৯ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং খালেদা জিয়ার রোষ থেকে বাঁচতে দৌড়ে পালাতে বাধ্য হন। মোহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার (বিএনপি), ২১ জুন ২০০২ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২, মোট ৭৭ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ভাইস চ্যান্সেলর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, মোট ৬ বছর ১৫৯ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। উইকিপিডিয়া তাঁকে নির্দলীয় বলেছে, যদিও তিনি খালেদা জিয়ার চাইতেও বড় বিএনপি ছিলেন এবং তাঁর কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডে সম্ভবত ভিসিরা এখনো লজ্জিত। তিনি রাষ্ট্রপতি পদটি কলঙ্কিত করেছেন! ২০০৯-এ ভোটে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জিল্লুর রহমান ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ থেকে ২০ মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি ক্ষমতাসীন অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন, যা ইতিহাস। তিনি মোট ৪ বছর ৩৬ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। অতঃপর বর্তমান রাষ্ট্রপতি, মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ, ১৪ মার্চ ২০১৩ থেকে ২৪ এপ্রিল ২০১৮ এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৮ থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন আছেন।
উইকিপিডিয়া মুশতাক, সায়েম ও সাত্তারকে ‘অপসারিত’ বলেছে। বদরুদ্দোজা চৌধুরীও অপসারিত? একটা সময় ছিল, বিচারপতিরা অনায়াসে রাষ্ট্রপতি হচ্ছিলেন এবং তাঁদের ভূমিকা গৌরবের ছিল না। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ছিলেন ‘অথর্ব’, হয়তো এ জন্য জিয়া তাঁকে কাছে টেনে নেন এবং এরশাদ তাঁকে বন্দুকের নলের জোরে বের করে দেন এবং তিনি সুবোধ বালকের মতো কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফেরেন। ২০০৬-২০০৮ ফখরুদ্দীন-মইন সরকারকে রাজনীতিকেরা গালাগালি দেন বটে কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁদের গালি দেন না, কারণ ওই দুই বছর মানুষ শান্তিতে ছিল। একইভাবে জিয়া-এরশাদ যেভাবে সেনাবাহিনীর নামে বদনাম কুড়িয়েছেন, রাজনৈতিক শাসনামলে, বিশেষত শেখ হাসিনার সময়ে তাঁদের ভাবমূর্তি এখন অনেক উজ্জ্বল। দেশে এখন উন্নয়নের জোয়ার বইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এবার কে হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি? উত্তর হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁকে চাইবেন, তিনিই হবেন ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি। আবদুল হামিদ স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিনের কপাল খুললে তিনি হবেন প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি? আওয়ামী লীগ সভাপতিকে সবাই সভানেত্রী বলে থাকেন, শিরিন শারমীন রাষ্ট্রপতি হলে কি তাকে ‘রাষ্ট্রনেত্রী বলা হবে, নাকি শুধুই মিসেস রাষ্ট্রপতি? আবদুল হামিদকে কোনো ক্রাইসিস মোকাবিলা করতে হয়নি। আশা করি, পরবর্তী রাষ্ট্রপতিকেও তা করতে হবে না, যদি ক্রাইসিস হয়, রাষ্ট্রপতিকে তা যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। তাই ‘অনুগত’ অথচ দক্ষ-অভিজ্ঞ রাষ্ট্রপতি চাই। সবশেষে বলা যায়, রাষ্ট্রপতি নামগুলো সব একই রকমের, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে কিছুটা বৈচিত্র্য আনলে মন্দ কী?